ওমিক্রনের বিস্তার ঠেকাতে ‘ঢিলেমির কোনো সুযোগ নেই’

বিশ্বজুড়ে আতঙ্ক ছড়ানো করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রনের বিস্তার ঠেকাতে ভ্রমণ সতর্কতা জারির পাশাপাশি সব ধরনের সমাবেশে জনসমাগম সীমিত করার সুপারিশ করেছে কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি।

গত সপ্তাহে দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথম শনাক্ত হওয়া ওমিক্রন এর মধ্যে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একে শ্রেণিভুক্ত করেছে 'ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্ন' হিসেবে।

এশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকার অনেক দেশ ওমিক্রনের বিস্তার ঠেকাতে দক্ষিণ আফ্রিকাসহ ওই অঞ্চলের কয়েকটি দেশের যাত্রীদের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।

এই প্রেক্ষাপটে গতকাল সোমবার কয়েকটি দেশ থেকে আসা যাত্রীদের স্ক্রিনিং, জনসমাগম নিরুৎসাহিত করা এবং পর্যটন, বিনোদন কেন্দ্র, রেস্তোরাঁয় ভিড় এড়ানোসহ ১৫ নির্দেশনা দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

বিষয়টি নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে কোডিভ-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম, প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদের সঙ্গে।

তারা বলছেন, প্রাথমিক তথ্যের ওপর ভিত্তি করে যতটুকু ধারণা করা যাচ্ছে তাতে করোনাভাইরাসের এই ধরনটি আরও বেশি সংক্রামক। যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা অ্যান্টিবডিকে ফাঁকি দিতে সক্ষম। তাই এর বিস্তার ঠেকাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর যে নির্দেশনাগুলো দিয়েছে সেগুলো মাঠ পর্যায়ে কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। এখানে ঢিলেমির কোনো সুযোগ নেই।

এ ছাড়া সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে টিকাদান প্রক্রিয়া জোরদার করার পাশাপাশি অতীত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে হাসপাতাল ব্যবস্থাপনাকেও ঢেলে সাজানোরও পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

এ বিষয়ে বিএসএমএমইউ'র সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, 'আমাদের এখানে ব্যবস্থাপনাটা দুর্বল। সবার আগে এটা কাটিয়ে উঠতে হবে।'

এই অধ্যাপকের ভাষ্য, 'প্লেন বন্ধ করলে অনেক জিনিস অ্যাফেক্টেড হবে। তার চেয়ে আমাদের উচিত হবে এয়ারপোর্টগুলোকে ভালোভাবে ইক্যুইপড করা। সেখানে টেস্টিং হবে। টেস্ট করে যারা পজিটিভ হবে তাদের শুরুতেই বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে হবে।'

'কিন্তু দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, আমাদের দেশে এটা খুব অবহেলার সঙ্গে করা হয়েছে। যার জন্য আমরা আগাগোড়া সাফার করেছি। এই ভুলভ্রান্তিগুলো স্বীকার করে নিয়ে আমাদের কাজে নামতে হবে।'

তিনি আরও বলেন, 'এর মধ্যে যেসব দেশে ওমিক্রন ছড়িয়ে পড়েছে, সেসব দেশ থেকে কেউ আসলে তাদের স্ক্রিনিংয়ের কোনো প্রয়োজন নেই। সরাসরি তাদের কোয়ারেন্টিনে দিতে হবে।'

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া একটি তথ্য উল্লেখ করে অধ্যাপক নজরুল বলেন, 'যত ভ্যাকসিন আছে তার কোনোটাই ওমিক্রনের ওপর খুব একটা ফলপ্রসূ না। এটা মারাত্মক একটা ইনফরমেশন।'

তার বক্তব্য, 'আয়ারল্যান্ডে ভ্যাকসিনেশনের হার ৯৮ শতাংশ। সেখানেও অনেকে ইনফেকটেড হয়েছে। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও ফ্রান্সেও একই অবস্থা। সুতরাং ভ্যাকসিন দিয়েও আমরা নিশ্চিন্ত থাকতে পারব না।'

তাই যেকোনো মূল্যে সবার মাস্ক পরার বিষয়টি নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, 'যেকোনো ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে ৯৪ শতাংশ কার্যকর হচ্ছে মাস্ক। সুতরাং কেউ ভ্যাকসিন নিক কিংবা না নিক সবাইকে মাস্ক পরা, হাত ধোয়া ও সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে হবে।'

এ বিষয়ে প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহর অভিমত, এই মুহূর্তে আফ্রিকা কিংবা যেসব দেশে এই ধরনটি ছড়িয়ে পড়েছে সেখান থেকে কারুর আসার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করা যেতে পারে। বন্ধ করে দিলেই ভালো হয়।

তিনি বলেন, 'এয়ারপোর্টে যেন কঠোর নজরদারি করা হয়। টেস্টের ব্যবস্থাপনাটা যেন সুন্দর হয়। আবার এটা করতে গিয়ে যাত্রী হয়রানি যেন না হয়।

'স্থল ও নৌ-বন্দরগুলোতেও একই ব্যবস্থা নিতে হবে। বাইরে থেকে আসা সবাইকে টেস্টের আওতায় আনতে হবে। পজিটিভ হলে কোনো ধরনের ছাড় দেওয়া যাবে না।'

এ ছাড়া সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার তাগিদ দিয়ে এই চিকিৎসক বলেন,  'মানুষ তো হাত ধোয়ার ব্যাপারটি ভুলেই গেছে। রাস্তাঘাটে যে অবস্থা, যে যানজট তাতে শারীরিক দূরত্বের তো কোনো বালাই নেই। সভা-সমাবেশ, মিটিং মিছিল এগুলোও কিছুটা রেসট্রিকটেড করা দরকার।'

অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আরও বলেন, 'রাজনৈতিক মিছিল-মিটিং যেভাবে চলছে তাতে তাদের সঙ্গে একটা সমঝোতায় আসা দরকার। বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক জমায়েতের ব্যাপারে নজরদারি বাড়াতে হবে। ওমিক্রন একবার যদি ছড়িয়ে পড়ে…আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা তো ভয়াবহ। বেড নাই, অক্সিজেন নাই…এটার সম্মুখীন যেন না হতে হয়।'

তার বক্তব্য, 'সারা পৃথিবী এটা নিয়ে উদ্বিগ্ন। সুতরাং এখানে ঢিলেমির কোনো সুযোগ নেই।'

এদিকে ওমিক্রনের বিস্তার ঠেকাতে শুরুতেই জরুরি কিছু ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণের তাগিদ দেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ

এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, 'এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো বাইরে থেকে যেন এই ধরনটা না ঢোকে। এটার জন্য যেসব দেশে এটা (ওমিক্রন) ছড়িয়ে পড়েছে, সেসব দেশের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করাটা ভালো। আগে আমরা দেখেছি যে, এটা না হলে আটকানো যায় না।

'বাংলাদেশি কেউ যদি সেসব দেশে গিয়ে থাকেন, তাদের তো ফিরতে দিতে হবে। সেক্ষেত্রে তাদের কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করতে হবে।'

তার পরামর্শ, 'যারাই এখন ঢুকবে তাদের জন্য কড়াকড়ি আরোপ করতে হবে। যারা আসবে তাদের অবশ্যই দুই ডোজ টিকা দেওয়া থাকতে হবে। তাদের পিসিআর নেগেটিভ হতে হবে। এই দুটো বিষয় যেন শতভাগ প্রতিপালিত হয়। কারও ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম করা যাবে না।'

দ্বিতীয় ধাপে মাস্ক ব্যবহার বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়ার তাগিদ দেন এই অধ্যাপক। বলেন, 'এখন একটা সার্ভে করা যায় যে, কত শতাংশ লোক মাস্ক পরে। এখন যদি ২০ শতাংশ লোক মাস্ক পরে তাহলে  এখন টার্গেট নিতে হবে আগামী ১০ থেকে ১৫ দিনে আমরা এটাকে ৫০ শতাংশে উন্নীত করব। এটার জন্য প্রচার-প্রচারণার পাশাপাশি কিছু নির্দেশনা ও বাধ্যবাধকতাও জারি করতে হবে। মাস্ক না পরে যেন কেউ বের না হয় তার জন্য।'

এরপর হাসপাতাল ব্যবস্থাপনার দিকে নজর দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, 'এরপর আমাদের হাসপাতালগুলোর প্রস্তুতির দিকে তাকাতে হবে। আমাদের ৪৮৯টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ৬৪টি জেলা হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, স্পেশালাইজড হাসপাতাল, ডেডিকেটেড হাসপাতাল। দেখতে হবে সব জায়গায় অক্সিজেন সাপ্লাই ঠিক আছে কিনা, এর জন্য যেসব অ্যাক্সেসরিজ লাগে সেগুলো ঠিক আছে কিনা। না থাকলে দ্রুত সেগুলোর ব্যবস্থা থাকতে হবে।'

'এগুলোর জন্য একটা থোক বরাদ্দ দিতে হবে। যাতে করে যেখানে যেখানে ঘাটতি আছে সেগুলো যাতে পূরণ করে ফেলা যায়। কোভিড রোগী বেশি হলে ম্যানেজমেন্টে যাতে কোনো সমস্যা না হয়।'

সর্বোপরি টিকাদান প্রক্রিয়া জোরদার করার তাগিদ দিয়ে অধ্যাপক বে-নজির বলেন, 'এটাকে আর হালকাভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। আগামী ৬ মাসে আমাদের প্রস্তুতিটা চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। এর মধ্যে আমরা যেন আমাদের ৮০ ভাগ লোককে টিকা দিয়ে ফেলতে পারি।

'এ জন্য আমাদের অনেক টিকা আমদানি করতে হবে। টিকার চাহিদা আবার বেড়ে যাবে। এ জন্য আমাদের অনেক দেন-দরবার করতে হবে। অনেক কূটনীতি, বাণিজ্য নীতির বিষয় এখানে আছে।'

তিনি আরও বলেন, 'এ ছাড়া আমাদের কিছু স্ট্যান্ডিং অর্ডার জারি করতে হবে। যাতে করে কেউ আদেশের অপেক্ষায় না থাকে। যেমন লকডাউন। পরিস্থিতি বিরূপ দেখলে একটা শহরে যেন তৎক্ষণাৎ লকডাউন দিয়ে দেওয়া যায়। আর এটা যেন স্বাস্থ্য বিভাগের অধীনে থাকে। প্রশাসনের অধীনে না যায়। গতবার আমাদের কিন্তু সমস্যা হয়েছে।

'আরেকটা বিষয় হচ্ছে ভাইরাসটা ঢুকছে কিনা সেটা শনাক্তের জন্য সিকোয়েন্সিংয়ের ক্যাপাসিটি বাড়াতে হবে। খুব দ্রুত সেটা জানাতে হবে। এতে যেন বিলম্ব না হয়।'

Comments

The Daily Star  | English

Lower revenue collection narrows fiscal space

Revenue collection in the first four months of the current fiscal year declined by 1 percent year-on-year

10h ago