জলবায়ু সম্মেলন: পুরনো বিতর্ক ও উন্নয়নশীল দেশের ক্ষতিপূরণ
স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে ১ নভেম্বর থেকে কপ২৬ জলবায়ু সম্মেলন শুরু হয়েছে। কপ২৬ হচ্ছে 'কনফারেন্স অব দি পার্টিস'র সংক্ষিপ্তরূপ। জাতিসংঘের উদ্যোগে গঠিত কপের প্রথম সম্মেলন হয়েছিল ১৯৯৫ সালে, এবার হচ্ছে ২৬তম। এই সম্মেলন চলবে ১২ নভেম্বর পর্যন্ত। এর সাফল্যের ওপর নির্ভর করছে বিশ্বকে বিপর্যয় হাত থেকে কতটা বাঁচানো যাবে।
কেন এই গ্লাসগো সম্মেলন?
প্রধানত শিল্পোন্নত দেশগুলো দীর্ঘদিন ধরে তেল-গ্যাস-কয়লা পোড়ানোর ফলে বিপুল পরিমাণ ক্ষতিকারক কার্বন পরিবেশে ছড়িয়ে দিচ্ছে। এর ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে আবহাওয়া চরমভাবাপন্ন হচ্ছে। এতে বনে আগুন লাগছে, ঝড়-বন্যা হচ্ছে, অতি শীত-গরম হচ্ছে, বরফ গলে নিম্নাঞ্চল হুমকির মুখে ফেলছে, প্রাকৃতিক বিপর্যয় বাড়ছে প্রভৃতি।
এই পরিবর্তন ঠেকাতে জরুরিভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ উদ্যোগ দরকার। এ লক্ষ্যে ২০০ দেশের প্রতিনিধি ও বিশ্বের ক্ষমতাধর শক্তিসহ ১২০ দেশের রাষ্ট্রনেতারা সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছেন। এ ছাড়া, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা, পরিবেশ সংগঠন, বেসরকারি সংস্থার প্রায় ২৫ হাজার প্রতিনিধি যোগ দিয়েছেন।
কী উদ্দেশ্য নিয়ে এই সম্মেলন?
এই সম্মেলন কয়েকটি লক্ষ্যমাত্রা ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে হচ্ছে:
- জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার নীতি গ্রহণ
- কয়লার ব্যবহার দ্রুত কমিয়ে আনা
- বনভূমি রক্ষা করা
- বৈদ্যুতিক যানবাহন চালু করা ও নবায়নযোগ্য শক্তিতে অধিক বিনিয়োগ করা
বিশ্বের সব দেশকে ২০৩০ সালের মধ্যে জলবায়ু রক্ষায় কার্বন নিঃসরণ কমানোর (১.৫%) কথা বলা হচ্ছে এবং ২০৫০ সালের মধ্যে তা শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসার অঙ্গীকার করার জন্য গ্লাসগোর সম্মেলনের আহ্বান করা হয়েছে।
চীন-রাশিয়ার রাষ্ট্রপ্রধানের অনুপস্থিতি কীসের ইঙ্গিত?
