‘প্রশ্নফাঁস একটা সিস্টেমেটিক টেন্ডেন্সি, যা ক্ষমতার সঙ্গে সম্পর্কিত’

ql_mamun_12nov21.jpg
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ এবং ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির সাবেক সদস্য সচিব ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মো. মোশাররফ হোসেন খান (বাম থেকে)

বাংলাদেশে প্রথম শ্রেণি থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষাসহ প্রায় সব প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় নিয়মিত প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটছে। এ ছাড়া, বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষায়ও উঠেছে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ।

সর্বশেষ প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ ওঠার পর বাংলাদেশ ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির আওতায় ৫ ব্যাংকের কর্মকর্তা (ক্যাশ) পদে গত শনিবার অনুষ্ঠিত হওয়া প্রিলিমিনারি পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছে। ওই দিন দুপুর ৩টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ১ হাজার ৫১১টি পদের বিপরীতে অনুষ্ঠিত পরীক্ষায় অংশ নেন ১ লাখ ১৬ হাজার ৪২৭ জন চাকরিপ্রত্যাশী। আহছানউল্লাহ ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটি পরীক্ষাটি সম্পাদন করে।

এ অবস্থায় একের পর প্রশ্নপত্র ফাঁসের কারণ, এর ফলাফল ও প্রতিকার নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ এবং ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির সাবেক সদস্য সচিব ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মো. মোশাররফ হোসেন খানের সঙ্গে।

এ বিষয়ে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, 'আমাদের এখানে কর্মসংস্থানের সুযোগ এত কম যে, মানুষ যে কোনো ধরনের এমপ্লয়মেন্টের জন্য, বা কোথাও অ্যাডমিশনের জন্য যে কোনো রকম খরচ করতে প্রস্তুত আছে। কারণ সবাই জানে যে, এটা একটা ভীতির জায়গা। প্রতিযোগিতা এত বেশি যে সাধারণভাবে পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতিকে তারা যথেষ্ট মনে করে না। মনে করে আরও কিছু লাগবে। আবার অনেকে ধারণা করে, সে দুর্নীতির এই সুযোগ না নিলে অন্য কেউ সেখানে ঢুকে যাবে। সুতরাং একটি বিষয় হচ্ছে, কাজের ঘাটতি। এমপ্লয়মেন্ট জেনারেশন হচ্ছে না। আর অন্যটি হচ্ছে একটি কালচার এখানে ডেভেলপ করেছে যে, টাকা ছাড়া কোনো কাজ হয় না।'

তাই প্রশ্নফাঁসের বিষয়টি কেবল শাস্তি দিয়ে দূর করা যাবে না মন্তব্য করে এই শিক্ষাবিদ বলেন, 'এর জন্য এই কালচারটাই দূর করতে হবে। এমপ্লয়মেন্ট বাড়াতে হবে। সুযোগ বাড়াতে হবে।'

তিনি আরও বলেন, 'এর সঙ্গে জড়িতদের আমরা নিশ্চয়ই শাস্তি দেবো। সতর্কতা, নজরদারির কথা বলবো। কিন্তু এগুলো যথেষ্ট না। আমরা এটা জানবো যে, মূল সমস্যা হচ্ছে এমপ্লয়মেন্ট জেনারেশন। মানুষ যাতে বুঝতে পারে তার একটা সুযোগ আছে। ন্যাচারাল একটি রাইট আছে।'

এ ছাড়া, যথাযথ কর্তৃপক্ষের দায়িত্বশীলতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, 'যারা দায়িত্বে আছেন তারা কঠোর নন। উপরের দিকেই বেশি দুর্নীতি হয় বলে নিচের দিকেও এটা হয়। কেবল নিচের লোকেরা শাস্তি পায়, আবার সাহসও পায়। এই কারণে যে, তারা উপরের লোকদের কনসেন্ট পাবে মনে করে। এভাবে এটা একটি সিন্ডিকেট হয়ে গেছে। একটি বিজনেস হয়ে গেছে। এই চক্রটা ভাঙা দরকার।'

এ ব্যাপারে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, 'স্কুল পর্যায় থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ে যে নিয়োগ সেটা এখন একটি অর্থনৈতিক তৎপরতায় পরিণত হয়েছে। বাণিজ্যের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। যেহেতু সব ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ভয়ঙ্কর অভাব, সেহেতু যে যেখানে আছে, সে সেখানে থেকেই এই সুযোগটা নিচ্ছে।'

এই অর্থনীতিবিদ বলেন, 'এই ঘটনাগুলো খুব নিম্নস্তরে, হঠাৎ করে ‍দুর্ঘটনাবশত ঘটছে বা কিছু অসাধু লোক এটা করছেন— বিষয়টি এমন না। এটি এখন একটা সিস্টেমেটিক টেন্ডেন্সিতে পরিণত হয়েছে। যা ক্ষমতার সঙ্গে সম্পর্কিত।'

