পুলিশ কনস্টেবলদের অমানবিক জীবন

স্টার ফাইল ছবি

জীবন সরকার (ছদ্মনাম) ১০ বছর আগে কনস্টেবল হিসেবে পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেন। আশা ছিল এই চাকরি তার জীবন বদলে দেবে। অনেকক্ষেত্রেই বিষয়টি সত্য হলেও জীবনের যে পরিবর্তন এসেছে সবগুলো প্রত্যাশা অনুযায়ী হয়নি।

জীবন ১১ ঘণ্টার শিফটে কাজ করেন এবং সাপ্তাহিক বা অন্য কোনো ছুটি পান না বললেই চলে। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় ঢাকায় একটি তল্লাশি চৌকিতে তার শিফট শুরু হয়। পরদিন সকাল সাড়ে ৬টায় কাজ শেষ হয়।

সপ্তাহের কর্মদিবসগুলো তার এভাবেই কাটে। তবে কাজের প্রস্তুতি নিতেই তার ৪ ঘণ্টারও বেশি সময় চলে যায়। এই সময়ের মধ্যে তাকে রাজারবাগের ব্যারাকে দীর্ঘ সারিতে দাঁড়িয়ে অস্ত্র সংগ্রহ এবং শহরের যানজট পেরিয়ে কর্মস্থলে যেতে হয়। কাজ শেষে ব্যারাকে ফিরতে তার আরও এক ঘণ্টা লাগে। সব মিলিয়ে দিনের ১৬ ঘণ্টা এভাবেই যায়। কোনো কোনো দিন এর চেয়েও বেশি সময় লাগে।

তার মতো সারা দেশে কর্মরত ১ লাখ ২৯ হাজার পুলিশ কনস্টেবল যে শ্রম দেন সে তুলনায় বেতন পান কম। বর্তমানে ঢাকায় নতুন নিয়োগ পাওয়া একজন কনস্টেবল প্রতি মাসে প্রায় ১৭ হাজার টাকা পান। এছাড়াও বৈবাহিক অবস্থা ও সন্তানের সংখ্যা অনুযায়ী তারা যে খাদ্য ভর্তুকি পান তার মূল্যমান ১ হাজার ৫০০ থেকে ৪ হাজার টাকার মতো। ছোট শহর ও উপজেলা পর্যায়ে কনস্টেবলদের ভাতা আরেকটু কম।

জীবন বলেন, 'আমি অনেক উৎসাহ নিয়ে পুলিশে যোগ দিয়েছিলাম। প্রায় ১০ বছর কাজ করার পর এখন মনে হচ্ছে--যা ভেবেছিলাম বাস্তবতা সেরকম নয়। আমাদেরকে অনেক বেশি সময় ধরে অনেক বেশি কাজ করতে হয়।'

অনুরূপ কথা জানান নিম্নপদে কর্মরত আরও ২ জন পুলিশ সদস্য। তবে তারা বাহিনীর আভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

পুলিশ কর্মকর্তা এবং মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে প্রচণ্ড চাপে থেকে এত লম্বা সময় কাজ করলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে মানুষের জীবনের ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। এতে অবসাদ তৈরি হয়ে মানুষ পারিবারিক জীবন এবং কর্মক্ষেত্রে অসুখী হয়।

ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা

কনস্টেবলরা পুলিশ বাহিনীর সবচেয়ে নিম্নপদে কর্মরত। ২ লাখ সদস্যের পুলিশ বাহিনীর ৬৫ শতাংশই তাদের নিয়ে গঠিত। তাদের নিয়োগ অনেকক্ষেত্রেই তদ্বির নির্ভর এবং ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগও আছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য হিসেবে তাদেরকে সপ্তাহে ৭ দিন, ২৪ ঘণ্টা জরুরি পরিস্থিতির জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হয়।

