বর্বরতার স্মৃতি লেপ্টে আছে যে পোড়া ঘরে

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মমতা বর্ণনা করেন মুক্তিযোদ্ধা আজিজ খান। ছবি: স্টার

ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জের ভাওয়াল খানবাড়ি এলাকা। এর 'বড় মসজিদের' পেছনেই কয়েকটি নতুন ভবনের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় ভেঙে পড়া জরাজীর্ণ একটি ঘর। একটু খেয়াল করলে ছাউনিবিহীন ওই ঘরের জানালার চৌকাঠ ও দেয়ালগুলোতে ছোপ ছোপ কালো আস্তর চোখে পড়বে।

ওই জীর্ণ ঘর ও কালো আস্তরগুলো ৫০ বছর আগের এক বর্বরতার স্মৃতি বহন করে চলেছে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নৃশংসতার একটি বিশেষ প্রবণতা ছিল অগ্নিসংযোগ। যুদ্ধের ৯ মাসজুড়ে পাকিস্তানি বাহিনী গ্রামের পর গ্রাম নির্বিচারে পুড়িয়ে দিয়েছে। ওই পোড়া ঘর যেন তারই সাক্ষ্য দিচ্ছে।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে খানবাড়ির পুড়ে যাওয়া খাট, কাঠের বিম, কয়েকটি পাটাতন ও একটি মইসহ অনেক কিছুই। ছবি: স্টার

ওই ঘরের মালিকপক্ষ ও স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, একাত্তরের ২৫ নভেম্বর ভাওয়াল খানবাড়ি এলাকার অনেক বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয় পাকিস্তানি বাহিনী। তার মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়ি হিসেবে চিহ্নিত খানবাড়ির ৩টি ঘরও পুড়িয়ে দেওয়া হয়। পরে যুদ্ধের স্মৃতি হিসেবে ওই পরিবারের সদস্যরা একটি দগ্ধ ঘর সংস্কার না করে আগের অবস্থায় রেখে দেন। আর পুড়ে যাওয়া খাট, কাঠের বিম, কয়েকটি পাটাতন ও একটি মইসহ কিছু অংশ দান করেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরকে।

এখন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ৪ নম্বর গ্যালারির 'আত্মসমর্পণ' অংশে প্রদর্শিত হচ্ছে ওই ঘরের পুড়ে যাওয়া ৪টি কাঠের তক্তা।

এ বিষয়ে জাদুঘর কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, একাত্তরে যুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানি বাহিনী যে জনপদে ঢুকেছে, সেখানে পুড়িয়েছে বাজার-হাট, হিন্দু বসতি কিংবা 'জয় বাংলা সমর্থকদের' বাড়ি। এসব অগ্নিসংযোগের সঠিক কোনো হিসাব নেই। কিন্তু পুড়ে যাওয়া কাঠের এই টুকরোগুলো নৃশংসতার সেই দিকটিকে মূর্ত করে তুলছে।

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি শামসুর রাহমানের 'তোমাকে পাওয়ার জন্য, হে স্বাধীনতা' কবিতায়ও পাকিস্তানি বাহিনীর 'অগ্নিসন্ত্রাসের' খানিকটা চিত্র পাওয়া যায়। কবি সেখানে বলছেন, 'তুমি আসবে ব'লে, হে স্বাধীনতা,/ছাত্রাবাস বস্তি উজাড় হলো।/…তুমি আসবে ব'লে, ছাই হলো গ্রামের পর গ্রাম।/…বিধ্বস্ত পাডায় প্রভূর বাস্তুভিটার/ভগ্নস্তূপে দাঁড়িয়ে একটানা আর্তনাদ করলো একটা কুকুর।'

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর কর্তৃপক্ষ বলছে, জাদুঘরের গণহত্যা গবেষণা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাসে একদল স্কুলশিক্ষার্থী কেরানীগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধের গণকবর ও স্মৃতিস্তম্ভ পরিদর্শন করে। এ সময় তারা স্থানীয়দের কাছ থেকে খানবাড়ি এলাকায় পুড়ে যাওয়া ওই ঘরের খোঁজ পান।

যুদ্ধের সেই স্মৃতি বিজড়িত ঘরের সামনে বীর মুক্তিযোদ্ধা আজিজ খান। ছবি: স্টার

দহনকালের সাক্ষী

মোহাম্মদপুরের বছিলা সেতু ও ঘাটারচর চৌরাস্তা পার হয়ে প্রায় ১ কিলোমিটার এগিয়ে গেলেই খানবাড়ি এলাকা। মূল সড়ক থেকে ডান দিকে নেমে যাওয়া রাস্তা ধরে এগোলে খানবাড়ি মসজিদ। এর পেছনেই পোড়া ঘরটির অবস্থান।

গত ২০ ডিসেম্বর সেখানে কথা হয় ওই পরিবারের সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা আজিজ খানের সঙ্গে। মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি এই এলাকার সেকশন কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া তার পরিবারের আরও ৪ সদস্য মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশ নেন।

