ধূলি দূষণ রোধে কার্যকর সমাধান জরুরি

পাহাড়ে ঘেরা, প্রবহমান নদী ও সমুদ্র উপকূল ঘেঁষা সমভূমির কারণে বৈচিত্র্যপূর্ণ নগরী হিসেবে চট্টগ্রাম অনন্য। তবে ২ হাজার বছরের ঐতিহ্যের স্মারক চট্টগ্রাম এখন আর আগের অবস্থায় নেই।

বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, ব্যবসা-বাণিজ্যের বহুমুখী প্রসার, জনসংখ্যা, আবাসন, ব্যবসা ও শিল্প স্থাপনা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে বন্দর নগরীতে। শিল্পায়ন কিংবা নগরায়ন যেন বিষফোঁড়া হয়ে উঠেছে এই শহরের জন্য। কারণ অনেকাংশেই যথাযথ নিয়ম অনুসরণ না করে উন্নয়ন কাজের ফলে অনেক আগে থেকেই মাত্রাতিরিক্ত দূষণের শিকার এই শহর। অব্যাহত দূষণের ফলে ধুলাবালি ও ধোঁয়ার সঙ্গে বন্দর নগরীর বাতাসে বাড়ছে ব্ল্যাক কার্বনসহ নানান বিষাক্ত উপাদান, যা মানবদেহে শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন রোগের সংক্রমণ বাড়াচ্ছে।

বাতাসের গুণগত মান নির্ভর করে বায়ুতে ভাসমান সূক্ষ্ম ধূলিকণার পরিমাণ (পার্টিকুলেট ম্যাটার বা পিএম-১০) এবং অতি সূক্ষ্ম ধূলিকণার পরিমাণের (পিএম ২.৫) ওপর। এগুলো পরিমাপ করা হয় প্রতি ঘনমিটারে মাইক্রোগ্রাম (পার্টস পার মিলিয়ন-পিপিএম) এককে।

পিএম ২.৫, পিএম ১০ ছাড়াও সালফার ডাই অক্সাইড, কার্বন মনো-অক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড ও গ্রাউন্ড লেভেল ওজনে সৃষ্ট বায়ু দূষণ বিবেচনা করে এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স বা একিউআই তৈরি হয়। একিউআই নম্বর যত বাড়তে থাকে, বায়ুমান তত ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়।

পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে, বাতাসের একিউআই মাত্রা শূন্য থেকে ৫০ পিপিএম হলে তাকে 'সবুজ' বা 'স্বাস্থ্যকর' বায়ু বলা হয়। একিউআই মাত্রা ৫১ থেকে ১০০ পিপিএম হলে তাকে 'মধ্যম' বায়ু বলা হয়, যা মানুষের জন্য তেমন ক্ষতিকর নয়। মাত্রা ১০১ থেকে ১৫০ পিপিএম হলে সেই বায়ুকে 'সতর্কতামূলক' বায়ু বলা হয়, যা মানুষের জন্য মৃদু ক্ষতিকর। একিউআই মাত্রা ১৫১ থেকে ২০০ পিপিএম হলে তা 'অস্বাস্থ্যকর' শ্রেণিতে বিবেচনা করা হয়। ২০১ থেকে ৩০০ পিপিএম একিউআই মাত্রার বাতাসকে 'খুবই অস্বাস্থ্যকর' এবং ৩০১ থেকে ৫০০ পিপিএম মাত্রার বাতাসকে 'চরম অস্বাস্থ্যকর' বলে চিহ্নিত করা হয়।

বায়ুতে সবচেয়ে ক্ষতিকর উপাদান অতি সূক্ষ্ম ধূলিকণা পিএম ২.৫ বর্তমানে চট্টগ্রামের বাতাসে সহনীয় মাত্রার চেয়ে প্রায় ৪ গুণ বেশি। এগুলো যত বেশি হবে তাপমাত্রার তারতম্যও তত বেশি হবে। এ ছাড়া নগরীর বায়ুতে দূষিত উপাদানের প্রায় ৬৫ ভাগই ধূলিকণা। পরিবেশবিদদের মতে ধুলোর দূষণ ছাড়িয়ে যাচ্ছে ইটভাটার দূষণকেও।

সাধারণত প্রতি ঘনমিটার বাতাসে ধূলিকণার সহনশীল মাত্রা ১৫০ মাইক্রোগ্রাম। কিন্তু পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিসংখ্যানে চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, প্রতি ঘনমিটার বাতাসে ধুলোর পরিমাণ নগরীর বিভিন্ন স্থানে গড়ে ৩০০ মাইক্রোগ্রামের বেশি। একসময় উন্নয়ন কাজের বদৌলতে কেবল মূল সড়কে ধুলাবালির প্রাদুর্ভাব থাকলেও বর্তমানে অলিগলির সড়কেও তা দৃশ্যমান। ধুলাবালি এত বেশি যে শীতকালে রাস্তায় নামলে ধুলাবালি ও কুয়াশার মধ্যে পার্থক্য করা দুরূহ। এতে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থী ও পথচারীদের। ধুলাবালি থেকে রেহাই পায় না সড়কের পাশে থাকা বিভিন্ন স্থাপনাসহ দোকানপাটগুলোও। সড়কের পাশে থাকা সবুজ পাতাগুলোও ধূসর হয়ে পড়ছে।

চট্টগ্রাম যেন ধুলার নগরীতে পরিণত হয়েছে। উন্নয়নের নামে বায়ু দূষণ বেড়েই চলছে। বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে মানুষের ভোগান্তি চরমে থাকে। দূষণ নিয়ন্ত্রণে আইন অনুযায়ী কাজের আগে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেওয়াসহ নিয়মিত পানি ছিটানোর বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা মানছে না নগরীর সেবা সংস্থাগুলো। সরকারি এবং বিদেশি সংস্থার অর্থায়নে বাস্তবায়িত মেগা প্রকল্পগুলোতেও পরিবেশের বিষয়টি যথাযথ গুরুত্ব না দেওয়ায় পরিবেশের সর্বনাশ হচ্ছে। অথচ উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে পরিবেশ রক্ষার বিষয়টি প্রকল্প গ্রহণের শুরুতেই বিবেচনায় নেওয়া হয়।

তাছাড়া চট্টগ্রাম শহরের খাল-নালাগুলো পরিষ্কার করার সময় বর্জ্য তুলে রাস্তার পাশে স্তূপ করে রাখা হয়। এগুলো অপসারণ ও পরিবহনের সময় রাস্তাঘাটে পড়ে মিশে যায়। পরবর্তীতে তা শুকিয়ে বাতাসের সঙ্গে মিশে পরিবেশকে করে তোলে অস্বাস্থ্যকর।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সের অধ্যাপক ড. মো. শফিউল আলম বলেন, নগরীতে প্রতি বছর জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে আবাসনের চাহিদা পূরণ করতে নগর এলাকায় পুরনো ভবন ভাঙা, নতুন নির্মাণ ও ভবন নির্মাণ সামগ্রী রাস্তার ওপর যত্রতত্র ফেলে রাখায় বায়ু দূষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সড়কে মালামাল, ময়লার স্তূপ আর যানবাহনের ছোটাছুটিতে বাতাসে ধুলাবালির আধিক্যতা জনস্বাস্থ্যকে হুমকির মুখে ফেলেছে। উন্নয়ন প্রকল্পে নিয়োজিত সরকারি সেবা সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতা ও পরিবেশ বান্ধব পদ্ধতি অনুসরণ না করায় বায়ু দূষণ দিন দিন তীব্র হচ্ছে।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে বায়ু দূষণে নগরীর বাতাসে বেশি মাত্রায় পিএম থাকায় এবং দীর্ঘদিন ধুলাবালির পরিবেশে থাকার ফলে মানুষের ধমনীতন্ত্র, শ্বসনতন্ত্র এবং স্নায়ুতন্ত্র আক্রান্ত হচ্ছে বেশি। এ ছাড়া চোখের সমস্যা, বদহজম, অ্যালার্জিসহ ভাইরাসজনিত নানান রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে শিশু ও অন্তঃসত্ত্বা নারীরা। এভাবে বায়ু দূষণ প্রবণতা অব্যাহত থাকলে অকাল মৃত্যুর হার বেড়ে যাবে।

কাজেই পরিকল্পিত নগরায়নের মাধ্যমে শহরের মানুষ ও অন্যান্য শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপন কমাতে পারলে, পরিকল্পিতভাবে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, ড্রেনেজ ও রাস্তার উন্নয়ন ও সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করে, সব সংস্থার সমন্বয় ও বায়ু শোধন যন্ত্রপাতি এটিপি (এয়ার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট) ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে আইন করলে এবং তার বাস্তবায়ন করলে চট্টগ্রামের দূষণ উল্লেখযোগ্য ভাবে কমানো সম্ভব।

মিনহাজুর রহমান শিহাব, শিক্ষার্থী, বন ও পরিবেশবিদ্যা ইনস্টিটিউট, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

 

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Tabith Awal elected new BFF president

Tabith Awal has been elected as the president of Bangladesh Football Federation following a landslide victory in the BFF polls today.

58m ago