মিরপুরে ৩ কিশোর হত্যা: ৭ বছরেও চিহ্নিত হয়নি হত্যাকারী
২০১৫ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। একটি সহিংস রাজনৈতিক আন্দোলনের সময় রাজধানীর মিরপুর এলাকায় ৩ কিশোরকে গুলি করে হত্যা করা হয়। সন্দেহ ছিল, তারা বিরোধী দলের হয়ে গণপরিবহনে অগ্নিসংযোগ করেছে।
ঘটনাটি সারাদেশে আলোড়ন তৈরি করে। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট উদ্ধৃতি করে তখন পত্রিকাগুলো জানায়, তাদের শরীরে অন্তত ৫৬টি বুলেটের আঘাত রয়েছে।
এ ঘটনায় মোট ২টি মামলা দায়ের করা হয়। একটি করে পুলিশ এবং অপরটি পরিবার। পুলিশের তদন্তে 'আস্থা হারিয়ে' পরিবারের পক্ষ থেকে মামলাটি করা হয়। তবে, ৭ বছর পেরিয়ে গেলেও পরিবারগুলো আজও জানে না মামলা ২টির অগ্রগতি সম্পর্কে।
২০১৭ সালের মে মাসে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে পুলিশ। সেখানে বলা হয়, যদিও এটি একটি হত্যার ঘটনা, তবে তারা কোনো অপরাধীকে খুঁজে বের করতে পারেনি।
চূড়ান্ত প্রতিবেদনে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) উপ-পরিদর্শক মো. রফিকুজ্জামান মিয়া বলেন, 'ঘটনার সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের নাম-ঠিকানা জানা যায়নি এবং অদূর ভবিষ্যতে তাদের নাম-ঠিকানা খুঁজে বের করে গ্রেপ্তারের সম্ভাবনাও খুবই ক্ষীণ।'
আদালত পরবর্তীতে প্রতিবেদনটি গ্রহণ করেন। এতে আরও বলা হয়, পুলিশ মামলাটি পুনরায় তদন্ত করবে এবং সন্দেহভাজন কাউকে চিহ্নিত করতে পারলে তাকে বা তাদেরকে অভিযুক্ত করবে।
আদালতের রেজিস্টার বই থেকে জানা যায়, এক ভুক্তভোগীর পরিবারের দায়ের করা মামলা ২০১৮ সালের এপ্রিলে ঢাকার একটি আদালত 'খারিজ' করেন। আদালতের কাছে ন্যায়বিচার পাওয়ার আশায় ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে মামলাটি করেছিল পরিবারটি।
যাইহোক, ভুক্তভোগীদের পরিবারের কেউই মামলাগুলোর অগ্রগতির বিষয়ে অবগত নয়।
২০১৫ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি রাতে পশ্চিম কাজীপাড়ার বাইশবাড়ি এলাকার একটি অন্ধকার গলিতে সুমন, রবিন ও জুয়েলকে গুলি করে হত্যা করা হয়। মিরপুরের রোকেয়া সরণির কৃষিবিদ ভবনের কাছ থেকে তাদের আটক করা হয়। অভিযোগ ছিল, তারা বাসে আগুন লাগানোর উদ্দেশ্যে পেট্রোলবোমা বহন করছিলেন।
পরিবার ও স্থানীয়রা জানিয়েছে, ৩ জনেরই বয়স ১৪ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে। যদিও পুলিশ রিপোর্টে তাদের বয়স ১৯ এবং ২০ বছর বলা হয়েছে।
সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে পরিবারের সদস্যরা জানান, চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা বা আদালত তাদের মামলা খারিজ করার বিষয়ে কেউ তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি।
আদালতে মামলা দায়েরকারী সুমনের মা জ্যোৎস্না রবি দাস বলেন, 'আমি বিচার চেয়ে থানায়, আদালতে এবং আরও অনেক জায়গায় গিয়েছি। কিন্তু আজও বিচার পাইনি।'
পরিবারের আইনজীবী মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির জানান, ২০১৭ সালের নভেম্বর পর্যন্ত তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেওয়া হয়নি।
এরপর আর মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে খোঁজ করেননি বলেও জানান তিনি।
রবিনের দাদী হালিম খাতুন বলেন, 'আমি ন্যায়বিচার চাই। কিন্তু কোথায় গেলে বিচার পাব জানি না।'
ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ খুরশীদ আলম খান বলেন, নিহতদের পরিবার অধিকতর তদন্তের জন্য একটি আপিল করতে পারে। তবে পরিবারগুলো বলেছে যে, আইনি লড়াইয়ের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যয় বহন করা তাদের সাধ্যের বাইরে।
হালিমা ও জ্যোৎস্না ২ জনই গৃহকর্মীর কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন।
তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে প্রশ্ন
তদন্ত প্রতিবেদনে তদন্ত কর্মকর্তা উল্লেখ করেছেন, বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলের ডাকা সহিংস হরতালের সময় পেট্রোল ও ককটেল বোমা দিয়ে গাড়িতে অগ্নিসংযোগের সময় স্থানীয়রা দুর্বৃত্তদের ধাওয়া করলে নিহত ৩ জনসহ ১০ জনের একটি দল এলোপাতাড়িভাবে গুলি চালায়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, সহযোগীদের গুলিতে ওই ৩ জন পরে গেলে উত্তেজিত জনতা তাদের গণধোলাই দেয়। পুলিশ তাদের উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে সেখানে তাদের মৃত্যু হয়।
তবে, প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে বেশ কয়েকটি সংবাদমাধ্যম সে সময় জানিয়েছিল যে ওই দিন মিরপুর এলাকায় কোনো গণপিটুনির ঘটনা ঘটেনি।
পুলিশ প্রতিবেদনে নিহত ৩ জনকে 'দুষ্কৃতিকারী বোমাবাজ' বলে অভিহিত করা হয়েছে। যদিও স্থানীয় থানায় তাদের বিরুদ্ধে কোনো অপরাধমূলক রেকর্ড ছিল না।
স্থানীয় অন্তত ১০ জন গত মাসের শেষের দিকে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন যে, নিহত ওই ৩ জনের কোনো অপরাধমূলক রেকর্ড ছিল না। তবে, তারা মাঝে মাঝে রাজনৈতিক সমাবেশে যোগ দিত।
পরিবারের সদস্যরা বলছেন, মামলার তদন্ত ও খুনিদের খুঁজে বের করতে পুলিশ যথেষ্ট আন্তরিক নয়।
মামলার জব্দ তালিকায় রক্তমাখা দড়ি (ধারনা করা হয় এগুলো দিয়ে নিহতদের হাত বেঁধে রাখা হয়েছিল), কার্তুজ বা গুলি অন্তর্ভুক্ত করেনি পুলিশ। অথচ, ঘটনার পরদিন সকালে ঘটনাস্থলে দ্য ডেইলি স্টারের সংবাদদাতারা সেগুলো দেখতে পান।
যোগাযোগ করা হলে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের অতিরিক্ত এসপি মিয়া কুতুবুর রহমান চৌধুরী গত ২০ জানুয়ারি দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, নথিপত্র না দেখে তিনি মামলার বিষয়ে মন্তব্য করতে পারবেন না।
কি ঘটেছিল?
২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি বিএনপি এবং তাদের মিত্ররা জাতীয় নির্বাচন বয়কট করে সরকার পতনের আন্দোলন শুরু করে।
এসময় গণপরিবহনে অগ্নিসংযোগসহ সহিংসতায় অন্তত ৭৫ জনের মৃত্যু হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ২২ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা ৭টার দিকে স্থানীয়রা ৩ জনকে অগ্নিসংযোগকারী সন্দেহে আটক করে।
পরে রাত ১০টার দিকে স্থানীয় ১০ থেকে ১২ জন ছেলেকে হাত বেঁধে বাইশবাড়ি এলাকার একটি গলিতে নিয়ে যায় বলেও জানান তারা।
বেশ কয়েকজন স্থানীয় জানান, তারা পুলিশকে একটি গলিপথ থেকে ৩টি গুলিবিদ্ধ মরদেহ নিয়ে যেতে দেখেছেন।
গলির পাশে একটি বিল্ডিংয়ে বসবাসকারী এক নারী বলেন, 'সেখানে কোনো ভিড় ছিল না। আমি কিছুক্ষণ পর পর কয়েকটি গুলির শব্দ শুনেছি।'
স্থানীয় আরও ১২ জনের বেশি মানুষও একই কথা জানান।
তবে ঘটনার পর পুলিশ মিডিয়াকে জানায়, তারা কাজীপাড়ায় জনতার মারধরে গুরুতর আহত ৩ ছেলেকে উদ্ধার করে এবং তারা ২৩ ফেব্রুয়ারি ভোরে ঢামেক হাসপাতালে মারা যায়।
একই দিনে দায়ের করা পুলিশের মামলায় বলা হয়েছে, ৩ 'অজ্ঞাত অগ্নিসংযোগকারী'কে জনতাকে পিটিয়ে ও গুলি করে হত্যা করেছে।
Comments