বদরুদ্দীন উমর: গণস্বার্থের অদম্য বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক সংগঠক

বদরুদ্দীন উমর। ছবি: সংগৃহীত

বর্ধমান জেলার এক স্কুলে ১৯৪৪ সালে একটি ছোট ঘটনা ঘটেছিল। শ্রেণীকক্ষে সপ্তম শ্রেণীর এক শিক্ষার্থীকে বকছিলেন তার শিক্ষক। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, সে আগের দিন সন্ধ্যায় শ্রেণীকক্ষের সব বড় বেঞ্চগুলোকে ছোট বেঞ্চগুলোর সঙ্গে ঠেস দিয়ে রেখেছে। তখন একজন রোগা ও লম্বা গড়নের ছেলে দাঁড়িয়ে উঠে বললো, 'এটা অবন্তী করেনি। আমি করেছি।' ছেলেটির নৈতিক সাহসের পরিচয় পেয়ে শিক্ষক তাকে ক্ষমা করে দিলেন।

গত ২০ ডিসেম্বর ছিল সেই ছেলেটির ৯০তম জন্মদিন। তিনি বর্তমানে বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক ও চর্চাবিদ বদরুদ্দীন উমর। একাধারে একজন শিক্ষক, বিদ্বান, সম্পাদক ও রাজনৈতিক কর্মী এই মানুষটি। উমর তার পুরো জীবন উৎসর্গ করেছেন একটি ন্যায়পরায়ণ সমাজ গঠনের প্রচেষ্টায়। এই অন্বেষণেই তিনি একটি 'স্থিতিশীল জীবন'-এর স্বাচ্ছন্দ্য এড়িয়ে পড়াশোনা, গবেষণা, লেখালেখি এবং একটি অন্যায্য সমাজ রূপান্তরের সংগ্রামে অংশগ্রহণের জন্য অন্যদেরকে সংগঠিত ও সমবেত করার এক কঠিন যাত্রা শুরু করেছিলেন। স্মৃতিচারণায় উমর জানিয়েছেন, 'মানুষের কষ্ট, দুর্দশা, শোষণ ও দারিদ্র্য আমাকে ভাবিয়েছিল, কীভাবে আমরা এ ধরনের পরিস্থিতির ব্যাখ্যা দিতে পারি? আমার পড়াশোনা আমাকে এ ধরনের বিষয়গুলো বোঝার ক্ষমতাকে আরও তীক্ষ্ণ করেছে।'

'দরিদ্র মানুষের মুক্তি শুধুমাত্র সংগঠিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই সম্ভব।' উপসংহার টেনে তিনি বলেন, 'আমাদের কাছে এটাই তাদেরকে মুক্ত করার একমাত্র পথ।' এই প্রত্যয়ই উমরের জীবন-দর্শনের নোঙর হিসেবে কাজ করেছে।

(বাম থেকে ডানে) অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, বদরুদ্দীন উমর, আনু মুহাম্মদ এবং আখতুরুজ্জামান ইলিয়াস। ছবি: সংগৃহীত

তার পাণ্ডিত্য ও জ্ঞানের মূল বৈশিষ্ট্য হলো বিষয়বস্তুর প্রতি আবেগতাড়িত না হয়ে কোনো কিছুকে বিশ্লেষণ করার অনন্য সক্ষমতা। প্রাধান্য বিস্তারকারী আলোচনা ও বয়ানগুলো ভারতকে ভাগ করার জন্য জিন্নাহ ও মুসলিম লীগকে দায়ী করলেও, সেসবের বিপরীতে উমর যুক্তি দেন, 'হিন্দু মেলা' দ্বিজাতি তত্ত্বর মূল হোতা হিসেবে কাজ করেছে আর সেই তত্ত্বকে সমর্থন পেয়েছে কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভার কাছ থেকে। 'কংগ্রেস থেকে বিজেপি' শিরোনামে তার একটি সাম্প্রতিক প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, গান্ধী, নেহেরু ও প্যাটেলের পৃষ্ঠপোষকতা প্রাপ্ত দ্বিজাতি তত্ত্ব ছিল 'আক্রমণাত্মক' এবং জিন্নাহ সমর্থিত তত্ত্বটি ছিল 'রক্ষণাত্মক'। এ কথার সঙ্গে সঙ্গে তিনি লিখেছেন, সাধারণ হিন্দুরা দেশ বিভাজন চাননি। অভিমত ব্যক্ত করে উমর বলেছেন, বঙ্গভঙ্গ রদ না হলে এর ফলে হয়তো একটি শক্তিশালী, আলোকিত ও স্থিতিশীল মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণী বিকশিত হয়ে উঠতো;  ব্যবস্থাটি উল্টে যাওয়ায় মুসলিমদের বিকাশ ঘটার বিষয়টি ব্যর্থ হয়ে যায়।

পাকিস্তান রাষ্ট্রের ইসলামীকরণের উদ্যোগের মুখে যখন বাঙালি মুসলমান তাদের আত্মপরিচয় নিয়ে দ্বন্দ্বে ব্যস্ত, তখন উমরের গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থত্রয়ী; 'সাম্প্রদায়িকতা', 'সংস্কৃতির সংকট' ও 'সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা' পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দেয় বাঙালি হওয়া ও মুসলমান হওয়ার মধ্যে বিতর্কটি সম্পূর্ণ বানোয়াট এবং এটি ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার একটি কৌশল ছাড়া আর কিছুই না। উমরের জ্ঞানের পরিধির গভীরতায় একজন বিশ্লেষক এমন সিদ্ধান্তে আসেন, 'বাংলাদেশের বিগত ১৫০ বছরের রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যাকরণ বুঝতে উমর অত্যাবশ্যক' (ফারুক ওয়াসিফ, প্রথম আলো, ২০ ডিসেম্বর ২০২১)।

এ প্রবন্ধগুলোর চেয়ে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস বিষয়ে উমরের ৩ খণ্ডের বিশ্লেষণী লেখার গুরুত্ব কোনো অংশে কম নয়। ইতিহাসকে ব্যাখ্যা করার প্রধানতম ধারার বিপরীতে গিয়ে শ্রমিক, কৃষক ও সাধারণ মানুষের কাছ থেকে শোনা গল্প ও তাদের অভিজ্ঞতার বর্ণনাকে ধৈর্য, দক্ষতা ও স্পষ্টতার সঙ্গে তুলে ধরে তিনি একটি প্রতি-বয়ান হাজির করেছেন। এর মাধ্যমে তিনি ঢাকাভিত্তিক মধ্যবিত্তদের সঙ্গে প্রান্তে বসবাসকারী অন্যান্য মানুষের মধ্যে শ্রেণী সম্পর্কের দিকগুলোকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। ১২০টি বইয়ের লেখক হিসেবে উমরের পাণ্ডিত্যের শক্তি বোঝা যায় বিস্তৃত বিষয়াদি সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খ দেখা, তার ওপর কর্তৃত্ব ও সেগুলোকে সংশ্লেষণ করার অসাধারণ ক্ষমতার মধ্যে।

একজন স্বীকৃত কমিউনিস্ট হওয়া সত্ত্বেও উমর ভারত ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের তীব্র সমালোচনা করেছেন। তিনি মনে করেন, বুর্জোয়াদের আধিপত্যের বিপরীতে শ্রমিক শ্রেণীর মানুষের জন্য বিকল্প নেতৃত্ব দেওয়ার পরিবর্তে উভয় দেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপি) হাস্যকরভাবে নিজেদেরকে 'মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগী সংগঠনের' পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে। পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) কর্তৃক ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী আর আওয়ামী লীগের সমান্তরাল টানার বিষয়টিকে (তাকে 'দুই কুকুরের লড়াই' বলা) উমর 'ধ্বংসাত্মক' বলে বর্ণনা করেন। বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধাচরণের গভীরতা বুঝতে না পারার কারণেই মূলত কমিউনিস্ট পার্টি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। যখন সমগ্র জাতি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যার বিরুদ্ধে সংগ্রামে ফুঁসছে, তখন কমিউনিস্ট পার্টির শ্রেণী সংগ্রাম নিয়ে ব্যস্ত থাকাকে উমর 'বোকামি ও অজ্ঞানতা' হিসেবে অভিহিত করেন। চীনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ঝৌ এন লাইয়ের 'পাকিস্তানের একতা ধরে রাখার' আহ্বানের ওপর নির্ভর করে কৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে পরিষ্কার হয় দলটি বাইরের পৃষ্ঠপোষকের ওপর নির্লজ্জভাবে নির্ভরশীল ছিল। তখন থেকেই উমর বেইজিংপন্থী ও মস্কোপন্থী, উভয় ধরনের কমিউনিস্টদের একজন কড়া সমালোচক হিসেবে নিজের অবস্থানকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তিনি এমনকি এটাও বলেছেন, বাংলাদেশের কোনো দল আদতে 'কমিউনিস্ট' হিসেবে নিজেদেরকে দাবি করার যোগ্য নয়।

সমাজতন্ত্রের সংকট নিয়ে বলতে গিয়ে উমর যুক্তি দেন, সোভিয়েত ধরনের সমাজতন্ত্রর পরীক্ষানিরীক্ষা লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ার মূল কারণ ছিল তার সরকারের পতন ঘটানোর জন্য বাইরের শক্তির নিরন্তর আগ্রাসন। তার মতে, নিজেদের ব্যবস্থার সামরিকায়ন, আমলাতান্ত্রিককরণ ও গোয়েন্দা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার ওপর বিশেষ জোর দেওয়া ছাড়া স্ট্যালিনের হাতে আর তেমন কোনো বিকল্প ছিল না এবং এ কার্যক্রমগুলো চালিয়ে যেতে তাকে বিপুল পরিমাণ সম্পদ ব্যয় করতে হয়। উমর স্বীকার করেন, সোভিয়েত সমাজতন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে, তবে একইসঙ্গে তিনি জোর দিয়ে বলতে চান পুঁজিবাদও পেছনে হটছে। তিনি উল্লেখ করেন, 'সমাজতন্ত্রের আদৌ কোনো ভবিষ্যৎ আছে কি না, এ প্রশ্ন যদি কেউ তোলে, তাহলে এর বিপরীতে প্রশ্ন করতে হবে পুঁজিবাদেরও কোনো ভবিষ্যৎ আছে কি না।'

উমরের অদম্য বুদ্ধিবৃত্তিক দক্ষতা তাকে তার সমসাময়িকদের সঙ্গে বিতর্কে জড়ানোর সক্ষমতা দিয়েছিল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সময় প্রকাশিত উমরের সাম্প্রদায়িকতা বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধটি সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেনকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। উমর তার লেখায় সাজ্জাদের যুক্তিগুলোকে তীব্রভাবে প্রত্যাখ্যান করেন এবং এর মাধ্যমেই তার বিতর্কমূলক লেখালেখির সূত্রপাত হয়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে বিতর্ক করাকে উৎসাহিত করা দূরে থাক, গুরুতর বিতর্কের জন্য সীমিত সুযোগ দানকারী বিদ্যায়তনিক ও রাজনৈতিক পরিবেশের মধ্যে  কোনো ধরনের পর্যালোচনা ছাড়া প্রাধান্যকারী আলোচনাগুলোকে মেনে নিতে উমরের অস্বীকৃতি এবং যেকোনো বাস্তবতার নেপথ্যের প্রকৃত ও অন্তর্নিহিত কারণগুলোকে সবার সামনে তুলে ধরার প্রবল তাড়না তাকে একজন রাজনৈতিক পর্যালোচনাকারীর খ্যাতি দান করে; যা বাংলাদেশের বিদ্যায়তনিক ও রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বিরল। তার পাণ্ডিত্যচর্চার সর্বক্ষেত্রে একনিষ্ঠ দৃঢ়তার সঙ্গে উমর এই বৈশিষ্ট্যটি বজায় রেখেছেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নিয়ে অশোক রুদ্রের সঙ্গে এবং দুর্ভিক্ষ ও স্বাধীন গণমাধ্যমের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে অমর্ত্য সেনের সঙ্গে তার বিতর্ক এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য দুটি নিদর্শন।

ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর প্রতি নিপীড়ন ও অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে উমর কখনো কোনো কুণ্ঠিত হননি। টনকিন উপসাগরের ঘটনার পর ১৯৬৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনামের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের উদ্যোগ বাড়ালে তিনি প্রায় এককভাবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৮০ জন শিক্ষকের পক্ষ থেকে একটি বিবৃতি দেওয়ার উদ্যোগ নেন। বিবৃতিতে ভিয়েতনামে মার্কিন আগ্রাসন ও বেসামরিক মানুষ হত্যার নিন্দা জানানো হয়। এটাই সম্ভবত বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ। নৈতিক কারণে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের একটি তিন মাসের ফেলোশিপও প্রত্যাখ্যান করেন।

উমর অটলভাবে জাতিগত ও ভাষাগত সংখ্যালঘুদের অধিকার খর্ব করার সকল প্রচেষ্টার বিরোধিতা করেছেন। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন সরকারের সামরিকীকরণ ও জনসংখ্যাগত কারসাজির প্রচেষ্টা এবং কল্পনা চাকমাসহ পাহাড়ি এলাকার রাজনৈতিক কর্মীদের অপহরণের প্রতিবাদ করেন। মূলধারার বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা দেশের বিভিন্ন ক্যাম্পে আটকে পড়া উর্দুভাষী সম্প্রদায়ের প্রতি ব্যবহার আর তাদের জাতীয়তা পরিস্থিতি নিয়ে নীরব থাকলেও উমর ছিলেন স্বল্প কজন বুদ্ধিজীবীর অংশ, যিনি তার বিভিন্ন লেখালেখিতে দ্বারা এবং জাতি ও ভাষাগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর মানুষদেরকে সংগঠিত করে ২০১১ সালে জাতিসত্তা মুক্তি সংগ্রাম পরিষদ গঠনে সহায়তা করে তাদেরকে সংগঠিত করেন। ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার জন্য সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগের উদ্দেশ্যে তিনি ১৯৯২ সালে জাহানারা ইমামের সঙ্গে মিলে গণআদালতের আয়োজন করেন।

মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে উমর ছোট ও বড়র মধ্যে কোনো পার্থক্য করতেন না। ২০০৭-২০০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সামরিক বাহিনীর ভূমিকার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ আন্দোলনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩ জন তরুণ শিক্ষক একাত্মতা প্রকাশ করলে তাদেরকে কারারুদ্ধ করা হয়। সে সময় বেশিরভাগ মানুষ এমনকি ফিসফিস করেও প্রতিবাদী সুরে কথা বলতে ভয় পেতেন। কিন্তু উমর তার কলমের মাধ্যমে ৩ শিক্ষকের তাৎক্ষণিক মুক্তির দাবি জানান। তিনিই সম্ভবত একমাত্র ব্যক্তি যিনি প্রকাশ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আকমল হোসেনের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, যখন আকমল হোসেন ২০১৮ সালে একটি ছাত্র সমাবেশে অভিমত ব্যক্ত করার কারণে বিশেষ রাজনৈতিক মহলের দ্বারা হুমকি ও হয়রানির শিকার হয়েছিলেন।

