গির্জার রাজ্য গোয়া

মে ড দেউস চার্চ। ছবি: ফাতিমা জাহান

ওল্ড গোয়া যাওয়ার জন্য তর সইছিল না। দ্বিতীয় দিনে চললাম সেই পথে। আমার রিসোর্টের পাশেই স্কুটি ও মোটরসাইকেল ভাড়া দেয়। একটা স্কুটি নিয়ে ছুটলাম। আজ ৮ বছর পর পুরনো স্থাপনাগুলো আবার দেখব। প্রায় ২৫ কিলোমিটার চলার পর পৌঁছলাম 'ব্যাসিলিকা অব বম জেসাস চার্চ' এ। গোয়ার খুব জনপ্রিয় ট্যুরিস্ট স্পট এটি। স্থানীয়দের কাছে অত্যন্ত পবিত্র গির্জা। কারণ এই গির্জায় সেইন্ট জেভিয়ারের দেহ রাখা আছে।

ধর্মযাজক সেইন্ট জেভিয়ার মারা যান ১৫৫২ সালে। প্রথমে তাকে সমাধিস্থ করা হয় চীনের তাইশানে। এরপর তার মরদেহ নেওয়া হয় মালয়েশিয়ার মালাক্কায়। সবশেষে ভারতের গোয়ায়। বলা হয়, তার দেহ কোনো ধরনের কেমিকেল ছাড়াই এখনও অক্ষত অবস্থায় আছে। অলৌকিক শক্তির কারণেই নাকি এমনটা হয়েছে।

ব্যাসিলিকা অব বম জেসাস চার্চ। ছবি: ফাতিমা জাহান

বাইরে থেকে গির্জা দেখে মনে হলো কত কাল যেন এখানে কেউ আসেনি। ১৬০৫ সালের এই গির্জার লাল দেয়ালে কিছু ক্ষত স্থান করে নিয়েছে। সেই ফোকরে জন্মেছে আগাছা। আগাছাও যে ভবনের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিতে পারে তা কে জানত!

এখন গির্জায় কেউ নেই। ভেতরে দুপাশে সারি সারি বেঞ্চের শেষ মাথায় জমকালো মঞ্চ। মঞ্চের পেছনের দেয়াল পুরোটাই স্বর্ণ দিয়ে গিল্ড করা, কারুকাজে সজ্জিত। ছবি তোলা নিষেধ হওয়ায় এই জাদুর কারুকাজ মনে গেঁথে নেওয়া ছাড়া অন্য উপায় নেই। কোথাও শিশু দেবতা উড়ে বেড়াচ্ছে, কোথাও পঞ্চদশ শতাব্দীর লতাপাতার নকশা, কোথাও দেবতা পাখায় ভর করে উড়ে না গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অবিচল। এই স্বর্ণের স্বর্গসম দেয়াল এখনো পাহারা দেয় গির্জাকে। রোমান ক্যাথলিক গির্জার সব ভাবগাম্ভীর্য বজায় আছে এখানে। সেইন্ট জেভিয়ারের দেহ রাখা আছে মঞ্চের পাশের দেয়ালে, একটু উঁচু বারান্দা মতোন জায়গায়। সে বারান্দাও স্বর্ণে মোড়ানো। তার কফিনটি রূপায় বাঁধানো, কারুকাজে ঐশ্বর্যমণ্ডিত। প্রতি ১০ বছরে একবার তার দেহ জনগণকে দেখানো হয় ফিস্টের সময়। শেষবার দেখানো হয়েছিল ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে।

গির্জার অন্দরমহলের রাজকীয়তা বাইরে থেকে একটুও বোঝার উপায় নেই। এর উল্টো পাশে মিউজিয়াম আর চার্চ। মূল ফটক থেকে অনেকখানি হেঁটে তবেই পা রাখা যায় সে ক্যাথিড্রালের দোরগোড়ায়। মাঝে বিশাল বাগান।

