‘বন্দুকযুদ্ধ’ ও ন্যায়বিচার

চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি একটি যুগান্তকারী রায় দিয়েছেন কক্সবাজারের আদালত। সিনহা রাশেদ খানকে 'পরিকল্পিতভাবে' হত্যার অভিযোগে বরখাস্ত পুলিশ কর্মকর্তা প্রদীপ কুমার দাশ ও লিয়াকত আলীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। মামলার ভাগ্য কী হবে, তা নিয়ে এক বছরেরও বেশি সময় জল্পনা-কল্পনার পর এ রায় এলো।

মামলার রায়ে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহার সঙ্গে সেই রাতে কী হয়েছিল তাই শুধু জানানো হয়নি, বরং সাজানো 'বন্দুকযুদ্ধের' ঘটনায় দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের প্রথমবারের মতো আইনের আওতায় আনা হলো। মামলার রায়ে আদালত ৩ পুলিশসহ ৬ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন এবং ৭ পুলিশ সদস্যকে খালাস দিয়েছেন। ভুক্তভোগীর পরিবার এবং মানবাধিকার কর্মীদের জন্য এটি সত্যিকার অর্থেই একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।

আমরা এ মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের অপেক্ষায় আছি। তবুও আদালতের দেওয়া রায়ে ২০২০ সালের ৩১ জুলাইয়ের ঘটনা নিয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে সেটি কোনো 'বন্দুকযুদ্ধ' ছিল না। যদিও পুলিশ তাই দাবি করেছিল। এটি ছিল ঠাণ্ডা মাথায় 'পরিকল্পিত' হত্যাকাণ্ড। আমরা ওই ঘটনার প্রতিটি মিনিটের হিসাব পেয়েছি। 'বন্দুকযুদ্ধ' বা 'ক্রসফায়ারের' গল্প যে সাজানো থাকে এ রায় তারই বিচারিক স্বীকৃতি।

আমরা অতীতে এই গল্পের বিভিন্ন রূপ শুনেছি। কিন্তু, সবগুলোর মধ্যে যে মিল আছে তা হলো 'অপরাধী' বা তার সহযোগীরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর হামলা চালায় এবং তা মোকাবিলা করতে ও আত্মরক্ষার্থে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গুলি চালাতে 'বাধ্য' হয়। এখন যেহেতু আদালত সিনহার সঙ্গে 'বন্দুকযুদ্ধের' গল্পের পেছনের সত্যতা প্রকাশ করেছে, এটাও তো সম্ভব যে এর আগে আরও সাজানো 'বন্দুকযুদ্ধের' গল্প আমাদের সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ এখন খতিয়ে দেখা উচিত। ওসব ঘটনার পেছনে কারো কোনো স্বার্থ থাকলে তাদেরও বিচারের আওতায় আনা উচিত।

দুর্ভাগ্যবশত, এ ধরনের 'বন্দুকযুদ্ধের' ঘটনায় ভুক্তভোগীর পরিবার খুব কম ক্ষেত্রেই মামলার সুযোগ পায়। পুলিশ মামলা রুজু করতে চায় না। যদি কখনো মামলা করা হয়, পুলিশ বেশ দ্রুতই আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়ে দেয়। তদন্তে কিছুই পাওয়া যায়নি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। আর এভাবেই একের পর বাড়তে থাকে 'বন্দুকযুদ্ধে' মৃত্যুর সংখ্যা। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, সিনহাকে যে বছর হত্যা করা হয় অর্থাৎ ২০২০ সালে সারা দেশে 'বন্দুকযুদ্ধে' ১৯৫ জন নিহত হন।

গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, টেকনাফ থানার ওসি থাকাকালীন প্রদীপ কুমার দাশের ২ বছরের মেয়াদে টেকনাফ থানা পুলিশের হাতেই ৪৮টি 'বন্দুকযুদ্ধে' বিচার বহির্ভূতভাবে ৮০ জনেরও বেশি ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়। এবার প্রদীপকে দোষী সাব্যস্ত করার পর, অন্য সবগুলো ঘটনার যৌক্তিকতাও পরীক্ষা করা দরকার। তদন্ত করা দরকার সেগুলোর পেছনে কোনো অসৎ উদ্দেশ্য ছিল কি না। আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানাই।

সিনহার রায় এমন এক জগতকে সামনে এনে দিয়েছে যা এতদিন সরকারি গোপনীয় বিষয় ছিল। এখন আর পেছনে তাকানো যাবে না। ভেতরের সত্যগুলো উন্মোচন করা এখন আগের চেয়ে আরও বেশি জরুরি হয়ে পড়েছে। আমরা সরকারকে বিশেষ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে পুলিশ বা অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর দ্বারা সংঘটিত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সবগুলো ঘটনার বিভাগীয় তদন্ত শুরুর অনুরোধ করছি। বিচার বিভাগও তার নিজস্ব ব্যবস্থায় এসব ঘটনার তদন্ত করে মামলা চালাতে পারেন। ন্যায়বিচার পেতে ভুক্তভোগী পরিবারগুলোকে শক্তি ও ক্ষমতা দিয়ে সহায়তা করা প্রয়োজন।

Comments

The Daily Star  | English

41St BCS police cadre: 100 candidates facing fresh verification

The interim government is re-verifying the background of 100 individuals who passed the 41st Bangladesh Civil Service examinations and were recommended for police cadre jobs.

3h ago