অদৃশ্য অনুভূতির দৃশ্যমান গল্প ‘তীব্র’

ছবি: শাহরিয়ার কবির হিমেল/স্টার

গ্যালারিতে ঢুকতেই প্রথমে নজরে পড়ল একটি লাল দেয়াল। দেয়ালে ঝোলানো রয়েছে অনেকগুলো ছবি। মনে হলো, ছবিগুলো যেন চিৎকার করছে। এটি সাদমান শহীদের ডকু-ফিকশন 'নো কোয়ার্টার' বা 'নির্দয়'। এটি আলো (ছদ্মনাম) নামের এক নারীর গল্প।

এখানে স্থান পাওয়া কিছু ছবি আলোর পারিবারিক অ্যালবাম থেকে নেওয়া। বাকিগুলো আলোর অভিজ্ঞতা থেকে অভিনেতাদের দিয়ে তৈরি করা হয়েছে।

ছবি: শাহরিয়ার কবির হিমেল/স্টার

আমাদের পারিবারিক অ্যালবামে কী থাকে? থাকে সুন্দর মুহূর্তগুলো। কিন্তু এর নেপথ্যে অনেক ঘটনা থাকে, যেগুলো হয়ত কখনও ছবি হয়ে ওঠে না। বাংলাদেশের অন্তত অর্ধেক নারী তাদের সঙ্গীর দ্বারা নির্যাতিত হন, আর ৮৭ শতাংশ নারী জীবনে অন্তত একবার যৌন নিপীড়নের মুখে পড়েন। সাদমানের এই 'চিৎকার করা' ছবিগুলো তাই শুধু আলোর কথা বলে না, সমাজের চকচকে অবয়বের আড়ালে থাকা বীভৎসতাও তুলে ধরে।

পাঠশালা সাউথ এশিয়ান মিডিয়া ইনস্টিটিউটের ২৩ বছর পূর্তি উপলক্ষে পান্থপথের দৃকপাঠ ভবনের ৮তলায় গত ২৪ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়েছে 'তীব্র' শিরোনামের প্রদর্শনী। এখানে সাদমান শহীদ ছাড়াও রয়েছে প্রণবেশ দাশ, সালমা আবেদিন পৃথী, সৌম্য শংকর বোস, সাগর ছেত্রি, শাহরিয়া শারমিন ও সরকার প্রতীকের শিল্পকর্ম। প্রদর্শনীটি কিউরেট করেছেন আলোকচিত্রী মুনেম ওয়াসিফ।

ছবি: শাহরিয়ার কবির হিমেল/স্টার

একেক শিল্পীর দেখার চোখ ভিন্ন, ভিন্ন তাদের প্রকাশ ভঙ্গি। পৃথীর কাজে যেমন অনেকটা কাব্যিক ভঙ্গিতে উঠে এসেছে এই সমাজের লৈঙ্গিক বৈষম্য ও বৈষম্যমূলক ভূমিকা। বিষণ্ণ কাব্য, ছবিগুলো সাদাকালো। কিন্তু ছবিতে আলোকিত অংশগুলো কালো, আর অন্ধকারগুলো সাদা। কল্পনা থেকে তৈরি ছবিগুলো কী বলে দেয় যে সমাজের অনেক কিছুই উল্টোপথে চলছে? হতে পারে, নাও পারে। অনুভূতির বিষয়টি দর্শকের একান্ত নিজস্ব।

বৈশ্বিক মহামারির মতো একটা অভূতপূর্ব দুর্যোগপূর্ণ সময়ে আমাদের অনুভূতিগুলোই বা কেমন থাকে? ৪ দেয়ালে আবদ্ধ থাকতে থাকতে আমরা কি নিজেদের অস্তিত্বকে প্রশ্ন করি? প্রশ্নবিদ্ধ হয় কি আমাদের চেনা পৃথিবী? মৃত্যুর মিছিল কি আমাদের অনুভূতিগুলোকে ভোঁতা করে দেয়? সরকার প্রতীকের কাজে এই এলোমেলো ভাবনা আর দ্বৈত অনুভূতিগুলো চলমান দৃশ্য হয়ে উঠতে চায়।

ছবি: শাহরিয়ার কবির হিমেল/স্টার

অতীত আর ভবিষ্যতের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করে বর্তমান। কিন্তু জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়ালে বা একান্ত কোনো প্রিয়জনকে হারিয়ে ফেললে সেই যোগাযোগটি কেমন হয়? যে চলে যায়, তাকে তো ফিরে পাওয়া যায় না। বর্তমানে দাঁড়িয়ে শুধু স্মৃতিগুলো ফিরে দেখা যায়। আর দেখা যায় ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা। শাহরিয়া শারমিনের ছবিতে মিলে মিশে যায় নস্টালজিয়া আর হারানোর বেদনা।

৭ জন শিল্পীর ৭টি ভিন্ন ভিন্ন কাজকে এ প্রদর্শনীতে একসূত্রে গেঁথেছেন কিউরেটর মুনেম ওয়াসিফ। কী সেই সূত্র? ওয়াসিফ বলেন, 'সূত্রটি সময়।'

ছবি: শাহরিয়ার কবির হিমেল/স্টার

তিনি একটি সময়ের কথা বলতে চেয়েছেন। যে সময়ে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক জীবন থেকে অনেক কিছু আমরা হারিয়ে ফেলি। হারানোর এই গভীর বেদনা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। শুধু তা 'মনের ভেতরে, স্মৃতির ভেতরে, জীবনের ভেতরে, চামড়ার ভেতরে দগদগে ঘা হয়ে বেঁচে থাকে।'

অনিশ্চিত সময় প্রভাবিত করে শিল্পীকেও। ৭টি ভিন্ন ফর্ম ও বিষয়বস্তু নিয়ে করা এই প্রত্যেকটি কাজে তাই একধরণের অনিশ্চয়তা আছে। এই সময়, আর সময়ের মধ্যে আটকে পড়া আমাদের মনস্তাত্ত্বিক স্তরকে ব্যবহার করে কিউরেটর ওয়াসিফ একটি অর্থ তৈরি করতে চান। তার ভাষায়, 'সবগুলো কাজ একসঙ্গে দেখার ফলে নতুন সম্পর্ক, বোধ, মাত্রা তৈরি হয়। একটা সময়কে নানান ভাবে দেখা যায়। এই নানান ভাবে দেখাটা আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। … এগুলোর মধ্যে যোগসূত্র সময়। এই সূত্র তৈরি করাটাই আমার কাজ।'

প্রদর্শনীতে (ডান দিক থেকে) খন্দকার তানভীর মুরাদ, শহিদুল আলম, সরকার প্রতীক, শাহরিয়া শারমিন, মুনেম ওয়াসিফ, এবং এএসএম রেজাউর রহমান। ছবি: শাহরিয়ার কবির হিমেল/স্টার

সৌম্য শংকর বোস ছবির পর ছবি সাজিয়ে ১৯৭৯ সালে মধ্য ভারতে নিম্নবর্গের বাঙালি গণহত্যার গল্প পুনর্নির্মাণ করেন, যে গণহত্যাটি কেউ দেখেনি, কিন্তু যার কথা মানুষ জানে।

প্রণবেশ দাশ টুকরো টুকরো ছবি, লেখা, আর স্মৃতি দিয়ে তুলে ধরেন ২০১৫ সালে অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের কথা।

ছবি: শাহরিয়ার কবির হিমেল/স্টার

আর সাগর ছেত্রি তার কাজে ব্যঙ্গ করেন নেপালের রাজনৈতিক চুক্তিগুলোকে, যেগুলো যুগের পর যুগ ধরে মানুষকে আশা দিয়ে বারবার নিরাশ করেছে।

সৌম্যর গল্পের ৪ দশক আগে ঘটে যাওয়া ওই গণহত্যা এখনও প্রাসঙ্গিক। কেননা অচেনা আর অস্থির এই সময়ে এখনও চলছে ক্ষয়, ধ্বংস আর মৃত্যুর উৎসব। কাতারে কাতারে মানুষ মরে আজও। মরে মহামারিতে, মরে সড়কে, মরে সহিংসতায়। খুন হয় মানবাধিকার, মুক্তচিন্তা। নিহত হয় নষ্ট রাজনৈতিক ব্যবস্থায় মানুষের বিশ্বাস। আর যারা মরেনি তারা বেঁচে থাকে এমন কিছু তীব্র অনুভূতি নিয়ে, যা দেখা যায় না, প্রকাশ করা যায় না। মাপা হাসির আড়ালে থাকে চাপা কান্না।

এই প্রদর্শনীটি  আগামীকাল শুক্রবার পর্যন্ত চলবে।

Comments

The Daily Star  | English

Tribunal-2 to be formed to expedite trial of Awami League: ICT Adviser

Alam did not elaborate on the specific legal amendments or timeline for the formation of the new tribunal

7m ago