গণহত্যার গহন গল্প
'একাত্তর' শব্দটি উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের সামনে ভেসে ওঠে একটি ছবি, যার বিস্তৃতি ৯ মাস। এই ৯ মাস আমাদেরকে দিয়েছে নিজের পরিচয়, নাম, ঠিকানা, ভৌগলিক পরিধি ও অপার স্বাধীনতা।
মুক্তিযুদ্ধের কথা এলেই আমাদের স্মৃতিতে ভেসে আসে বিভীষিকাময় এক অধ্যায়ের ছবি। যে ছবি জুড়ে কেবলই হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও লেলিহান আগুনের শিখা।
একাত্তরে পুরো দেশটাই ছিল একটি যুদ্ধ ময়দান। এই দেশের একেকটি জনপদ ছিল একেকটি যুদ্ধক্ষেত্র। বর্তমান মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার ভবেরচর একাত্তরের ভয়াল গ্রাসের মুখে পড়া এমন একটি জনপদ। একাত্তরের সেই উত্তাল সময়কে একটি ফ্রেমে এনে 'গণহত্যার গহন গল্প: প্রসঙ্গ ভবেরচর' শিরোনামে লিপিবদ্ধ করেছেন সাহাদাত পারভেজ।
একাত্তরজুড়ে হত্যা, নৈরাজ্য ও অশান্তির এক জীবন্ত নরকে পরিণত হয়েছিল গোটা দেশ। সাহাদাত পারভেজ তার গণহত্যার আখ্যানে শুনিয়েছেন মানুষ ও মানবতার চিরন্তন গান, মা ও মাতৃভূমির জন্য জীবন উৎসর্গের অনন্য ইতিহাস। এই গ্রন্থ পড়ে জানা যায় ভবেরচর গণহত্যার পূর্বাপর।
মুক্তিযুদ্ধের এত বছর পরেও ভবেরচরের গণহত্যা নিয়ে কেন কোনো বস্তুনিষ্ঠ দলিল আমাদের সামনে ছিল না, তা টের পাই এই গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান পাঠের মধ্য দিয়ে। আমরা যে দিন দিন ইতিহাস বিমুখ জাতি হতে যাচ্ছিলাম, ভবেরচর গণহত্যা আমাদেরকে সেখান থেকে রক্ষা করবে বলে বিশ্বাস করি। ভবেরচরের গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শীরা আজ অল্প ক'জনই জীবিত রয়েছেন। তাদের মুখ থেকে সেই যুদ্ধদিনের কাহিনী শোনাটাও কম রোমাঞ্চের নয়। এখানে লেখক ২টি কাজ করেছেন। প্রথমটি, মুক্তিযুদ্ধের আড়ালে থাকা একটি অধ্যায়কে সামনে নিয়ে এসেছেন। আবার একইসঙ্গে প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান তুলে ধরে ফোকলোর চর্চার একটি শর্তও পূরণ করেছেন। ইতিহাস তো মানুষের মুখে মুখে শুনে আসা অতীতের পাঠ। তাই, এই যে মুখে মুখে যুদ্ধদিনের ঘটনা তুলে ধরা-এটাও নতুন মাত্রা যোগ হল।
একাত্তরে ভবেরচর গণহত্যার শিকার যারা হয়েছিলেন, তাদের পরিবার, ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের সংখ্যাও এখন প্রকৃতির নিয়মেই কমে আসছে। কেউ কেউ মারা গেছেন। কেউ আবার স্মৃতি হারিয়ে নির্বিকার হয়ে আছেন। এতোসব প্রতিকূলতার পরেও লেখক গণহত্যার শিকার ১১টি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাদের স্বজন হারানোর হাহাকার আমাদেরও আক্রান্ত করে।
ভবেরচরে কেন গণহত্যা সংঘটিত হলো- এই উত্তর খুঁজতে আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন সাহাদাত পারভেজ। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের রণকৌশলগত গুরুত্ব, সীমান্তের করিডোর প্রভৃতি কারণে এই অঞ্চলটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৭১ সালে ৭ ডিসেম্বর ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার ভবেরচরে এই গণহত্যা সংঘটিত হয়। হত্যাযজ্ঞের শিকার হন ৯ স্কুলছাত্র, এক কৃষক আর এক স্বর্ণকার। গণহত্যার পরপরেই ভবেরচর এলাকার লোকজন যুদ্ধ সচেতন হয়ে ওঠে। শোককে সামলে তারা পাল্টা হামলা ও শত্রুদের মোকাবিলা করার তাগিদও অনুভব করে।
একাত্তরের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য বীরপ্রতীক সম্মানে ভূষিত হওয়া মো. রফিকুল ইসলামের মুখে গজারিয়ায় যুদ্ধ পরিচালনার সাহসিকতার কাহিনী আমাদের আন্দোলিত করে। ৭ ডিসেম্বর ভবেরচর গণহত্যা সংঘটিত হওয়ার পরের দিন বিক্ষুব্ধ লোকজন দখলদার বাহিনীর বাংকারে আগুন লাগিয়ে দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১০ ডিসেম্বর গজারিয়া হানাদারমুক্ত হয়। ভবেরচর পশু চিকিৎসালয় চত্বরে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের উপস্থিতিতে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। এভাবে রচিত এই ভবেরচর বিজয়ের গল্প।
এহসান মাহমুদ: কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
Comments