‘ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষা ও দুর্নীতির কারণেই রাতারাতি মূল্য বৃদ্ধি’
হঠাৎ করেই ডিজেল ও কেরোসিন তেলের দাম প্রতি লিটারে ১৫ টাকা বাড়িয়েছে সরকার। এর প্রভাবে পরিবহন খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম আরও বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এতে করে জীবনযাপনে বেগ পেতে হবে সাধারণ মানুষকে।
দাম বৃদ্ধি ও এর প্রভাবসহ সার্বিক বিষয় নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার টেলিফোনে কথা বলেছে অর্থনীতিবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রফেসর আনু মুহাম্মদ এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের প্রফেসর ড. মিজানুর রহমানের সঙ্গে।
দুজনেই বলেছেন, বিশ্ববাজারে তেলের দাম যখন কম ছিল তখন সরকার দেশে তেলের দাম তেমনভাবে না কমিয়ে অনেক মুনাফা করেছে। এই পরিস্থিতিতে চাইলে সরকার কিছুটা ভর্তুকি দিয়ে দাম ঠিক রাখতে পারতো।
আনু মুহাম্মদ ডিজেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বৃদ্ধির জন্য ব্যবসায়ীদের স্বার্থরক্ষা ও বিভিন্ন প্রকল্পের দুর্নীতিকে দায়ী করেছেন। মিজানুর রহমান বলছেন, ডিজেলের দাম বৃদ্ধির অন্যতম কারণ অন্যদেশে পাচার হওয়া।
প্রফেসর আনু মুহাম্মদ বলেন, 'আমাদের দেশের নির্মাণ ব্যয় বিশ্বের যেকোনো দেশের চেয়ে অনেক বেশি। মেগা প্রকল্পগুলোতে অনেক বেশি দুর্নীতি হয়। এ জন্য সরকারের টাকাও বেশি প্রয়োজন হয়। আর এই টাকার সোর্স মূলত জনগণ। তাই বাজেটের ঘোষণার বাইরেও সরকার নানাভাবে জনগণের কাছ থেকে টাকা আদায় করে নেয়।'
তিনি আরও বলেন, 'দাম বাড়ালে মানুষ কীভাবে বাঁচে, কতভাবে বাঁচতে পারে— সেটা পরীক্ষা করার জন্য সরকার বিভিন্ন জিনিসের দাম বাড়াচ্ছে। সরকার মানুষের ধৈর্য শক্তি পরীক্ষা করছে। বিভিন্ন পণ্যের দাম বৃদ্ধি করা সরকারের একটি নিয়মিত কাজ। দাম কমানো সম্ভব হলেও সরকার দাম কমায় না। সরকারের নীতি পরিবর্তন করলে বিভিন্ন জিনিসের দাম পরিবর্তন করা যে সম্ভব এটা বহুবার প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু, সরকার সে পথে হাটতে রাজি না।'
'তেলের দাম যখন বিশ্ব বাজারে অনেক কম ছিল সরকার তখন দাম না কমিয়ে প্রচুর মুনাফা করেছে। এখন আন্তর্জাতিক বাজারে কিছুটা দাম বেড়েছে, সেই অজুহাতে সরকার দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। এটা কাম্য নয়,' যোগ করেন তিনি।
আনু মুহাম্মদ বলেন, 'দাম বাড়ানোর প্রভাব কয়েকগুণ পড়বে। ডিজেলের দাম বাড়লে মানুষের পরিবহন ব্যয় বাড়বে এবং পণ্য পরিবহণ ব্যয় বাড়বে। এর ফলে দেখা যাবে অন্যান্য জিনিসের দামও বেড়ে যাবে।'
তিনি বলেন, 'এটা বিস্ময়কর যে, করোনার কারণে যখন অনেক মানুষ দরিদ্রতার শিকার হয়েছেন, তখন বাজারে দাম বেড়েছে। সরকার সেই দাম কমানোর ব্যবস্থা না নিয়ে দাম যেন আরও বাড়ে সেই ব্যবস্থা রাতারাতি করে ফেললো। এর ফলে উৎপাদনশীল সব কাজে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে।'