খুব সম্ভবত উমরের অর্জনের মধ্যে সবচেয়ে উপেক্ষিত অংশটুকু হচ্ছে ৭০ এর দশকের প্রথম দিকে রাষ্ট্রে ক্রমশ বিস্তৃত হতে থাকা স্বৈরাচারী প্রবণতা ও নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের ধারাবাহিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য দেশের বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের জ্যেষ্ঠ সদস্যদের একটি মঞ্চের আওতায় একতাবদ্ধ করার বিষয়টি। সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনী সংসদকে (নাগরিকদের জন্য প্রয়োজনীয় সুরক্ষার ব্যবস্থা ছাড়াই) নিরোধমূলক আটকের বিধান তৈরির ক্ষমতা দেয়। পরবর্তীতে, বিশেষ ক্ষমতা আইন (১৯৭৪) প্রণয়ন করা এবং তা প্রয়োগের মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের (বিশেষ করে যারা বামপন্থী) আটক, জাতীয় রক্ষী বাহিনীর (জেআরবি) ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে সার্বিকভাবে নির্যাতন, আটক ও বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের প্রবণতা দেখা দিলে এ ধরনের তৎপরতার বিরোধিতা আবশ্যিক হয়ে পড়ে। উমর এবং কবি সিকান্দার আবু জাফরের উদ্যোগে ১৯৭৪ সালের ৩ মার্চ জাতীয় প্রেসক্লাবে মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ ও আইন সাহায্য কমিটি (সিসিএলএলএ) গঠিত হয়। অন্যদের মধ্যে অধ্যাপক আহমদ শরীফ, আইনজ্ঞ হাবিবুর রহমান শেলি, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ, এনায়েতুল্লাহ খান ও আহমদ ছফা বৈঠকে যোগ দিয়েছিলেন। কার্যক্রম শুরুর অল্পদিন পরে সংবিধানে নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে এমন মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো উন্মোচন করতে শুরু করে সিসিএলএলএ। কমিটির অন্যতম প্রধান কার্যক্রম ছিল এ ধরনের ঘটনার ভুক্তভোগী ব্যক্তিদের আইনি সহায়তা দেওয়া, যাতে তারা উচ্চ আদালতের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সুরক্ষা পান। কমিটির সাড়া জাগানো একটি মামলায় রক্ষী বাহিনীর জিম্মায় থাকা অবস্থায় ধর্ষণসহ নির্মম নির্যাতনের শিকার কমিউনিস্ট নেত্রী অরুণা সেন ও তার ২ সহযোগীকে মুক্ত করে সিসিএলএলএ (সংস্কৃতি, মে-জুন ১৯৭৪)। শাহজাহানের গুম হওয়া সংক্রান্ত সিসিএলএলএর সহযোগিতায় করা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মামলায় (মহসীন শরীফ বনাম রাষ্ট্র, ১৯৭৪) আদালত 'খুবই অসন্তোষজনক অবস্থান' পর্যবেক্ষণ করে দেখতে পান 'বাহিনীর নির্দেশনা হিসেবে কাজ করতে পারে এরকম কোনো আইন প্রণয়ন করা হয়নি।' আদালত আরও মন্তব্য করেন, 'একটি গণতান্ত্রিক সমাজে দেশের একজন নাগরিকের জীবন অথবা তার স্বাধীনতার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ' এবং জেআরবিসহ সকল নিরাপত্তা বাহিনীকে 'সংবিধান ও সাধারণ আইন মোতাবেক সবার মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য দেশের প্রচলিত আইন মেনে ও বেসামরিক কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী তাদেরকে কাজ করতে হবে' (২৭ ঢাকা ল রিপোর্ট ১৯৭৫)।

১৯৭৪ সালে একই সহযোগীদের সক্রিয় অংশগ্রহণে বদরুদ্দীন উমর একটি মন্বন্তর প্রতিরোধ কমিটি (এফআরসি) গঠন করেন ভুক্তভোগীদের জন্য লঙ্গরখানা, নগদ অর্থ সহায়তা ও চাকরির দাবি জানাতে। এফআরসি বায়তুল মোকাররম মসজিদের সামনে সে সময়ের খোলা জায়গায় বেশ কিছু জনসমাবেশ করে। এভাবেই তিনি কিছু বিবেকবান নাগরিককে সঙ্গে নিয়ে প্রথমবারের মতো নাগরিক অধিকার খর্ব হওয়ার কারণে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। স্বাধীন বাংলাদেশে মৌলিক অধিকার রক্ষা এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য বাইরের কোনো শক্তির সমর্থন ছাড়া এটিই ছিল প্রথম দেশীয় প্রচেষ্টা।

রাজনীতিতে পুরোদমে যোগ দেওয়ার জন্য বদরুদ্দীন উমর ১৯৬৮ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পদ থেকে ইস্তফা দেন। মানুষের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষার উদ্দেশ্যের কথা ভেবে তিনি তাদের দৈনন্দিন জীবন সংগ্রামের সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করেন। শিগগির তিনি একজন উদ্যমী পর্যটকের মতো দেশের প্রতিটি আনাচেকানাচে ঘুরে বেড়াতে শুরু করেন। সুনামগঞ্জ থেকে সাতক্ষীরা, ঠাকুরগাঁও থেকে টেকনাফ—সবখানেই গিয়েছেন তিনি।

এক দশক আগে পর্যন্ত তিনি কখনোই কোনো সাংগঠনিক সফরে যাওয়ার সুযোগ নষ্ট করেননি। কখনো স্টিমার বা লঞ্চের ডেকে, বাসে, টেম্পোতে অথবা ভ্যানে চড়ে, কড়া রোদ ও বৃষ্টিকে অগ্রাহ্য করে তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন। খুলনার বটিয়াঘাটা অঞ্চলের এক সফরে আমি তার সঙ্গী হয়েছিলাম। একবার আমাদের ২ জনকে কৃষক ফেডারেশনের একজন নিম্নবর্ণের হিন্দু ধর্মাবলম্বী সদস্যের খড়ের তৈরি ঘরের বারান্দায় ঘুমাতে দেওয়া হয়েছিল। পরের দিন আমি যখন সকাল সকাল ঘুম থেকে জেগে অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাগ্রহণ করা, মোজার্ট-প্রেমী সাবেক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক উমর গভীর ঘুমে আছেন এবং তার পাশে ঘুমিয়ে আছে ওই বাড়ির মালিকের পোষা কুকুর। একই সফরে আমরা একজন সাপুড়ের বাসায় থেকেছিলাম। সে সময় আমাদের একজন সঙ্গী কালু সাহার গায়ের ওপর দিয়ে সাপ চলে যায়। শিগগির সাপটি ধরে ফেলা হয় এবং পরবর্তীতে জানা যায়, সেটি বিষধর সাপ ছিল। এই ঘটনাগুলো থেকে বোঝা যায়, বদরুদ্দীন উমর মানুষের যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য কতটুকু অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলেন। এ ঘটনাগুলো একই সঙ্গে একজন মানুষের নিজেকে শ্রেণীচ্যুত হবার সচেতন প্রচেষ্টা হিসেবে বিবেচনা করা যায়, যেটি এ দেশের অন্য কোনো গণস্বার্থের বুদ্ধিজীবী কখনোই চেষ্টা করেননি।

রাজনৈতিক জীবনের পুরোটা সময় জুড়ে বদরুদ্দীন উমর সময়ে সময়ে কর্মশালা ও ক্লাসের আয়োজন করে তরুণ, শ্রমিক, কৃষক ও রাজনৈতিক কর্মীদেরকে গড়ে তোলার ওপর জোর দিয়েছেন। ১৯৮৩ সালে কুষ্টিয়ার শিলাইদহে অবস্থিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়িতে আয়োজিত ৫ দিনের এক কর্মশালার কথা স্মরণ আছে; যেখানে কৃষক, শ্রমিক ও তরুণ নেতারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা বক্তৃতা দেন এবং সারা দেশ থেকে আসা তৃণমূল কর্মীদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। উপস্থিত নেতাদের মধ্যে ছিলেন বদরুদ্দীন উমর, ডাক্তার সইফ উদ দাহার, হাসান আলী মোল্লা, আতিয়ার রহমান, শাহ আতিউল ইসলাম, ফরিদ আহমেদ, আনু মুহাম্মদ ও সি আর আবরার।

এ ধরনের আয়োজনগুলো নানা ধরনের অবস্থা ও অভিজ্ঞতা থেকে আসা  তরুণদেরকে সমাজের মানুষরা যে আর্থ-সামাজিক বাস্তবতার মুখোমুখি হন, তা উপলব্ধি করা ও সেসব সমস্যাকে উত্তরণের পন্থা নিয়ে ভাবার সুযোগ করে দিয়েছিল। প্রাজ্ঞতায় অভিজ্ঞ ও তরুণদের মধ্যে চিন্তাভাবনা ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ের সেই পরিবেশের মাধ্যমে রবি ঠাকুরের কুঠিবাড়ি সেই  কয়েকটি দিনে প্রাণশক্তি আর উৎসাহ উদ্দীপনার কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়েছিল। সেই সময়ে তার বন্ধুদের কাজ ও পন্থার বিপরীতে, বদরুদ্দীন উমর ও তার সহযোগীরা তাদের সংগঠনে যুক্ত হওয়া কর্মীদের বিশ্লেষণী ক্ষমতাকে শাণিত করার জন্য এমন সব প্রচেষ্টা নিয়েছিলেন, বিষয়গুলোকে কেউ এভাবে সারসংক্ষেপ করলে তাতে মোটেও ভুল করবেন না।

বদরুদ্দীন উমর কখনো পুরষ্কার ও প্রশংসার পরোয়া করেননি। তিনি মনে করতেন, প্রতিটি পুরষ্কারের জন্যই মূল্য দিতে হয়। একই সঙ্গে তিনি এটা বুঝতে পারেন না যে যখন একজন লেখক নিজের মনের আনন্দের জন্যই লিখছেন, তখন কেন লেখক তার লেখার জন্য পুরস্কার পাবেন। এই চিন্তাধারা থেকেই তিনি সবার আরাধ্য বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও একুশে পদক, আদমজী সাহিত্য পুরস্কার, ইতিহাস কাউন্সিল ও ফিলিপ্স পুরস্কার গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। একইভাবে, বড় উচ্চ পদে আসীন হওয়াও কখনো তার কাছে আকর্ষণীয় ছিল না। রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার পর সম্ভবত সেই সময়কার শীর্ষ নেতা, মাওলানা ভাসানী, তাকে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) সাধারণ সম্পাদকের পদে যোগ দেবার প্রস্তাব করেন। বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই যে, উমর সে প্রস্তাবে রাজি হননি।

জীবনকে প্রভাবিত করে এমন গুরুতর বিষয় সম্পর্কে পাঠকদের অবহিত করতে রাজনৈতিক প্রকাশনার গুরুত্ব বদরুদ্দীন উমর মূল্য দিয়ে থাকেন। এই অনুধাবন থেকে তিনি ৭০য়ের দশকে সাপ্তাহিক 'গণশক্তি' এবং মধ্য ৭০ এ 'সংস্কৃতি' নামের মাসিক পত্রিকা (বর্তমানে পত্রিকাটি ৪৭ বছর অতিক্রম করছে) সম্পাদনার গুরুদায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন। তিনি একইসঙ্গে ৮০র দশকের শুরুর দিকে 'নয়া পদধ্বনি' প্রকাশের মূল দায়িত্বও পালন করেন।

সাম্প্রতিক একটি সাক্ষাৎকারে বদরুদ্দীন উমর দুটি দুঃখের কথা জানিয়েছেন। প্রথমত, শ্রমিক শ্রেণীর সুদীর্ঘ বৃহদাকারের সংগ্রাম সত্ত্বেও সমাজ ও রাজনীতির বহুল প্রতীক্ষিত সেই রূপান্তর তার জীবদ্দশায় ঘটেনি। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে তার কাজের, বিশেষ করে ভাষা আন্দোলন বা সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে তার গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর, তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য মূল্যায়ন হয়নি বললেই চলে। বিভিন্ন বিষয়ে তার স্পষ্টবাদী, অবিচল ও নীতিগত অবস্থান এবং ভণ্ডামি, অযৌক্তিকতা ও অজ্ঞতার মুখোশ উন্মোচন করার ক্ষমতা যথেষ্ট শত্রু তৈরি করেছে। এমনকি দেশের উদার রাজনৈতিক এবং বুদ্ধিজীবী অভিজাতদের মধ্যেও সেটা হয়েছে। ফলশ্রুতিতে সবাই মিলে তার বিরুদ্ধে এক 'নীরবতার ষড়যন্ত্রে' মেতেছেন। সম্ভবত তারা 'বিরক্তিকর উমরের' বিরুদ্ধে একমাত্র ওষুধ হিসেবে তাকে অবজ্ঞা করার পন্থা বেছে নিয়েছেন। অপরদিকে, প্রতিবেশী দেশ ভারতে নানা মতের বুদ্ধিজীবীরা সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী আচরণ করেছেন। তারা উমরের কাজ নিয়ে লিখেছেন, মন্তব্য করেছেন এবং তাদের নিজেদের লেখায় তার লেখার উদ্ধৃতি দিয়েছেন। তাদের মধ্যে আছেন কাজী আব্দুল ওদুদ, মৈত্রেয়ী দেবী, অন্নদাশংকর রায়, বিষ্ণু দে, নারায়ণ চৌধুরী, বিনয় ঘোষ, সমর সেন ও মহাশ্বেতা দেবী। উমরের কাজের কারণে তিনি প্রভাবশালী ইংরেজ বামপন্থী লেবার দলের সংসদ সদস্য টনি বেন ও নাগা জাতির পিতা আনগামি ফিজোর বন্ধুত্ব অর্জন করেছেন।

আহমদ ছফা নিজেকে ভাগ্যবান মনে করতেন, কারণ তিনি 'উমরের যুগে' জন্মগ্রহণ করেছেন। এটি কোনো দিক দিয়েই বাড়িয়ে বলা কথা নয়। বদরুদ্দীন উমরের বিদ্যায়তনিক কাজ ও রাজনৈতিক কার্যক্রম এবং তার ব্যক্তিত্ব, দেশে ও বিদেশে উভয় ক্ষেত্রেই, বেশ কয়েক প্রজন্মের বিদ্যান্বেষী ও রাজনৈতিক কর্মীদের প্রভাবিত করেছে। তিনি একজন জীবন্ত উদাহরণ, ঠিক যেমনটি ছিলেন সপ্তম শ্রেণীতে থাকতে, ঠিক তেমনটি আছে ৯০ বছর বয়সেও। তিনি দ্বিধাহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেন, 'আমি তেমন জীবনই পেয়েছি যেমনটি আমি চেয়েছিলাম; সাধারণ, সম্মানজনক ও উৎপাদনমুখর।।'

আমার শিক্ষক, কমরেড উমর দীর্ঘজীবী হোক।

সি আর আবরার পেশায় একজন শিক্ষক এবং মানবাধিকার ও আইনের শাসন বিষয়ক প্লাটফর্ম নাগরিকের সদস্য। তিনি মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ ও আইন সাহায্য কমিটি এবং মন্বন্তর প্রতিরোধ কমিটির কর্মী হিসাবে সক্রিয় ছিলেন। এই লেখায় তাকে সহযোগিতা করেছেন ওমর তারেক চৌধুরী, ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া ও শুপ্রভা তাসনীম।

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English

Teknaf customs in limbo as 19 mt of rice, authorised by AA, reaches port

The consignment of rice weighing 19 metric tonnes arrived at Teknaf land port on Tuesday evening with the documents sealed and signed by the Arakan Army

5h ago