পরিকল্পিত পাকিস্তানের সামনে দ্বিধাগ্রস্ত বাংলাদেশ
'চ্যালেঞ্জ হবে, 'কঠিন চ্যালেঞ্জ হবে', 'সামনে ভীষণ চ্যালেঞ্জ' একই কথা বিভিন্নভাবে বারবার করে বলছিলেন মুমিনুল হক। চ্যালেঞ্জ যে হবে তিনি না বললেও চলছে। একটা পরিকল্পিত, সব বিভাগে পরিপূর্ণ দলের সঙ্গে জোড়াতালি দেওয়া, তালগোল পাকানো আরেক দল। পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথম টেস্টে নামার আগে নিজেদের উদ্বেগ আড়াল করারও অবস্থায় নেই বাংলাদেশ অধিনায়ক। তার কণ্ঠের সঙ্গে মিল আছে টিম ম্যানেজমেন্টের দ্বিধাগ্রস্ত সব সিদ্ধান্তও।
টি-টোয়েন্টিতে যতটা টেস্টে পাকিস্তান-বাংলাদেশের তফাৎ তারচেয়ে অনেক বেশি। সাম্প্রতিক ফর্ম, ছন্দে থাকা সেরা ক্রিকেটারদের অনুপস্থিতিও বাংলাদেশকে রাখছে অনেক পিছিয়ে।
এই সিরিজ দিয়েই বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের নতুন চক্র শুরু করবে বাংলাদেশ। টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের এবারের চক্রে পাকিস্তানের এটি দ্বিতীয় সিরিজ।
এমনিতে এই আসরে দুই দলের লক্ষ্যও আসলে ভিন্ন মেরুতে। পাকিস্তান নিশ্চিতভাবে চাইবে শিরোপা দৌড়ে থাকতে। বাংলাদেশ সর্বশেষ অবস্থান থেকে উত্তরণের পথ খুঁজতেই দিশেহারা।
এবার টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের বাংলাদেশের সবগুলো সিরিজই যে কঠিন। ঘরের মাঠে খেলতে হবে পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা আর ভারতের বিপক্ষে। ঘরের বাইরে প্রতিপক্ষ নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ। অর্থাৎ টিপিক্যাল স্পিন বান্ধব হোম কন্ডিশন কাজে লাগিয়েও সাফল্য পাওয়ার পথ প্রায় বন্ধ।
এশিয়ান দেশগুলোর বিপক্ষে স্পিনিং কন্ডিশন বানালে সেই খাদে নিজেদেরই যে পড়ার শঙ্কা বেশি। যদি এবারের চক্রেও বাংলাদেশের অবস্থান থাকে তলানিতে তাহলে পড়তে হবে অবনমনের শঙ্কায়। পরের চক্রে বাংলাদেশের জায়গা নেগে আফগানিস্তান, আয়ারল্যান্ড বা জিম্বাবুয়ের মধ্যে যেকোনো এক দল।
নতুন চক্রের কঠিন মঞ্চে এই যখন অবস্থা তখন শুরুতে বাংলাদেশ পাচ্ছে না সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল আর তাসকিন আহমেদকে। তিনজনই আছেন চোটে। সাকিব দ্বিতীয় টেস্টে ফেরার সম্ভাবনা নিয়ে থাকলেও তামিমকে নিউজিল্যান্ড সফরেও পাওয়া যাবে না। এই সিরিজে দ্বিতীয় টেস্টেও তাসকিনের খেলা অনিশ্চিত।