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এই সম্মেলনে অংশ নেননি। এজন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনসহ বিশ্বনেতারা তাদের প্রচণ্ড সমালোচনার করেছেন। তারা অংশ না নিলেও ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত চলা এই সম্মেলনের আলোচনায় অংশ নিতে দুই দেশই তাদের প্রতিনিধি পাঠিয়েছে।
বিশ্বে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণকারী দেশ চীন (২৮%), তারপরের অবস্থানে যুক্তরাষ্ট্র, তিনে আছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চারে ভারত এবং পাঁচ নম্বরে রাশিয়া। তার মানে জলবায়ু রক্ষায় চীনের একটা বড় দায় আছে। এই সম্মেলনে সব দেশকেই অঙ্গীকার করতে হবে। কীভাবে, কতদিনের মধ্যে সম্মেলন নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার কত শতাংশ তারা কার্বন কমাবে। চীনকেও সে অঙ্গীকার করতে হবে, রাশিয়াও তার বাইরে নয়। বেধে দেওয়া কোনো বাধ্যবাধকতার দায় এড়াতেই হয়তো তারা সেখানে অনুপস্থিত।
জলবায়ু পরিবর্তনের পুরনো বিতর্ক
জলবায়ু ও পরিবেশের ক্ষতি নিয়ে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর একটি বড় বিতর্কের বিষয় হচ্ছে, কে বা কারা অধিক কার্বন নিঃসরণ ও জলবায়ুর ক্ষতির জন্য দায়ী। উন্নত দেশগুলো এজন্য হালের শিল্পোন্নত ও অধিক জনসংখ্যার দেশ চীন-ভারতকে দায়ী করে থাকে। তাদের যুক্তি এদের জনসংখ্যা বেশি, ভোগও বেশি সুতরাং এরাই পরিবেশ বিপর্যয়ে অধিক দায়ী।
অন্যদিকে, উন্নয়নশীল দেশগুলোর বক্তব্য- শিল্প বিপ্লবের পর উন্নত দেশগুলো প্রচুর জ্বালানি ব্যবহার করে মুনাফার নামে পরিবেশ ও জলবায়ুর অধিক ক্ষতি করেছে এবং সে কাজটি করা হয়েছে কয়েকশ বছর ধরে তেল-গ্যাস-কয়লা পোড়ানোর মাধ্যমে। চীন-ভারতসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোর শিল্পায়নের ইতিহাস ৫০-৬০ বছরের। পশ্চিমারা সে কাজ করে এসেছে তিনশ-চারশ বছরের অধিক সময় ধরে। অতএব পরিবেশ বিপর্যয়ের দায় তাদেরই অধিক নিতে হবে।
উন্নয়নশীল দেশগুলো পরিবেশ রক্ষার প্রবল চাপের মধ্যে পড়ে এখন শিল্পায়নে পিছিয়ে পড়ছে, আর্থিক দিক থেকে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। কার্বন নিঃসরণের লক্ষ্যমাত্রার ছকে রাখতে যে ক্ষতিপূরণ ও সহযোগিতার কথা ছিল তা করা হয়নি।
উন্নয়নশীল দেশগুলো যখন উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে, তখন পরিবেশ রক্ষার কথা বলে তাদের পিছনে ফেলার চেষ্টা চলছে। প্রতিযোগিতা ও রপ্তানি বাণিজ্যে চাপে পড়াতে তারা জলবায়ু ও পরিবেশ বিপর্যয়ের কথা বলছে। এমন ভাবনা-ক্ষতির কথা কেন অনেক আগে থেকে আসেনি ইত্যাদি।
এ আলাপ-বিতর্ক যৌক্তিক হলেও জলবায়ু বিষয়ের গবেষণা অনেক দিনের নয়। যখন থেকে বিজ্ঞানীরা বিষয়টি জানতে পেরেছেন, তখন থেকে এ আলাপ-জনমত প্রবল হয়েছে। পরিবেশবাদীরা সংগ্রাম করছেন, অতঃপর বিশ্বের ক্ষমতাধর শাসকরা সতর্ক হয়েছেন। জাতিসংঘ জলবায়ু ও পরিবেশ রক্ষার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, নানা কর্মসূচি নিয়েছে। তারই ধারাবাহিতা আজকের এই জলবায়ু সম্মেলন।
বাংলাদেশের জন্য এ সম্মেলন কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
বাংলাদেশ এই ঝুঁকির তালিকায় থাকা শীর্ষ দেশগুলোর একটি। বৈশ্বিক জলবায়ু ঝুঁকির সূচক-২০২১ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়। জলবায়ুর পরিবর্তন জনিত দুর্যোগের ক্ষতির তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম এবং অর্থনৈতিক ক্ষতির হিসাবে এর অবস্থান পঞ্চম।
জার্মানভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা জার্মানওয়াচ সম্প্রতি এ তথ্য প্রকাশ করে। গত ২০ বছরের ১৮০টি দেশের জলবায়ু পরিবর্তনের তথ্য নিয়ে এ গবেষণা করা হয়েছে। জাতিসংঘের ইউনিসেফের একাধিক প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশের শিশুরা এই ঝুঁকির তালিকায় ১৫তম। কারণ যেকোনো দুর্যোগে তাদের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। আর বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের বরফ গলে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি কবে ভূ-ভাগের নিম্নাঞ্চলকে ক্রমশ তলিয়ে দেবে। এতে সমুদ্র উপকূল, লোকালয় ও আবাদি জমির ক্ষতি হবে। সে ঝুঁকিতেও বাংলাদেশ শীর্ষে। সুতরাং বাংলাদেশের জন্য এ সম্মেলন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এই সম্মেলন আমাদের জীবনে কী প্রভাব ফেলতে পারে?