আজিজ খান জানান, একাত্তরে তারানগর ইউনিয়নের এই বাড়িটি বিশেষভাবে চিহ্নিত ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়ি হিসেবে। তার চাচা মহিউদ্দীন খান ছিলেন ইউনিয়নের তৎকালীন চেয়ারম্যান। ঢাকায় গণহত্যা শুরু হলে ২৬ মার্চ রাতে এই পথে পালিয়ে আসা কয়েকজন ইপিআর সদস্যকে মহিউদ্দীন খান তার বাড়িতে আশ্রয় দেন। কয়েক দিন এখানে অবস্থানের পর অস্ত্র রেখে ওই ইপিআর সদস্যরা নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে যান।

এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, 'ইপিআর সদস্যদের রেখে যাওয়া ৭টি অস্ত্র এই ঘরেই লুকিয়ে রাখা ছিল। এখানেই ১ রাত কাটিয়েছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও নাট্যকার নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু। যিনি পরবর্তীতে সাভারের শিমুলিয়া প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে আমার কমান্ডার হন।'

একাত্তরের ২৫ নভেম্বর ওই এলাকাসহ তাদের বাড়ি আক্রান্ত হওয়ার কারণ হিসেবে কয়েকটি বিষয় চিহ্নিত করেন আজিজ খান। জানান, ওই সময়ে মোট ২১ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা ঘাটারচর ও তারানগর এলাকার বিভিন্ন জায়গায় কয়েকটি ভাগে অবস্থান নেন। এখান থেকেই তারা মাঝে মাঝে ঢাকায় গিয়ে ছোটখাটো অপারেশন করে আসতেন।

সে সময়ের স্মৃতি হাতড়ে আজিজ খান বলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের এই দলের মধ্যে ছিলেন প্লাটুন কমান্ডার ও এখনকার বিখ্যাত চিত্রশিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদও। যিনি অবস্থান নেন নিমতলী গ্রামের ডা. ফজলুল করিমের বাড়িতে।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে খানবাড়ির পুড়ে যাওয়া খাট, কাঠের বিম, কয়েকটি পাটাতন ও একটি মইসহ অনেক কিছুই। ছবি: স্টার

বর্তমানে তারানগর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আজিজের কাছ থেকে আরও জানা যায়, এই এলাকাটি আক্রান্ত হওয়ার কয়েক দিন আগে বীর মুক্তিযোদ্ধারা স্থানীয় শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীনকে হত্যার উদ্দেশ্যে অ্যামবুশ চালালেও তা ব্যর্থ হয়। এরপর ২২ নভেম্বর রাতে শিল্পী শাহাবুদ্দিনের নেতৃত্বে ঘাটারচর এলাকার একটি বাড়িতে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে ইচ্ছুক এমন অনেকের নাম তালিকাভুক্ত করা হয়। যার খবর পৌঁছে যায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছে।

এরই প্রতিক্রিয়ায় ২৫ নভেম্বর ভোররাতে ঘাটারচর থেকে শুরু হয় পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ। আক্রমণের শুরুতেই ঘাটারচরের হিন্দু গ্রামগুলোর বেশির ভাগ পুড়িয়ে দেয় পাকিস্তানি সেনারা। এরপর সকাল ৭টা থেকে রাত পর্যন্ত খানবাড়ি এলাকার বড়মন হরিয়া, ছোটমন হরিয়া, বড় ভাওয়াল, কাঁঠালতলীতে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চলে।

সে সময় ১৭ বছরের বীর মুক্তিযোদ্ধা আজিজ খান ছিলেন সাভারের শিমুলিয়া প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে। আক্রমণ পর্ব শেষ হওয়ার পর তিনি এলাকায় ফিরে জানতে পারেন, সেদিন দিন তার বাবা হাশেম খানসহ ২ ভাইকে আটকের পর নির্যাতন করে ছেড়ে দেয় পাকিস্তানি বাহিনী। পরে রাজাকারদের ইন্ধনে তাদের বাড়ির ৩টি ঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়।

একই দিনে ঘাটারচর ও খানবাড়ি এলাকায় ৫০ জনের বেশি রাজাকার নিয়ে শতাধিক নিরস্ত্র গ্রামবাসী ও ২ জন নিরস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যার অভিযোগ উঠেছিল যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসি হওয়া জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে।

যুদ্ধের এত বছর পরও পুড়ে যাওয়া ১টি ঘর সে অবস্থাতেই রেখে দেওয়ার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে আজিজ খান বলেন, 'পোড়া ঘরটি আমার চাচার ভাগে পড়েছে। কয়েক বছর আগে তিনি মারা গেছেন। আমাদের গোষ্ঠীর মোট ৫ জন সদস্য মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন। পোড়া ঘরটা রেখে দিয়ে আমরা আসলে সেই সময়কার স্মৃতিটাকে ধরে রাখতে চেয়েছি।'

আর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে রক্ষিত এই ঘরের পুড়ে যাওয়া কিছু উপকরণ সম্পর্কে তার ভাষ্য, 'এটি সম্ভব হয়েছে বাচ্চু ভাই (নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু) ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হকের উৎসাহে। এর মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধিরা জানবে, একটি স্বাধীন দেশের জন্য কতটা যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে আমাদের।'

Comments

The Daily Star  | English

Lower revenue collection narrows fiscal space

Revenue collection in the first four months of the current fiscal year declined by 1 percent year-on-year

10h ago