ভেঙে ফেলা হচ্ছে শতাব্দী প্রাচীন ‘মহেশ্বরপাশা স্কুল অব আর্ট’

মহেশ্বরপাশা স্কুল অব আর্ট। ছবি: স্টার

বাংলাদেশে প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পশিক্ষার স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন চিত্রশিল্পী শশীভূষণ পাল। তার হাতে প্রতিষ্ঠিত হয় ব্যক্তিপ্রচেষ্টায় দেশের প্রথম শিল্পশিক্ষা প্রতিষ্ঠান 'মহেশ্বরপাশা স্কুল অব আর্ট'। সেই প্রতিষ্ঠানের শত বছরের পুরানো ভবনটি ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

স্থানীয় লোকজন ও সংস্কৃতিপ্রেমীদের দাবি, ঐতিহ্যবাহী এ ভবনটি সাংস্কৃতিক নিদর্শন হিসেবে সংরক্ষণ করা হোক।

ছবি: স্টার

শিক্ষাবিদ, ইতিহাস গবেষক ও খুলনা অঞ্চলের ইতিহাস গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ১৯০৪ সালে বাংলাদেশের ভূসীমানায় প্রথম শিল্পশিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন শশীভূষণ পাল।

খুলনার মহেশ্বরপাশায় বর্তমান যশোর রোডের পূর্ব পাশে নিজ বাড়িতে 'মহেশ্বরপাশা স্কুল অব আর্ট' নামে এই অংকন বিদ্যাপীঠটি যখন প্রতিষ্ঠিত হয়, সে সময় তৎকালীন পূর্ববঙ্গে এ ধরনের শিক্ষায়তন ছিল না।

১৯১৮ সালে প্রতিষ্ঠানটি জেলা বোর্ড ও সরকারি অনুদান পেতে শুরু করে। ১৯২৯ সালে বিদ্যালয়টি যশোর রোডের পশ্চিম পাশে স্থানান্তরিত হয়। সেখানেই সরকারি উদ্যোগে ভবনটি তৈরি হয়। এই শিক্ষায়তনে প্রায় ৪১ বছর অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন শশীভূষণ পাল।

১৯২২ সালের ২৮ মার্চ লর্ড লিটন বাংলার গভর্নর নিযুক্ত হলে সে বছর জুলাইয়ে তিনি তার স্ত্রীকে নিয়ে স্টিমারে চড়ে মহেশ্বরপাশা আর্ট স্কুল দেখতে আসেন।

বর্ধমানের মহারাজা বিজয়চাঁদ মহতব, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন, পল্লীকবি জসীম উদ্‌দীন, শিল্পী এসএম সুলতানসহ দেশি-বিদেশি বহু শিল্পানুরাগী এই প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনে এসেছিলেন।

১৯৭৫ সালের ১৪ মার্চ জয়নুল আবেদীন এক বক্তব্যে মহেশ্বরপাশা স্কুল অব আর্টকে এই বঙ্গের প্রথম শিল্পশিক্ষা কেন্দ্র হিসেবে স্বীকৃতি দেন। সময়ের পরিক্রমায় বিদ্যায়তনটি খুলনার গল্লামারি এলাকায় স্থানান্তরিত করে ১৯৮৩ সালে প্রথমে শশীভূষণ আর্ট কলেজ, পরে খুলনা আর্ট কলেজে রূপান্তরিত হয়।

২০০৯ সালে এটি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে চারুকলা ইনস্টিটিউট তথা 'চারুকলা স্কুল'-এ পরিণত হয়।

স্থানীয় বিদ্যানুরাগীরা খুলনা নগরীর দৌলতপুরের মহেশ্বরপাশা কুলীবাগান এলাকায় শুরুর দিকের ওই ভবনটিতে প্রায় ৪ দশক আগে শশীভূষণ শিশু বিদ্যানিকেতন গড়ে তোলেন। এরপর ১৯৮০ সালে সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয় প্রাথমিক বিদ্যালয়। ১৯৯১ সালের দিকে সেখানে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠা করা হয়। বর্তমানে ওই কমপ্লেক্সেই ৩টি প্রতিষ্ঠান আছে।

১৯২৯ সালে বর্ধমানের মহারাজাধিরাজের পৃষ্ঠপোষকতায় সরকারিভাবে ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছিল। ওই বছরের ১৯ মে ভবনটির উদ্বোধন করেন সে সময়ের খুলনা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর এইচ কুইনন্টন। ভবনের দেয়ালে থাকা শিলালিপিতে এসব তথ্য আছে।

সম্প্রতি, ওই স্কুল কম্পাউন্ডে গিয়ে দেখা গেছে, ৫৫ ফুট দৈর্ঘ্য আর ২৫ ফুট প্রস্থের ভবনটির দরজা-জানালাগুলো বেশ প্রশস্ত। একতলা ভবনটি চুন-সুরকি আর ইটের গাঁথুনিতে তৈরি। বারান্দার সামনে ছয়টি প্রবেশপথসহ মোট ৯টি দরজা আছে।

লোহার পাতের ওপর মাটির টালি বসিয়ে তার ওপর ছাদ ঢালাই দেওয়া ভবনের গায়ে কয়েকটি অশ্বত্থ গাছ বড় হয়ে উঠছে।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ১৯ জানুয়ারি মহেশ্বরপাশা আর্ট স্কুলটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত কিনা জানতে অধিদপ্তরকে চিঠি দেয় কেসিসি।

এর উত্তরে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের খুলনার আঞ্চলিক পরিচালক আফরোজা খান মিতা গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে জানান, ভনটি ব্রিটিশ আমলে নির্মিত একটি স্থাপনা। এটি সংরক্ষিত পুরাকীর্তি নয়।

শশীভূষণ সর্বপ্রথম এই বাংলায় চিত্রশিল্প বিদ্যালয় স্থাপন করেন। বিদ্যালয়টির সঙ্গে সাংস্কৃতিক বিকাশের ধারাবাহিকতা ও স্থানীয়দের আবেগ সম্পৃক্ত আছে। বিশেষ ব্যক্তিত্বের স্মারক নিদর্শন হিসেবে সংরক্ষণ করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সামনে উপস্থাপনের জন্য ট্যুরিজম অ্যাক্ট ২০১০ অনুযায়ী সম্ভাবনাময় পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা যেতে পারে।

সংরক্ষণ নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার ভার স্থানীয় সরকার পরিষদ বা জেলা প্রশাসনের ওপর ন্যস্ত করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর পরামর্শকের ভূমিকা পালন করবে।

শশীভূষণ বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরও পুরনো ওই ভবনটিতে পাঠদান হতো। পরে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ায় সেখানে আর পাঠদান হয় না।

২০১৬ সাল থেকে ভবনটি অপসারণে বিভিন্ন সময় সভা করা হয়েছে। সবশেষ ২০২১ সালের ২৯ আগস্ট খুলনা সিটি করপোরেশনের শহীদ আলতাফ মিলনায়তনে খুলনা নগর এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করতে সভা হয়।

সভায় কেসিসির তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী লিয়াকত আলী খান শশীভূষণ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শতবছরের পুরনো ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টি উত্থাপন করেন।

সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করা হয় এবং এ বিষয়ে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ভবনটি বিধি মোতাবেক ভেঙে ফেলার ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করা হয়।

এই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে বিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক নাহিদ সুলতানার কাছে চিঠি পাঠায় কেসিসি।

এরপর ২০২১ সালের ১৪ নভেম্বর সন্ধ্যায় বিদ্যালয়ে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় শ্রমকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান সভাপতিত্ব করেন।

সভায় বিদ্যালয়ের মাঠের মধ্যে থাকা পুরানো ভবনটি অপসারণ করে এর আদলে নতুন ভবন নির্মাণ এবং সেই ভবনের সামনে শশীভূষণ পালের প্রতিকৃতি স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়।

শশীভূষণ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি মাহফুজা শাহাবুদ্দিন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যেহেতু ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ এবং দৃষ্টিকটু, তাই এটি অপসারণ ছাড়া উপায় নেই। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি এই ভবনের আদলে আরেকটি ভবন করা হবে। শশীবাবুর স্মৃতি রক্ষার্থে ভাস্কর্য হবে। সে লক্ষ্যে দরপত্র কার্যক্রমও শেষ হয়ে গেছে। এখন শুধু ভাঙার অপেক্ষা।'

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাস্কর্য ডিসিপ্লিনের সহকারী অধ্যাপক মো. শেখ সাদী ভূঁঞা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ভবনটি ভাঙা কোনোভাবেই ঠিক হবে না। যেভাবেই হোক এটি রক্ষা করা দরকার। এর ঐতিহ্য সংরক্ষণ করা উচিত।'

সরকারি বিএল কলেজের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও গবেষক শঙ্কর কুমার মল্লিক শিল্পী শশীভূষণ পালের ওপর গবেষণা করেছেন। তিনি শিল্পীর উত্তর প্রজন্মের সঙ্গে কথা বলেছেন। বিস্ময় প্রকাশ করে তিনি বলেন, 'শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের জন্মেরও আগে এ স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেই স্কুল কীভাবে ভেঙে ফেলতে পারে!'

তিনি আরও বলেন, 'এটাই এই বঙ্গের প্রথম শিল্পশিক্ষা কেন্দ্র। এর সঙ্গে ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ জুড়ে আছে। এই গুরুত্ব বিবেচনায় এই ঐতিহ্যকে রেখে সরকারি উদ্যোগে আর্ট গ্যালারি করলে শিল্পী শশীভূষণ পাল যেমন এর ভেতর দিয়ে বেঁচে থাকবেন তেমনি ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা প্রকাশ পাবে।'

বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আমিরুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সিটি করপোরেশন থেকে ভবনটি অপসারণের চিঠি পাওয়ার পর আমাদের সভা হয়েছে। সেখানে ভবনটি অপসারণ করে এরই আদলে নতুন ভবনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। ভবনটি নিলামে বিক্রির জন্য গত ২১ ডিসেম্বর পত্রিকায় দরপত্র বিজ্ঞপ্তি দিয়েছি। গত ৪ জানুয়ারি দরপত্র জমা শেষ দিন ছিল। মোট ৬টি দরপত্র পড়েছে।'

Comments

The Daily Star  | English

Govt mulling incorporating ‘three zero’ theory into SDG

The government is considering incorporating the "three zero" theory of Chief Adviser Professor Muhammad Yunus into Sustainable Development Goals (SDGs)

12m ago