বিশ্বনেতারা যদি তাদের গৃহীত সিদ্ধান্ত পর্যায়ক্রমে অগ্রসর করতে পারেন- তাহলে এখান থেকে নির্ধারিত হতে পারে-
- আমরা আর কতদিন পেট্রল বা ডিজেলচালিত গাড়ি চালাতে পারব?
- প্রচণ্ড শীত ও গরমে আমরা গ্যাস ব্যবহার করতে পারব কিনা, তা ঠিক হতে পারে।
- ঘন ঘন দেশ-বিদেশের বিমান ভ্রমণ কঠিন হয়ে যেতে পারে।
- আমাদের নিত্যদিনের ভোগ-বিলাসিতায় অনেক কিছুর পরিবর্তন আসতে পারে।
কতটা আশা জাগাবে এ সম্মেলন?
এবারের সম্মেলনের সভাপতি, ব্রিটিশ মন্ত্রী অলোক শর্মা বলেছেন, এই শতাব্দীর শেষ নাগাদ বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি হার ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সীমাবদ্ধ রাখতে হলে এখনি পদক্ষেপ নিতে হবে। ২০১৫ সালে প্যারিসে বৈশ্বিক উষ্ণতা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নামিয়ে আনার চুক্তি হয়েছিল। এবার বলা হচ্ছে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস নামিয়ে আনার কথা। এ পরিকল্পনা সফল না হলে উষ্ণ তাপমাত্রায় সমুদ্রসীমা বেড়ে অনেক দেশ পানির নিচে তলিয়ে যাবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে দরিদ্র দেশগুলোকে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ধনী দেশগুলো। এজন্য যে অর্থ প্রয়োজন ছিল ধনী দেশগুলো তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। ২০২০ সালের মধ্যে তারা এ দেশগুলোকে বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, যাতে তাদের পক্ষে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলা সহজ হয়। কিন্তু সে প্রতিশ্রুতি রক্ষা হয়নি। কার্বন নিঃসরণের পূর্বের অঙ্গীকারও পূরণ হয়নি। সে জন্যই প্রশ্ন থেকে যায় ভবিষ্যৎ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের।
উন্নয়নশীল দেশগুলোর মাথাপিছু কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ উন্নত দেশগুলোর তুলনায় অনেক কম। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনে অধিক ক্ষতির শিকার হতে হচ্ছে এ দেশগুলোকেই। অন্যদিকে, কার্বনের মাত্রা কমিয়ে আনার বাধ্যবাধকতায় তারা আর্থনৈতিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন। এ ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা ৪৮ দেশের জোট ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের জোড়ালো ভূমিকা ও ধনী দেশগুলোর অঙ্গীকারের ওপর নির্ভর করছে অনেক কিছু। প্রয়োজনে আইনি কাঠামোয় তা কার্যকরের ব্যবস্থা রাখতে হবে। সম্মেলন যদি অতীতের মতো নীতি আর কথার ফুলঝুরি হয়, তাহলে তা কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হবে।
ড. মঞ্জুরে খোদা: শিক্ষা গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments