স্থপতিরা আর বড়লোকদের সেবাদাস না: রফিক আজম

স্থপতি রফিক আজম। ছবি: সংগৃহীত

'স্থাপত্য এক সময় ছিল রাজা-রাজড়াদের হাতিয়ার। তারা তোরণ বানাতেন, দালান বানাতেন, প্রাসাদ বানাতেন স্থপতিদের দিয়েই। দেখাতেন তারা কতটা ক্ষমতাধর। এর মাধ্যমে শাসন করতেন অন্যদের। কিন্তু দিন পালটেছে। স্থপতিরা এখন আর বড়লোকদের সেবাদাস না।'

সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কথাগুলো বলছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বাংলাদেশি স্থপতি রফিক আজম।

স্থাপত্য নকশার ক্ষেত্রে পশ্চিমের বিদ্যায়তনিক পরিসরের সঙ্গে স্থানীয় লোকজ জ্ঞানের সম্মিলন ঘটিয়েছেন তিনি।

আজিমপুর মেয়র হানিফ জামে মসজিদ। ছবি: সাতত্যের সৌজন্যে

বাংলাদেশের স্থাপত্য শিল্পে ঐতিহ্য ও আধুনিকতার রূপকার এই স্থপতির স্থাপত্যকর্মের মূল বৈশিষ্ট্য মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সহাবস্থান, উন্মুক্ততা ও সবুজ সংলগ্নতা। কখনও কখনও তার নকশার উপজীব্য হয়ে ওঠে লালন কিংবা রবীন্দ্রনাথের ভাবদর্শন। ঋতু বদলের সঙ্গে সঙ্গে রোদ, বৃষ্টি আর হাওয়ার বদল তার নকশা করা স্থাপত্যের রঙ-রূপ-ধরণ বদলে দেয়।

পুরান ঢাকার লালবাগের রসুলবাগ পার্ক। ছবি: সাতত্যের সৌজন্যে

সেই সঙ্গে স্থাপত্যকলাকে তিনি ধনীদের চৌহদ্দি থেকে নামিয়ে আনতে চান সাধারণ মানুষের কাতারে। তাই সব শ্রেণি-পেশার মানুষের প্রবেশাধিকার নিশ্চিতের পাশাপাশি শহুরে নাগরিকদের দৃষ্টিসীমা বিস্তৃত করতে তার নকশা করা পার্ক কিংবা ভবনের কোনো দেয়াল থাকে না। দেয়াল অপসারণের মাধ্যমে তিনি ভাঙতে চান সব নাগরিক অবিশ্বাসকে।

এভাবেই তার নকশায় ঢেলে সাজানো পার্ক কিংবা খেলার মাঠ হয়ে ওঠে এলাকার সব শ্রেণীর মানুষের মিলনকেন্দ্র। সবুজ হারানো ইট-কাঠের নগরে তার নকশা করা ভবনের প্রতিটি তলায় থাকে একগুচ্ছ সবুজ, ছাদে পুকুর। থাকে রাগ নিবারণের 'গোস্বা ঘর'। ছোট্ট ফ্ল্যাটের সীমিত পরিসরের মধ্যেই তিনি বানিয়ে ফেলেন বৃষ্টি কিংবা বাতাস উপভোগের জন্য এক চিলতে জায়গা। এসব কারণে তিনি পরিচিতি পেয়েছেন 'গ্রিন আর্কিটেক্ট' হিসেবে।

ভুটানে বাংলাদেশ চ্যান্সেরি ও রাষ্ট্রদূতের বাসভবন। ছবি: সাতত্যের সৌজন্যে

সম্প্রতি রফিক আজমকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী ম্যাগাজিন টাইম। গত ২৮ অক্টোবর প্রকাশিত 'ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স ইজ অ্যা ডিজাইন চ্যালেঞ্জ: দিস বাংলাদেশি আর্কিটেক্ট হ্যাজ সল্যুশনস' শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, আজম ঢাকার অবহেলিত পার্কগুলোকে নতুন নকশায় সাজিয়ে সেগুলোকে ছোট ছোট মরূদ্যানে পরিণত করতে শুরু করেছেন। যে পার্কগুলোর পানি ধারণ ক্ষমতা এখন দ্বিগুণ।

টাইমের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, জলোচ্ছ্বাস বিশ্বব্যাপী নিচু শহরগুলোর জন্য হুমকি। ঢাকার অভিজ্ঞতা যদি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত চ্যালেঞ্জের একটি সতর্কতামূলক গল্প হয়, তাহলে এই সমাধান অন্য জায়গাতেও সমানভাবে প্রয়োগ করা যেতে পারে।

টাইমের এই প্রতিবেদন প্রসঙ্গে রফিক আজম বলেন, 'টাইম সম্প্রতি বৈশ্বিক জলবায়ু সম্মেলন কপ-২৬ উপলক্ষে ডেডিকেটেড একটা ইস্যু করেছে। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের দিক থেকে ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে পরিচিত হওয়ায় এদিকে অনেকের দৃষ্টি থাকে। এ ক্ষেত্রে নেতিবাচক দিকগুলোই তারা খোঁজে। এই কারণেই কি না জানি না, টাইম থেকে ই-মেইলে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলো।'

'তখন সাক্ষাৎকারে আমি মূলত পুরান ঢাকার রসুলবাগ পার্ক প্রকল্পটি দেখাই। এটা দেখার পর তারা খুবই এক্সাইটেড হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে টাইম পজিটিভলি বলেছে, আসলেই সমাধান আছে। আর আমার কাছে ভালো লেগেছে যে, বাংলাদেশ সম্পর্কে টাইম পজিটিভ একটা ইমেজ তৈরি করে দিয়েছে।'

ধানমন্ডির মেঘনা রেসিডেন্স। ছবি: সাতত্যের সৌজন্যে

কাজের দর্শন

রফিক আজমের কাজের মূল দর্শন মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যকার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের ন্যুনতম ব্যাঘাত না ঘটিয়ে নতুন যোগসূত্র স্থাপন করা, নির্মাণকাজে যতটা সম্ভব প্রাকৃতিক উপাদানের ব্যবহার বাড়ানো, পাশাপাশি স্থাপত্যকলাকে জনপদ পাল্টে দেওয়ার অনুষঙ্গ হিসেবে কাজে লাগানো।

এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'আমি ধনীদের অনেক কাজ করেছি। তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। তারা আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন, কাজ করার সুযোগ দিয়েছেন। কিন্তু আমি তাদের সেবাদাস হতে চাই না। আমি জনগণের সেবাদাস হতে চাই। এমন কাজ করতে চাই, যাতে একটা শিশুর জীবন পাল্টে যায়, কমিউনিটির জীবন পাল্টে যায়।'

তিনি আরও বলেন, 'রাজনীতিবিদদের বলতে চাই, নগর পাল্টে দেওয়ার জন্য, জনপদ বদলে দেওয়ার জন্য স্থপতিদের ডাকুন। আরও বেশি পড়াশোনার সুযোগ তৈরি করে তাদের যোগ্য করে গড়ে তোলা হোক।'

চর্চায়-কর্মে লালনের ভাবদর্শন সম্পর্কে এই স্থপতির ব্যাখ্যা, 'লালন তার গানে বলেছেন, "খাঁচার ভেতর অচিন পাখি, কেমনে আসে যায়"। তার মানে মানুষের শরীর একটা খাঁচা। স্থাপত্যে প্রাথমিকভাবে আমরা একটা খাঁচার নকশাই করি। আর হিসাব করি কখন রোদ আসবে, বাতাস আসবে, ফুলের গন্ধ আসবে। এই যে খাঁচার সঙ্গে, প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক—সেটাই স্থাপত্য।'

পুরান ঢাকার আজম রেসিডেন্স। ছবি: সাতত্যের সৌজন্যে

'অবিশ্বাসের দেয়াল' ভাঙার ধারণা

পুরাণ ঢাকার পার্কগুলোর পাশাপাশি রফিক আজমের নকশায় তৈরি অনেক অ্যাপার্টমেন্টের কোনো সীমানা দেয়াল নেই। আছে বাগান, আছে নিচু কাঁচের সীমানা।

তিনি বলেন, 'এটা দুটো কাজ করে। দৃষ্টিসীমা প্রসারিত করে ভেতর-বাহিরটা দেখতে দেয়। আর কাঁচের দেয়াল যেহেতু ঠুনকো, তাই আমাদের বিশ্বাসের জায়গাটা পোক্ত হয়।'

নিরেট দেয়াল ভেঙে ফেলার এই ধারণা প্রসঙ্গে তার বক্তব্য, 'এই ধারণাটি পেয়েছি পুরাণ ঢাকা থেকে। পুরাণ ঢাকার বাড়িগুলো ছিল প্রায় রাস্তার ওপরে। সামনে একটা রোয়াকের মতো। এটা হচ্ছে বিশ্বাসের জায়গা, মিলনের জায়গা। সেখানে বাড়ির মানুষও বসতে পারে, রাস্তার মানুষও বসতে পারে। নতুন ঢাকায় এসে দেখলাম দেয়াল দিয়ে উপরে তারকাটাও দেয়। তার মানে রাস্তার মানুষকে কেউ বিশ্বাস করছে না। আবার অনেক বাড়ির দেয়ালে লেখা থাকে "কুকুর হইতে সাবধান"।'

'সমাজে কি এটাই আমাদের সম্পর্ক? একে অপরের শত্রু আমরা? তখন আমি আমার কাজের ভেতর দিয়ে অবিশ্বাসের এই দেয়াল ভেঙে দিতে শুরু করলাম।'

বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার আগা খান একাডেমি। ছবি: সাতত্যের সৌজন্যে

স্থাপত্যকলায় পূর্ব-পশ্চিমের মেলবন্ধন

রফিক আজম তার স্থাপত্য নকশায় পশ্চিমের বিদ্যায়তনিক পরিসরের সঙ্গে স্থানীয় লোকজ জ্ঞানের মেলবন্ধন তৈরি করেছেন।

এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, '১৯৯৮ সালে নিউইয়র্কে আমার একটা প্রদর্শনী ছিল। সেটা শেষে বুঝলাম বুয়েটে পড়াশোনা করে শিখেছি বিদেশি পড়া। নিজের কিছুই শিখিনি। মনে হলো, ওরা (আয়োজক কর্তৃপক্ষ) আমাকে দেখে মায়া করছে। বলছে, তুমি তো কিছু শেখনি। তুমি আমাদেরটাই নকল করছো। ভালো হচ্ছে না এখনও, কিন্তু হবে।'

'আমার উপলব্ধি হলো, কাজের কাজ কিছুই হয়নি। প্লেনে আসতে আসতে লিখেছিলাম, আই আম কামিং ব্যাক হোম উইথ হোপ অ্যান্ড ফ্রাস্টেশন।'

মূলত এই ঘটনার পর থেকেই স্থাপত্যে লোকজ জ্ঞান ও উপাদান ব্যবহারের চিন্তাটা মাথায় আসে বলে জানান রফিক আজম। বলেন, 'আমার আঁকাআঁকি ইউরোপিয়ান, আমেরিকান স্টাইলে। আমি খুব সিস্টেমেটিক্যালি ড্রয়িং করি, যেটা আমি শিখেছি। কিন্তু যখন লেয়ার অন করি তখন পুল হয়ে যায় পণ্ড, ঘর হয়ে যায় গোস্বা ঘর, বৃষ্টি ঘর। পুলে জায়গা করে নেয় জংলা, ঘাটলা।'

'এভাবে আস্তে আস্তে বিদেশিরা আমাকে মূল্যায়ন করতে শুরু করে, অ্যাওয়ার্ড দিতে শুরু করে। আমার কাজ দেখে ওদের মনে হতে থাকে, এটা তো চেনা। কারণ আমার ড্রয়িং তো ওদের স্টাইলের। আবার অন্য অনুষঙ্গগুলো লোকজ। যেটা আমি আমার স্থানীয় প্রতিবেশ থেকে নিয়েছি, ফিউশন তৈরি করেছি।'

বাংলাদেশি স্থপতিদের মধ্যে রফিক আজমই সর্বাধিক আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত। তার কাজ ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ইতালীয় প্রকাশনা সংস্থা স্কিরা ও বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের যৌথ উদ্যোগে প্রকাশ হয়েছে 'রফিক আজম: আর্কিটেকচার ফর গ্রিন লিভিং' শীর্ষক গ্রন্থ।

পাকিস্তানে বাংলাদেশ চ্যান্সেরি কমপ্লেক্স। ছবি: সাতত্যের সৌজন্যে

বাংলাদেশের স্থাপত্যশিল্প

রফিক আজম মনে করেন, বর্তমানে বাংলাদেশের স্থাপত্যশিল্প খুব ভালো একটা অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে। এখন বেশ কয়েকজন স্থপতি সবুজ স্থাপত্য বা গ্রিন আর্কিটেকচারের ধারা ও চিন্তা এগিয়ে নিচ্ছেন। কিন্তু বিদ্যায়তনিক পড়াশোনার অবস্থা ততটা ভালো না।

তিনি বলেন, 'স্থাপত্যকলার বিকাশের জন্য এই ধারণা জরুরি যে, স্থপতিরা বড়লোকদের সেবাদাস না। এখন আমি শহরের কাজ করছি, পার্কের কাজ করছি। উত্তর সিটি করপোরেশনেও এখন পার্কের কাজ হচ্ছে স্থপতিদের দিয়ে। এর ভেতর থেকে একটা পজিটিভ ভাইব তৈরি হয়েছে। এভাবে বড় পরিসরে কাজ করতে হবে। তাহলে চাহিদা বাড়বে, পড়াশোনার তাগিদও আসবে।'

Comments

The Daily Star  | English

New uniform, monogram sans boat on the cards for police

According to police sources, a new monogram for the Bangladesh Police has already been determined. It will no longer feature a boat

2h ago