এ বিষয়ে তার পর্যবেক্ষণ হলো, 'চাকরিপ্রার্থীরা তো একটি দুর্বল অবস্থায় থাকে। নাজুক অবস্থায় থাকে। তাদের সেই নাজুক অবস্থাকে ব্যবহার করে অর্থ উপার্জনের একেকটা নেটওয়ার্ক গড়ে উঠছে। এটা আমরা অনেক ক্ষেত্রেই দেখতে পাচ্ছি। মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা নাগরিকদের পক্ষ থেকে একবার গণতদন্ত কমিশন গঠন করেছিলাম। সেখানে আমরা দেখেছিলাম, উপর থেকে একটি পৃষ্ঠপোষকতার ভেতর দিয়ে এমন নেটওয়ার্ক গড়ে উঠে।'

প্রশ্নফাঁসের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার উপায় প্রসঙ্গে আনু মুহাম্মদ বলেন, 'যারা নীতি নির্ধারণ করেন, যারা ক্ষমতায় আছেন তাদের হাতেই এর সমাধান আছে। যিনি চাকরির খোঁজ করছেন, তিনি তো একটি অস্থির অবস্থার মধ্যে থাকেন। বেপরোয়া অবস্থার মধ্যে থাকেন। তার কাছে যখন খবর আসে, এত লাখ টাকা দিলে প্রশ্ন পাওয়া যাবে কিংবা চাকরি পাওয়া যাবে তখন তার পক্ষে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয় না। তাই তাদের থামানো কিংবা উপদেশ দেওয়ার কোনো অর্থ নেই।'

'এই যে বিশ্বাসটা সমাজে তৈরি হয়েছে, টাকা না দিলে চাকরি হবে না। টাকা না দিলে ভর্তি হওয়া যাবে না— এটি একটি ভয়ঙ্কর বিষয়। এই বিশ্বাসের একটি ভিত্তি আছে। বিশ্বাসযোগ্যতাও আছে। তাই পরামর্শে কাজ হবে না', বলেন তিনি।

আনু মুহাম্মদ বলেন, 'এটি থামানোর পথ হলো, সব ক্ষেত্রে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা। আর মিডিয়া যদি আরও মনোযোগী হয়, নাগরিকদের পক্ষ থেকে বিষয়টি একটি নজরদারির মধ্যে রাখা হয় তাহলে হয়তো ক্ষমতাবানদের কিছু বোধোদয় হবে, কিছু পরিবর্তন আসবে।'

এদিকে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে নিজের দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন ব্যাংকারস সিলেকশন কমিটির সাবেক সদস্য সচিব ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মো. মোশাররফ হোসেন খান

তিনি বলেন, 'আমি যখন দায়িত্ব নেই তখন আমার প্রধান ডিটারমিনেশন ছিল আমি সততা ও আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করবো। আগে আমি নিজেকে শক্ত করলাম। একমাত্র প্রধানমন্ত্রী ও বিচারপতিরা ছাড়া আমাকে ফোন করেনি এমন কোনো মানুষ ছিল না। কিন্তু সব ক্ষেত্রে আমি আমার সিদ্ধান্তে, অবস্থানে অনড় ছিলাম।'

তিনি আরও বলেন, 'দায়িত্ব নিয়ে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সম্পর্কে একটু খোঁজ-খবর নেওয়া শুরু করলাম। তথ্য নেওয়ার পর এই জাতীয় সমস্যা যাদের ছিল, তাদের আমি অ্যাভয়েড করেছি।'

এ ছাড়া, প্রশ্নফাঁস যাতে না হয় তার জন্য কেন্দ্র বাছাইও একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার বলে মন্তব্য করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তিনি বলেন, পরীক্ষার জন্য মোটামুটি নিউট্রাল সেন্টার বাছাই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমার সময়ে তেজগাঁও কলেজ একটি সমস্যাপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত ছিল। ওই কেন্দ্র আমি নিজেই দেখভাল করতাম। আমি নিজেই লিড দিতাম। সেটা ১ ঘণ্টার পরীক্ষা হোক আর ৩ ঘণ্টার পরীক্ষা হোক।'

এদিকে শনিবার প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে আহছানউল্লাহ ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির ৩ কর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। একই ঘটনায় পূবালী ব্যাংকের একজন প্রিন্সিপাল অফিসারও বরখাস্ত হয়েছেন।

এ ছাড়া, সরকারি ব্যাংকে চাকরির পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় আহছানউল্লাহ ইউনিভার্সিটির কাছে ব্যাখা চেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়টিকে কেন কালো তালিকাভুক্ত করা হবে না, তা জানতে চিঠি দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অধীনে থাকা ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটি।

এ ব্যাপারে মোশাররফ হোসেন খান বলেন, 'যারা সাসপেনশনের কথা বলা হচ্ছে তাদের সরাসরি বের করে দেওয়া উচিত। সরাসরি টার্মিনেশন। নট সাসপেনশন। এ ছাড়া, এই ঘটনায় জড়িত যেসব কর্মকর্তা চাকরিতে আছেন, তাদের সনদ বাতিল করতে হবে। যাতে আর কেউ ভবিষ্যতে এই ধরনের কাজ করতে সাহস না পায়।'

তিনি আরও বলেন, 'শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান কে— সেটাও একটি ফ্যাক্টর। তিনি কি এমপি সাহেবের জামাই নাকি নিজের যোগ্যতায় ওই জায়গায় গেছেন সেটাও প্রশ্ন।'

Comments

The Daily Star  | English

Khaleda acquitted in Zia Charitable Trust graft case

The HC scraped the trial court verdict that sentenced Khaleda and two others in the same case.

1h ago