ডিজেলের দাম বৃদ্ধি কৃষকের ওপর কতটা প্রভাব ফেলবে—জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'এমনিতেই কৃষক যে পণ্য উৎপাদন করে এবং যে দাম পায় তার মধ্যে অনেক অসামঞ্জস্য রয়েছে। তারা অনেক সময় উৎপাদন খরচও উঠাতে পারেন না। ডিজেলের দাম বৃদ্ধির ফলে কৃষক আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।'
এই সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'সরকারের বাইরে কেউ এই সমস্যার উত্তরণ ঘটাতে পারবে না। যাদের সুযোগ আছে তারা এখন আয় বাড়ানোর জন্য দুর্নীতি বাড়িয়ে দেবে। সরকারের ঘাড়টা যদি জনগণের দিকে বিন্দুমাত্র থাকতো তাহলে বিবেচনা অন্যরকম হতো। কিন্তু সরকার জনগণ নিয়ে তেমন ভাবে না। জনগণ নিয়ে সরকারের তেমন মাথা ব্যথা নেই।'
'জনগণকে উপেক্ষা করে কিছু করপোরেট গ্রুপের স্বার্থ দেখা কিংবা বড় বড় প্রকল্পে দুর্নীতির বোঝা যে সরকার জনগণের ওপর চাপাচ্ছে এই নীতি কাঠামো পরিবর্তন করা ছাড়া এই সমস্যা থেকে উত্তরণের কোনো উপায় নেই। এই নীতি কাঠামো পরিবর্তনে সরকার যেন বাধ্য হয় সে জন্য নাগরিকদের আরও সোচ্চার হতে হবে,' তিনি যোগ করেন।
প্রফেসর ড. মিজানুর রহমান বলেন, 'বিশ্ববাজারে যখন তেলের দাম কম ছিল তখন সরকার অনেক মুনাফা করেছে। দেশের এই পরিস্থিতিতে সরকার ডিজেলের দাম না বাড়িয়ে কিছুটা ভর্তুকি দিতে পারতো।'
তিনি বলেন, 'বিভিন্ন জিনিসের দাম বৃদ্ধির ফলে যাদের আয় নির্ধারিত তাদের সংকটটা অনেক বেশি। সব কিছুর দাম বাড়ছে, কিন্তু বেতন তো আর বাড়ছে না।'
তিনি আরও বলেন, 'তেলের দাম বৃদ্ধির প্রভাব পড়বে বাজারে। কারণ পণ্য পরিবহনে খরচ বাড়বে।'
ডিজেল পাচারকেই ডিজেলের দাম বৃদ্ধির অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন ঢাবির মার্কেটিং বিভাগের এই শিক্ষক।
তিনি বলেন, 'দেশে করোনার কারণে বর্তমানে যে মন্দা অবস্থা চলছে, এই মুহূর্তে সবকিছুর দাম না বাড়িয়ে কিছুটা বিলম্বিত করলে সবার সুবিধা হতো। বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধিটা হয়তো সাময়িক। এই সাময়িক সময়টা যদি কোনোভাবে উতরানো যেত তাহলে ভালো হতো।'
ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধিতে কৃষির ওপর প্রভাব পড়বে উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'সামনে বোরো মৌসুম আসছে। যারা ডিজেল ব্যবহার করে জমিতে সেচ দেন তাদের ভর্তুকি দেওয়া যেতে পারে এবং আমি আশা করবো এটা শুরু হওয়া উচিত।'
তেলের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কোনো আলোচনা না করে পরিবহন শ্রমিকদের ধর্মঘটে যাওয়া উচিত হয়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে এই সমস্যার সমাধান করা যেতো। একটি গাড়ি চালালে তেল বাবদ কী পরিমাণ খরচ হয় সেই অনুপাতে তেলের দাম বৃদ্ধির পর কত খরচ আসবে সেই অনুযায়ী ভাড়া নির্ধারণ করা যেতে পারে।'
'সরকারও চাইলে এই সমস্যা দ্রুত সমাধান করতে পারতো। কিন্তু সরকার কেন তা করছে না বা বিলম্বিত করছে তা বুঝতে পারছি না,' তিনি যোগ করেন।
Comments