হুমায়ূন আহমেদের সেইসব চরিত্র
কথার জাদুকর হুমায়ূন আহমেদের নাটক, সিনেমা ও উপন্যাস থেকে একের পর এক উঠে এসেছে আলোচিত কিছু চরিত্র। এই চরিত্রগুলো দর্শক ও পাঠক হৃদয়ের গভীরে ঠাঁই করে নিয়েছে।
হিমু, মিসির আলী, বাকের ভাই, ছোট মীর্জা, মুনা, মতি, রূপা, আনিস, শুভ্র, ফরিদ মামা, আজগর, এলাচি, দোতারা চাচা ও কুসুম চরিত্রগুলো নিয়ে এখনও কথা হয়, আড্ডায় ঝড় উঠে।
নন্দিত লেখকের জন্মদিনে আজ সেইসব কালজয়ী কয়েকটি চরিত্রে কথা জেনে নেওয়া যাক।
বাকের ভাই
নব্বই দশকের সাড়া জাগানো নাটক 'কোথাও কেউ নেই' এর সবচেয়ে আলোচিত চরিত্র বাকের ভাই। এখনও বাকের ভাই চরিত্রটি মানুষের মনে গেঁথে আছে। এই চরিত্রে অভিনয় করে টিভি নাটকের ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত তৈরি করেছেন আসাদুজ্জামান নূর। আজও তাকে 'বাকের ভাই' বলে সম্বোধন করেন অনেকে। বাকের ভাইকে ফাঁসি দেওয়া হবে বলে এ দেশের রাজপথে মিছিল পর্যন্ত হয়েছিল।
আসাদুজ্জামান নূর বলেন, 'হুমায়ূন আহমেদের বড় শক্তি গল্প ও সংলাপ বলা। বাকের ভাই তার অনন্য সৃষ্টি। এই চরিত্রটি আমাকে সবখানে পরিচিতি এনে দিয়েছিল।'
মিসির আলী
হুমায়ূন আহমেদের আরেক আলোচিত চরিত্র মিসির আলী। মিসির আলীর মূল বিশেষত্ব হচ্ছে তিনি যুক্তি দিয়ে সবকিছু করেন। যুক্তি ছাড়া কিছু করেন না। যেকোনো সমস্যার সমাধান করার আগে অনেক ভাবেন, পড়ালেখা করেন, সবশেষে সুন্দর যুক্তি তুলে ধরেন। এজন্যই মিসির আলীর প্রতি পাঠকদের বাড়তি ভালোবাসা আছে।
মিসির আলী চরিত্র নিয়ে নির্মিত নাটকে অভিনয় করেছিলেন আবুল হায়াত। অপরদিকে, মিসির আলী চরিত্রটিকে সিনেমায় রূপ দিয়েছেন চঞ্চল চৌধুরী।
চঞ্চল চৌধুরী বলেন, 'মিসির আলী চরিত্রটি আমার জীবনের ভালো কাজগুলোর একটি। সত্যিই, যুক্তি দিয়েই সব সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। মিসির আলীর কারিগর হুমায়ূন আহমেদের প্রতি আমার ভালোবাসা আজীবন থাকবে।'
মুনা
'কোথাও কেউ নেই' নাটকের অন্যতম প্রধান চরিত্র মুনা। মুনাকে ঘিরেই নাটকটির গল্প এগিয়ে যায়। 'কোথাও কেউ নেই' উপন্যাসেও তাই। 'কোথাও কেউ নেই' নাটকের নামকরণও সার্থক মুনার জন্য। কেননা- মুনার আসলেই কেউ নেই। মুনা মামার বাড়িতে আশ্রিতা মেয়ে। অপরদিকে, মুনা মামুন নামের এক যুবককে ভালোবাসতেন। মামুন একসময় বিয়ে করে ফেলেন। মুনা ভীষণ একা হয়ে যান। একসময় বাকের ভাইকে ভালো লাগে মুনার। কিন্তু নিয়তির লিখনে বাকের ভাই তার কপালে নেই।
বাকের ভাইয়ের ফাঁসি হয়ে যায়। মুনা আবারও একা হয়ে পড়ে। এই চরিত্রে অভিনয় করে তুমুল সাড়া ফেলেছিলেন সুবর্ণা মুস্তাফা।
তিনি বলেন, 'মুনা চরিত্রটি আসলেই একটি ভালো চরিত্র ছিল আমার জন্য। অভিনয় করার সুযোগ ছিল প্রচুর। আমি চেষ্টা করেছিলাম কাজটি নিখুঁতভাবে করার জন্য।'
রূপা
