মহাকাশে মহাবিশ্ব দেখার টাইম মেশিন

আকারে টেনিস কোর্টের সমান জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ; ছবি: নাসা

টেলিস্কোপ বা দূরবীক্ষণ যন্ত্র হল জোতির্বিজ্ঞানের প্রধানতম অস্ত্র। কেবল দৃশ্যমান পর্যবেক্ষণ থেকে মানুষ উন্মোচন করেছে মহাবিশ্বের বিরাট সব রহস্যের। মহাকাশে পাঠানো প্রতিটি টেলিস্কোপই বিজ্ঞানীদের প্রত্যাশার চেয়ে বেশি কিছুর সন্ধান দিয়েছে। 

এ যাবৎকালের যুগান্তকারী হাবল স্পেস টেলিস্কোপ ১৯৯০ সালে মহাকাশে উৎক্ষেপণের পর বিজ্ঞানীদের আশা ছিল ১৫ বছর সেটি সার্ভিস দেবে। তবে ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে সেটি কাজ করে যাচ্ছে। হাবল টেলিস্কোপের সফলতায় বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্ব সম্পর্কেই স্পষ্ট ধারণা পেয়েছে। হাবলের মাধ্যমেই নিশ্চিত হওয়া গেছে মহাবিশ্বের বয়স ১৩ দশমিক ৮ বিলিয়ন বছর। 

তবে হাবলের সঞ্চারিত আশার পর, বড় লক্ষ্য নিয়ে (২৫ ডিসেম্বর ২০২১, বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৬টা ২০ মিনিটে) উৎক্ষেপিত হয় মহাকাশের সবচেয়ে বড় এবং জটিল ডিজাইনের টেলিস্কোপ। নাম জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ। জেমস ওয়েব টেলিস্কোপটি নিয়ে ভাবনা শুরু হয় '৯০ দশকের দিকেই। 

১৯৯৫ সালে যখন হাবল স্পেস টেলিস্কোপ প্রথম 'হাবল ডিপ ফিল্ড' আবিষ্কার করে তখন মহাবিশ্বের নক্ষত্র এবং গ্যালাক্সির সংখ্যার ধারণাই পালটে যায়! এত প্রাচুর্য এদের। 'হাবল ডিপ ফিল্ড' হলো আকাশে খালি চোখে দেখা ক্ষুদ্র অন্ধকার জায়গা, একটা টেনিস বলকে ১০০ মিটার দূর থেকে দেখতে যত ছোট মনে হবে ততটুকু জায়গা।

আকাশে নখের পরিমাণ জায়গায় চিন্তা করুন হাবল ডিপ ফিল্ডে ১০ হাজার গ্যালাক্সি!; ছবি: নাসা

আশ্চর্যের বিষয় ওইটুকু জায়গায় হাবলের মাধ্যমে ধরা পড়ে ১০ হাজার গ্যালাক্সি! আর একটা গ্যালাক্সিতে সাধারণত থাকে ১০ হাজার কোটি নক্ষত্র। আমাদের সূর্য মহাবিশ্বের কেবল একটি মাত্র নক্ষত্র! এত বেশি গ্যালাক্সি, নক্ষত্র এবং গ্রহের সংখ্যায় বিজ্ঞানীদের মাথা ঘুরে যায়।
 
খালি চোখে আপাত অন্ধকার জায়গাগুলো হয়ে ওঠে বিজ্ঞানীদের মহাবিশ্বকে আবিষ্কার করতে থাকার টার্গেট। গ্যালাক্সির সর্বব্যাপীতা নতুন চিন্তার পরিসর এনে দেয় জ্যোতির্বিজ্ঞানে। 

বিজ্ঞানীরা ঠিক করেন, মহাবিশ্বের একেবারে শিশুবয়সে জন্ম নিতে শুরু করা নক্ষত্র এবং গ্যালাক্সিগুলো পর্যবেক্ষণ করবেন। সেই লক্ষ্যেই জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের তাগিদ বেড়ে যায়। সৃষ্টির শুরুতে মহাবিশ্ব ছিল গ্যাসীয় পদার্থে পরিপূর্ণ। মহাবিশ্ব সৃষ্টির ১০ কোটি থেকে ২০ কোটি বছরের মধ্যে নক্ষত্র এবং গ্যালাক্সিরা গঠিত হতে থাকে। 

আবার যেহেতু মহাবিশ্ব ক্রমাগত সম্প্রসারিত হচ্ছে তাই, এত আগের সময়ের ছবিও দেখা সম্ভব। আলোর গতির কাছে মহাবিশ্বের বিশালতা এতই বেশি। মহাবিশ্বের দূরবর্তী সেই আলো আমাদের কাছে পৌঁছুতে এত সময় লাগে বলেই মহাবিশ্বের অতীতকে দেখা যায়। তাই টেলিস্কোপ মানুষের কাছে মহাবিশ্বকে দেখার টাইম মেশিন। এটি দেখতে পাবে ১৩ দশমিক ৭ বিলিয়ন বছর আগের দৃশ্য।

জেমস ওয়েব টেলিস্কোপটি কাজ করবে ইনফ্রারেড বা অবলোহিত আলোতে। এই আলো অবশ্য আমরা খালি চোখে দেখতে পাই না। মহাবিশ্বে ছড়িয়ে থাকা ধুলোবালির কারণে দৃশ্যমান আলোতে মহাবিশ্বের দূরতম নক্ষত্রদের তত সহজে দেখা যায় না। তবে অবলোহিত আলোর কাছে এটা কোনো বাধা নয়। আর পরমশূন্য তাপমাত্রার ওপরে থাকা সব বস্তুই ইনফ্রারেড বিকিরণ করে থাকে। সোজা কথায়, তাপও তো একটা বিকিরণ শক্তি, কিন্তু আমরা তো আর তাপ দেখতে পাই না। কিন্তু এই টেলিস্কোপ সেই তাপও দেখতে পাবে। 

এর বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির ইনফ্রারেড শনাক্ত করার ক্ষমতা খুবই সংবেদনশীল। পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্বে থাকা একটা মৌমাছিও দেখে ফেলবে মৌমাছির দেহের তাপ বা ইনফ্রারেডের কারণে। তবে চ্যালেঞ্জও রয়েছে এই টেলিস্কোপের। এই মাত্রার সূক্ষ্ম সিগনাল শনাক্ত করতে টেলিস্কোপটির আশেপাশে এমন কোনো বড় তাপীয় বস্তু থাকা যাবে না। পৃথিবীও যেহেতু তাপ বিকিরণ করে তাই, টেলিস্কোপটি পৃথিবী থেকেও যথেষ্ট দূরে থাকতে হবে। বিজ্ঞানীরা এটিকে পাঠাচ্ছেন পৃথিবী থেকে ১৫ লাখ কিলোমিটার দূরে। আর বাকি থাকে সূর্য, সূর্য থেকে রেহাই পেতে ব্যবহার করা হবে এক ধরনের পলিমার যৌগ ক্যাপটন দিয়ে নির্মিত ছাতা। ক্যাপটন এমন এক পদার্থ যা তাপ রোধ করে আবার অনেক নিম্ন তাপমাত্রায়ও প্রয়োজনীয় কাজ করতে পারে। 

হাবল স্পেস টেলিস্কোপ এবং জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের তুলনামূলক আকার; ছবি: ইউকিমিডিয়া কমনস

টেলিস্কোপটির প্রধান দর্পণটিতে ব্যবহার করা হয়েছে সোনার পাত। কারণ, সোনা সহজে বিক্রিয়া করে না এবং ইনফ্রারেড প্রতিফলনের জন্য দারুণ। যেহেতু, যত বড় দর্পণ তত স্পষ্ট ছবি তাই হাবলের প্রধান দর্পণের সঙ্গে তুলনায় এটি বেশ বড়— ৬ দশমিক ৫ মিটার ব্যাস। মিশনের লক্ষ্য যদিও ৫ বছরের মিশন, প্রকৌশলীরা আশা করছেন এটি ১০ বছর পর্যন্ত টিকে থাকবে। 

হাবল টেলিস্কোপ পৃথিবীর কাছাকাছি থাকায়, হাবলের কাছে পৌঁছে একে মেরামত করা গিয়েছে। কিন্তু এই জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ দূরে থাকবে বলে এর কোনো সমস্যা হলে সারানোর উপায় নেই। তাই প্রযুক্তির চূড়ান্ত যাচাই ও সাবধানতা নিশ্চিত করার দীর্ঘ প্রক্রিয়ার পরই একে পাঠানো হচ্ছে। 

অভিযানের জন্য আরিয়ান ৫ নামের রকেট প্রস্তুত ফ্রেঞ্চ গায়ানার উৎক্ষেপণ কেন্দ্রে; ছবি: নাসা/বিল ইনগালস
 

আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ এই টেলিস্কোপটির আকারের উপযোগী কোনো রকেট নেই। তাই এর ডিজাইন করা হয়েছে এমনভাবে যেন, ভাঁজ করে পাঠানো যায়, আবার নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে ভাঁজ খুলে কাঠামোটি পর্যবেক্ষণের জন্য ঠিকঠাক প্রস্তুত হতে পারে। 

এটিকে নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে পৌঁছতে রকেটের লাগবে ২৯ দিন। আর তারপর আরও ৬ মাসের মধ্যে টেলিস্কোপটির যন্ত্রপাতি যথেষ্ট শীতল ও যাচাই করার পর শুরু হবে এর মূল কাজ— মহাবিশ্বের প্রাথমিক সময়ের নক্ষত্র, ও গ্যালাক্সিগুলোর ছবি তোলা! পাশাপাশি, মহাবিশ্বের নক্ষত্রসীমায় গ্রহগুলোর আবহাওয়া এবং জীবন সৃষ্টির সম্ভাবনাও আঁচ করা যাবে। 

বলা হয়, গড়ে মহাবিশ্বের নক্ষত্রপ্রতি একটি গ্রহ আছে। তাই, টেলিস্কোপটি হয়তো আমাদের ভবিষ্যত পৃথিবী খুঁজতেও সাহায্য করবে। হয়তো জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ ভবিষ্যতের জ্যোতিপদার্থবিজ্ঞানীদের বাতলে দেবে নতুন রহস্যের চাবি।

তথ্য সূত্র

দ্য লঞ্চ-ওয়েব/নাসা
দ্য জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ—কেটনিক্যাল ডিটেইলস
ওয়েব লঞ্চ জিএসএফসি
এফএকিউ লাইট ওয়েব টেলিস্কোপ/নাসা
হাউ নাসাস ওয়েব টেলিস্কোপ উইল ট্রান্সফর্ম আওয়ার প্লেস ইন দ্য ইউনিভার্স

Comments