এই খেলোয়াড়দের অনুপস্থিতি দলের জন্য বিশাল ধাক্কার হলেও বাস্তবতা না মেনে উপায় নেই মুমিনুলের, 'সাকিব ভাই, তামিম ভাই, তাসকিন নিয়মিত খেলোয়াড়। এদের না পাওয়া অধিনায়ক হিসেবে আমার জন্য কঠিন হয়ে যায়। জিনিসটা হলো চলমান প্রক্রিয়া, কখনো কাউকে পাব, কাউকে পাব না। এটা নিয়ে হতাশ হয়ে পড়ে থাকলে হবে না।'
গত কয়েকমাস ধরে বাংলাদেশের ক্রিকেট খুব একটা ভালো নেই। বিশ্বকাপের আগে প্রচণ্ড মন্থর উইকেট বানিয়ে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডকে টি-টোয়েন্টি সিরিজে হারিয়ে ফাঁপা একটা খুশি মঞ্চ তৈরি করা হয়েছিল। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে গিয়ে বাস্তবতার ধাক্কায় তা চুরমার হয়ে গেছে।
বাংলাদেশের ক্রিকেট নেমে এসেছে কঠিন বাস্তবতায়। টি-টোয়েন্টির মতই যে টেস্টের দশাও বহাল। গত টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের চক্রে বাংলাদেশ ছিল একদম তলানিতে। শ্রীলঙ্কায় ব্যাটিং স্বর্গে একটি ড্র ছাড়া পয়েন্টই নেই। দেশের উইকেটে হোয়াইটওয়াশড হতে হয়েছে সেরা কয়েকজন ক্রিকেটারকে ছাড়া আসা ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে।
এবার কন্ডিশন মিলিয়ে ঘরে- বাইরে ৬ সিরিজে আরও কঠিন চ্যালেঞ্জ হলেও মুমিনুল স্বপ্ন দেখছেন দুই ধাপ উত্তরণের, 'আমার কাছে মনে হয়, এখন যে জায়গায় আছি আমরা, টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ যখন শেষ হবে, তখন এখান থেকে দুই-তিন ধাপ ওপরে উঠতে পারলে আমি খুশি।'
সেই ধাপে নামার আগে চিন্তা যে পরিষ্কার নয় অধিনায়কের। তার মনের ভেতর খেলা করছে অনেক দোলাচল। কোন পরিকল্পনায় তারা খেলবেন সেটাই যে পরিষ্কার করতে পারলে না। অগোছালো অবস্থার শেষ উদাহরণ হয়ে থাকল ম্যাচের আগের দিন সন্ধ্যায় স্কোয়াডে দুই পেসার খালেদ আহমেদ ও শহিদুল ইসলামের অন্তর্ভুক্তি। এদের নিয়ে স্কোয়াডে পেসার এখন ৫ জন।
এই দুজনকে স্কোয়াডে নেওয়ার ব্যাখ্যাও পরিষ্কার নয় টিম ম্যানেজমেন্টের। প্রধান নির্বাচক জানান, তাসকিন ও শরিফুলের চোটে ঝুঁকি এড়াতে এমনটা করেছেন তারা। কিন্তু প্রথম টেস্টের দলে তো চোটের কারণে ছিলেনই না তাসকিন ও শরিফুল। তাদের প্রসঙ্গ আবার এলো কেন!
অধিনায়কের কথাতেও দ্বিধা, দোলাচল। প্রথমে বললেন সাকিব-তামিমকে ছাড়া খেলতে নামা কঠিন বললে সেটা নেতিবাচক হয়ে যায়। পরে আবার ঠিকই বললেন অধিনায়ক হিসেবে তার কাজটা কঠিন হতে যাচ্ছে, 'কঠিন বলব না। কঠিন বললে নেতিবাচক হয়ে যায়। তবে আমাদের দলের গুরুত্বপূর্ণ যারা, সাকিব ভাই, তামিম ভাই… তামিম ভাই ওপরে ভালো খেললে আমাদের জন্য কাজটা সহজ হয়ে যায়। সাকিব ভাই একা দুইজনের সমান। তাসকিনের অবস্থা খুব খুব ভালো ছিল, দারুণ বল করছিল। সেদিক থেকে বলব যে চারটা ক্রিকেটার নেই। আমার কাছে মনে হয়, অধিনায়ক হিসেবে আমার জন্য কঠিন হবে। চ্যালেঞ্জিং হবে।'
'জুনিয়রদের জন্য এটা ভালো সুযোগ। হয়তো আমার, মুশফিক ভাইদের একটু বাড়তি দায়িত্ব নিয়ে খেলতে হবে। জুনিয়রদেরও বাড়তি দায়িত্ব নিতে হবে।'
বাংলাদেশ আসলে এই টেস্ট থেকে কি চায়? অধিনায়ক এমন প্রশ্নেও হাঁটলেন ঘুরপথে। জেতার কথা স্পষ্ট করে বলার সাহসটুকু বেরুলো না। আঁচ করে নেওয়া যায় কোনভাবে ম্যাচটা বাঁচাতে পারলে স্বস্তির হাসি চওড়া হবে মুমিনুলের, 'ফলাফল তো আমি না, সারা বাংলাদেশ চায়, আপনারাও চান। টেস্ট খেলতে গেলে দূরদর্শী চিন্তা করতে হবে। প্রথম থেকেই ফল না ভেবে আস্তে আস্তে এগোতে হবে। আমরাও সেভাবেই এগোচ্ছি। এই কারণেই আপনারা হয়তো সামনের সিরিজ বা পরের সিরিজে বুঝতে পারবেন যে কোন পথে এগোচ্ছে আমাদের টেস্ট ক্রিকেট।'
বাংলাদেশের ঠিক উলটো অবস্থানে সফরকারী পাকিস্তান। কোন কিছু নিয়েই তাদের দ্বিধা না দুনোমনো নেই। থাকার কথাও না। সংবাদ সম্মেলনে শুরুতে এসে অধিনায়ক বাবর আজম জানিয়ে দিলেন ১২ জনের দল। এই ১২ জন থেকে কোন এগারো জন নামবেন স্কোয়াডের দিকে তাকালেই বোঝা যাচ্ছিল। ব্যাটসম্যান কারো চোট সমস্যা না থাকলে আব্দুল্লাহ শফিক থাকবেন দ্বাদশ ব্যক্তি।
দুজন বিশেষজ্ঞ পেসারের সঙ্গে দুই স্পিনার, আছেন একজন পেস অলরাউন্ডার। পাকিস্তানের বোলিং অপশন পাঁচটি। বাংলাদেশ যেখানে বোলিং আক্রমণ ঠিক করতেই হিমশিম খাচ্ছে একাদশ সাজাতে পাকিস্তানকে বাইরে রাখতে হয়েছে মোহাম্মদ আব্বাস ও নাসিম শাহর মতো দুই পেসারকে।
দুই দলের মধ্যে দক্ষতা, সাম্প্রতিক পরিস্থিতির বিস্তর ফারাকের কথা বাবরেরও না বোঝার কারণ নেই। তবু ক্রিকেটীয় ভব্যতায় বাংলাদেশকে সমীহ করলেন তিনি, 'বাংলাদেশ দলে তারুণ্য ও অভিজ্ঞতার সমন্বয় আছে। হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই। ওরা জানে যে ওদের কন্ডিশনে খেলা। আমাদের চেষ্টা থাকবে শতভাগ দেওয়ার ও ভালো ক্রিকেট খেলার।'
'ওদের কয়েকজন সিনিয়র ক্রিকেটার নেই, দলটা খুব অভিজ্ঞ নয়। দলে আসা-যাওয়া করছে, এরকম ক্রিকেটার আছে বেশ কজন। তবে ওদেরকে সহজভাবে নেওয়া যাবে না। আমাদের পরিকল্পনা হলো হার্ড ক্রিকেট খেলার।'
শুক্রবার চট্টগ্রাম জহুর আহুমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ-পাকিস্তানের এই লড়াই শুরু হবে সকাল ১০টায়।
Comments