হুমায়ূন আহমেদের অনেক উপন্যাসের নায়িকার নাম রূপা। হিমুর নায়িকার নামও রূপা। হিমু ভক্তরা ভালো করেই জানেন- রূপা প্রচণ্ড ভালোবাসে হিমুকে। হিমুও মাঝে মাঝে রূপার সঙ্গে দেখা করার জন্য রূপাদের বাড়ির সামনে গিয়ে অপেক্ষা করে। সেসময় রূপা বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। রূপার পছন্দ নীল শাড়ি। বই মেলায় কেউ কেউ আজও নীল শাড়ি পরে ঘুরে বেড়ায়। মনের অজান্তেই কেউ তখন বলে উঠেন, ওই যে রূপা যাচ্ছে- হিমুর নায়িকা যাচ্ছে। 'রূপা' নামের একটি উপন্যাসও আছে এই লেখকের। 'আমি হিমু হতে চাই' নামের একটি নাটক নির্মিত হয়েছিল। এই নাটকে রিচি সোলায়মান রূপা চরিত্রটি করেছিলেন।
হিমু
হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্ট চরিত্রগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয়তা পাওয়া চরিত্রের নাম হিমু। হিমু বিষয়ক প্রথম বই 'ময়ূরাক্ষী'। আজও হিমুর জনপ্রিয়তা কমেনি। হিমু সবসময় হলুদ পাঞ্জাবি পড়ে। সেই পাঞ্জাবির পকেট নেই। হিমু খালি পায়ে ঘুরে বেড়ায়। শহরময় কখনও কখনও হাঁটে। উপন্যাসের হিমুর প্রতি লাখো পাঠকের ভালোবাসা প্রবল। তাই আজও হিমুর নতুন উপন্যাসের অপেক্ষায় থাকেন পাঠকরা। কিন্তু হিমু বিষয়ক নতুন কোনো বই আর কখনোই আসবে না। তাই বলে নতুন নতুন হিমু আসবে না তা নয়। 'নক্ষত্রের রাত' নাটকে হিমু চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন ফজলুল কবির তুহিন।
ফরিদ মামা ও আজগর
ফরিদ মামা ও আজগর চরিত্র দুটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল টেলিভিশন নাটকের দর্শকদের কাছে। দুটি চরিত্রে অভিনয় করে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন প্রয়াত অভিনেতা আলী যাকের। আজগর চরিত্রটি 'আজ রবিবার' নাটকের। ফরিদ মামা চরিত্রটি 'বহুব্রীহি' নাটকের। আজ রবিবার নাটকে আজগর সবসময় ঘরে থাকেন। ঘরে বসে নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেন। মাঝে মাঝে তার ঘরের দরজায় উঁকি মারেন মতি (ফারুক আহমেদ)। যতবার উঁকি মারেন ততবার চড় খেতে হয় তাকে।
কুসুম
'শ্রাবণ মেঘের দিন' সিনেমাটি বিভিন্ন কারণেই একটি আলোচিত সিনেমা। সুধী মহলে এই সিনেমাটি ব্যাপকভাবে প্রশংসিত। হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত সিনেমা এই সিনেমার আবেদন এখনও দর্শকদের মাঝে রয়ে গেছে। 'শ্রাবণ মেঘের দিন' সিনেমায় কুসুম চরিত্রে অভিনয় করে দর্শকপ্রিয়তা পান মেহের আফরোজ শাওন। দর্শকরা ওই সময় কুসুম বলে ডাকতেন তাকে।
মতি
হুমায়ূন আহমেদের সবচেয়ে বেশি নাটকে অভিনয় করেছেন ফারুক আহমেদ। নানারকম চরিত্রে অভিনয় করেছেন এই অভিনেতা। কিন্তু ফারুক আহমেদ সবচেয়ে বেশি পরিচিতি লাভ করেছেন মতি চরিত্রে অভিনয় করে। এজন্য দর্শকরাও তাকে মতি বলে ডাকতেন। হুমায়ূন আহমেদও ফারুক আহমেদকে ডাকতেন মতি বলে।
তিনি বলেন, 'হুমায়ূন আহমেদের সবচেয়ে বেশি নাটকে অভিনয় করার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। "আজ রবিবার" নাটকের মতি চরিত্রটির কথা এখনও অনেকে বলেন আমাকে। এই নাটকের পর হুমায়ূন আহমেদও আমাকে মতি নামেই ডাকতেন।'
আনিস
হুমায়ূন আহমেদের বেশ কয়েকটি উপন্যাসের নায়কের নাম আনিস। আনিস চরিত্রটি মূলত নিম্ন-মধ্যবিত্ত ঘরের একজন তরুণের। অপরদিকে, 'আজ রবিবার' ধারাবাহিক নাটকের নায়কের নামও আনিস। যে কিনা সারাক্ষণ ঘরে বসে পড়ালেখা করে, চশমা ছাড়া কিছুই দেখে না। শিলা আহমেদ ও মেহের আফরোজ শাওন আনিসকে ভয় দেখানোর জন্য সবসময় পেছনে লেগেই থাকে। আনিস চরিত্রে 'আজ রবিবার' নাটকে অভিনয় করেছিলেন জাহিদ হাসান।
তিনি বলেন, 'ওই নাটকটি যেমন জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, একইভাবে আমার চরিত্রটি দর্শকদের মনে বড় একটি জায়গা করে নিয়েছিল।'
নান্দাইলের ইউনুস ও মনা ডাকাত
'মাটির পিঞ্জিরা' নামের এক ঘণ্টার একটি নাটকের আলোচিত চরিত্রের নাম নান্দাইলের ইউনুস। এই চরিত্রে অভিনয় করে সাড়া ফেলেছিলেন আসাদুজ্জামান নূর। 'নিমফুল' নাটকের মনা ডাকাত চরিত্রটিও আরেকটি আলোচিত চরিত্র। আসাদুজ্জামান নূর এই চরিত্রটিও করেছিলেন।
ছোট মীর্জা ও এলাচি বেগম
'অয়োময়' নাটকের ছোট মীর্জা চরিত্রটির কথা অনেকেরই মনে থাকার কথা। ছোট মীর্জা চরিত্রটি হুমায়ূন আহমেদের লেখা আলোচিত একটি চরিত্র। এই চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন আসাদুজ্জামান নূর। এলাচি চরিত্রে রূপদান করেছিলেন সারা যাকের। এই নাটকে জমিদারের লাঠিয়ালের
চরিত্রটিও দর্শকরা সাদরে গ্রহণ করেছিলেন। লাঠিয়াল কারণে–অকারণে কাশি দিতো। অধ্যাপক মোজাম্মেল হোসেন অভিনয় করেছিলেন লাঠিয়াল চরিত্রে। মদিনা চরিত্রটিও কম আলোচিত হয়নি। তারানা হালিম অভিনয় করেছিলেন মদিনা চরিত্রে।
দোতারা চাচা
দোতারা চাচা চরিত্রে অভিনয় করে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছিলেন চ্যালেঞ্জার। নাটকটির নাম 'উড়ে যায় বকপক্ষি'। সেই থেকে চ্যালেঞ্জারকে অনেকেই দোতারা চাচা বলে ডাকতেন। আজও দোতারা চাচা উজ্জ্বল হয়ে আছেন চরিত্রটির জন্য।
শুভ্র
শুভ্র চরিত্রটিও একটি আলোচিত চরিত্র। বেশ কয়েকটি উপন্যাসের নায়কের নাম শুভ্র। হুমায়ূন আহমেদ শুভ্র চরিত্রটিকে একটু অন্যভাবে সৃষ্টি
করেছেন। দারুচিনি দ্বীপ চলচ্চিত্রটি যারা দেখেছেন, তারা খুব ভালো করেই জানেন শুভ্র চরিত্রটি কীরকম। রিয়াজ এই সিনেমায় শুভ্র চরিত্রে অভিনয় করে সুনাম অর্জন করেছিলেন। তিনি বলেন, 'শুভ্র খুব প্রিয় একটি চরিত্র। ভীষণ এনজয় করেছিলাম কাজটি করার সময়।'
নীলু
'এইসব দিনরাত্রি' নাটকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্রের নাম নীলু। এটিও হুমায়ূন আহমেদের আলোচিত একটি চরিত্র। নীলু চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন ডলি জহুর।
Comments