ভারতে পর্তুগালের গভর্নর আফোনসো দা আলবুকারক গোয়া জয়ের খুশিতে গির্জাটি নির্মাণ করা হয়। নির্মাণে সময় লাগে প্রায় ৫৭ বছর। শেষ পর্যন্ত ১৬১৯ সালে এটি গির্জার সম্পূর্ণ রূপ ধারণ করে। গির্জার বাইরের দিকে টাসকান এবং পর্তুগীজ স্থাপত্যকলা অনুসরণ করা হয়েছে। এর ভেতরের অংশে প্রায় মিল আছে ব্যাসিলিকা অব বম জেসাসের। এই গির্জার বাইরে যে ঘণ্টা আছে তা ভারতের সবচেয়ে বড় গির্জার ঘণ্টা হিসেবে গণ্য করা হয়।

যেই না গির্জা থেকে বের হলাম অমনি এক পশলা বৃষ্টি। বিশাল গির্জা প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়েও নদীর গন্ধ পাচ্ছি। কাছেই মান্ডোভি নদী। জলে ছায়া দেখার আশায় বুঝি ধরণী দেবতা এই ভূখণ্ড তৈরি করেছিলেন নিজ হাতে। যেদিকেই তাকাই না কেন শুধু জল আর জল। সবখানেই জলে নিজের ছায়া দেখতে পাওয়া যায়, নিজের ছায়া দেখতে কে না ভালোবাসে! আমি তো সে ছায়া দেখতেই বারে বারে আসি।

বৃষ্টি কমতেই স্কুটি নিয়ে চললাম পাহাড়ের চূড়ায়। সেখানে রয়েছে গোয়া রাজ্যের সবচেয়ে পুরনো গির্জা 'চ্যাপেল অব আওয়ার লেডি অব দা মাউন্ট'। পাহাড় পুরো সবুজে সয়লাব, নির্জন, নির্ভার। আমি কখনো কোনো নগরে প্রকৃতিকে এতো কাছ থেকে দেখিনি। সবখানে সবসময়ই নাগরিক কায়দা-কানুনে ঠাসা ছিল। গাঢ়, ঘন সবুজ পাহাড়ের চূড়ায় একটা ছোট্ট সাদা গির্জা। আস্তে আস্তে চূড়ায় উঠি, চারপাশ ঘুরে দেখি। দোচালা টিনের দোতলা ঘরের আকারের ট্যালি দেওয়া ছাদের গির্জার সদর দরজায় ঝুলছে মস্ত এক তালা।

চ্যাপেল অব আওয়ার লেডি অব দা মাউন্ট। ছবি: ফাতিমা জাহান

১৫১০ সালে ভারতের পর্তুগীজ গভর্নর আলফোসো দি বুকারকের গোয়া জয়ের খুশিতে এই গির্জাটি নির্মিত হয়। তখন থেকেই এই গির্জা লোকচক্ষুর অন্তরালেই থেকে যায়। ট্যুরিস্ট একেবারেই আসে না। পাহাড়ের ওপর মান্ডোভি নদীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এই গাছপালার মাঝে দিন কাটানো চ্যাপেল সারাদিন কথা বলে নদীর সঙ্গে।

এই চত্বরের সবচেয়ে মনকাড়া জায়গা হলো পাহাড়ের এক কোনায় নিচু দেয়াল। এখানে দেয়ালে বসে পুরনো গোয়ার প্রায় পুরোটাই দেখা যায়। এই জায়গাটা জন বিবর্জিত না হলে অবশ্যই চা বা কফি নিয়ে বসা যেত।

আবার বৃষ্টি। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে চললাম আমার প্রিয় জায়গা এইটিনথ জুন স্ট্রিটের দিকে। এই রাস্তাটা আমার খুব প্রিয়। এর শেষ মাথায় বিখ্যাত গির্জা 'আওয়ার লেডি অব ইমাকুলেট কনসেপশন চার্চ', ধবধবে সাদা। দূর থেকেই এর স্থাপত্যশিল্প মুগ্ধ করে।

এমনিতে মানুষ গোয়া বেড়াতে আসে সমুদ্র সৈকত দেখতে, শপিং করতে আর গলা পর্যন্ত মদিরা পান করতে। সমুদ্রবন্দর আছে বলে অনেক জিনিস এখানে সস্তায় পাওয়া যায়। শপিং বা মদিরা কোনোটাই আমার প্রিয় নয়। আমি সাগর দেখি, জীবন্ত পাহাড় দেখি আর পুরনো স্থাপনা দেখি।

আওয়ার লেডি অব ইমাকুলেট কনসেপশন চার্চ। ছবি: ফাতিমা জাহান

১৫৪১ সালে পানজিম ছিল জেলেদের ছোট্ট একটা গ্রাম। সেই সময় এই গির্জাটি ছিল চ্যাপেল বা প্রার্থনা ঘর। পাশেই সমুদ্রবন্দর আর পর্তুগীজ নাবিকদের জাহাজ এ বন্দরে ভিড়ত৷ পানজিম একসময় হয়ে যায় গোয়া রাজ্যের রাজধানী। পর্তুগীজ শাসনামলে গোয়ার অন্যতম সুদর্শন গির্জা হয়ে ওঠে এটি। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয় গির্জার দিকে যেতে। সে সিঁড়িতেও মনোহর নকশা করা। ৩ তলার প্রতি তলায় ঘুরে ঘুরে জিকজ্যাক সিঁড়ি আর ওপেন টেরেস, তারপর মূল গির্জা। সেখানে দ্বাররক্ষী বললেন, এখন শুধু ২ বার গির্জা খোলা হয় করোনা মহামারির কারণে। ৩ তলার টেরেসে এইটিনথ জুন স্ট্রিটের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছেন ভার্জিন মেরি। সমস্ত চরাচর উপাসনার মতো নিস্তব্ধ হয়ে আছে, যেন উপাসনায় মগ্ন। বাইরে রোদ উঠেছে, কিন্তু এই রোদ, এই শহর একটুও বিরক্ত করতে পারছে না।

ধীরে ধীরে নেমে চলে গেলাম আমার প্রিয় রেস্তোরাঁয় মাছ খেতে। সাধারণত থালি অর্ডার করলে মাছের অনেকগুলো আইটেম চেখে দেখা যায়। আমার এক ইউরোপীয় বন্ধু বলেছিল, 'এই থালি জিনিসটা মজার। ছোট ছোট বাটিতে হলুদ থেকে লাল অনেকগুলো স্যুপ থাকে, কোনটা কি বোঝার উপায় নেই। মিষ্টি, ঝাল, কারি সব পাশাপাশি আর রঙও কাছাকাছি, কি যে এক ধাঁধাঁ।'

খাওয়া শেষে চললাম মিরামার বীচ দেখতে। মিরামারের বৈশিষ্ট্য হলো—সারি সারি ঝাউ বন থেকে দূরের সমুদ্র দেখা যায়। কেমন যেন একটা লুকোচুরি খেলা।

সমুদ্র যেন আগের চেয়েও নীল হয়ে আছে৷ আগে ট্যুরিস্টদের জন্য সমুদ্র সৈকত ফাকা থাকত না। এখন কেউ নেই। সাগরও তাই নিজের রূপ খেলিয়ে যাচ্ছে৷

এখান থেকে চলে যাওয়া যায় আঞ্জুনা বীচের দিকে। আমার প্রিয় বীচ। প্রথম যেবার আসি তখন আঞ্জুনা বীচ এমন বিখ্যাত হয়ে ওঠেনি। এটা ছিল জেলেদের মাছ ধরার এক নিরিবিলি সৈকত। কীভাবে যেন ট্যুরিস্টরা টের পেয়ে একে রমরমা করে তুলেছে৷ এই বীচের সামনে গড়ে উঠেছে বিশাল ফ্লি মার্কেট বা অস্থায়ী বাজার। ঢাকার গাউসিয়া বা নিউমার্কেটের সমান বড় তো হবেই।

এখন সৈকতের পুরোটাই কয়েকটা রিসোর্ট নিয়ে নিয়েছে। সবগুলো প্রাইভেট বীচ হয়ে গেছে। ট্যুরিস্ট না থাকায় আমার মতো ভবঘুরে লোকজন ঘুরতে পারে এই শূন্য সৈকতে। বসে পড়লাম এক জায়গায়। আজ সূর্যাস্ত দেখে তবেই ফিরব।

প্রথম পর্ব: গোয়া: ভারতের বুকেই যেন ছোট্ট এক পর্তুগাল

(চলবে)

Comments

The Daily Star  | English

Public admin reforms: Cluster system may be proposed for ministries

The Public Administration Reform Commission is likely to recommend reducing the number of ministries and divisions to 30 from 55 to improve coordination and slash the government’s operational cost.

8h ago