তাদের দায়িত্বের মধ্যে আছে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ, ভিআইপি, গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ও তল্লাশি চৌকিতে পাহারা দেওয়া, নিয়মিত টহলের সময় সিনিয়র কর্মকর্তাদের সঙ্গে থাকা এবং অভিযানে যাওয়া, যেখানে কখনো কখনো অপরাধীদের সঙ্গে গুলি বিনিময়ও হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদেরকে সিনিয়র কর্মকর্তাদের গৃহস্থলী কাজও করতে হয়।

পুলিশের সূত্রগুলো জানিয়েছে, ঢাকার একজন নবনিযুক্ত কনস্টেবল প্রতি মাসে ১৪ হাজার ৯০০ টাকা বেতন পান। কর্মস্থল ও আবাসস্থলের মধ্যে দূরত্ব ৮ কিলোমিটার হলে গড়ে আরও ২ হাজার টাকার মতো যাতায়াত ভাতা হিসেবে দেওয়া হয়।

এছাড়াও, অবিবাহিত কনস্টেবলরা মাসিক রেশন হিসেবে ১২ কেজি চাল, ১০ কেজি আটা, আড়াই কেজি ডাল, ২ কেজি চিনি এবং আড়াই লিটার রান্নার তেল পান। স্বামী, স্ত্রী ও দুই সন্তানসহ ৪ সদস্যের পরিবারের জন্য এই রেশনের পরিমাণ সর্বোচ্চ ৩ গুণ পর্যন্ত হতে পারে।

কিছু কিছু পুলিশ সদস্যের পরিবার আরও বড়, যার মধ্যে তাদের মা-বাবা এবং ভাই বোন অন্তর্ভুক্ত।

নগদ অর্থ দেওয়ার ক্ষেত্রে একটি অংশ উৎস থেকে কেটে রাখা হয়। এই অর্থ ভবিষ্যৎ সঞ্চয় হিসেবে পুলিশের কল্যাণ তহবিলে জমা রাখা হয়।

প্রথম ১৫ মাসে প্রত্যেক কনস্টেবল পুলিশ কমিউনিটি ব্যাংকে ২ হাজার টাকা বিনিয়োগ করতে পারেন। এছাড়াও একটি পুলিশ শপিং মলে এককালীন ১০ হাজার টাকা দিতে হয় তাদেরকে।

মাসিক ও বার্ষিক ভিত্তিতে পুলিশ কল্যাণ তহবিলে আরও বেশ কয়েকবার টাকা দিতে হয় তাদের।

এসব চাঁদা পুলিশ বাহিনীর সদস্য ও তাদের পরিবারের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তায় কাজে দিলেও, অনেকেই পরিবারের দৈনন্দিন খরচ চালাতেই হিমশিম খান। বাহিনীর অন্য কিছু সদস্যের মতো যারা অনৈতিক কাজে জড়ান না, তারা এ সমস্যায় বেশি পড়েন।

গত বছর পুলিশে যোগ দেওয়া একজন কনস্টেবল বলেন, 'টাকা কেটে রাখার পর এবং ব্যক্তিগত খরচের জন্য কিছুটা নিজের কাছে রাখার পর আমি সর্বোচ্চ ৭ হাজার টাকা পরিবারের কাছে পাঠাতে পারি।'

জরুরি পরিস্থিতিতে, যেমন কোনো নিকটাত্মীয়র চিকিৎসার খরচ বহন করতে কেউ কেউ তাদের রেশন কার্ড সহকর্মীদের কাছে ভাড়া দেন। চার সদস্যের পরিবারের রেশন কার্ড থেকে সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা পাওয়া যায়। মূল মালিক দেনা পরিশোধ করে আবার তার নিজের কার্ড ব্যবহার করতে পারেন।

সম্প্রতি পুলিশের একটি তদন্তে জানা গেছে, মিরপুরের পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্ট (পিওএম) বিভাগের ১৮৫ জন কনস্টেবলের মধ্যে ৪৫ জন সহকর্মীদের কাছ থেকে রেশন কার্ডের ভাড়া বাবদ মাসে ১ হাজার ৫০০ থেকে ৪ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পুলিশ কর্মকর্তা এই তথ্য দিয়েছেন।

আর্থিক অনটনের পাশাপাশি, তারা প্রয়োজনের সময়ও ছুটি নিতে পারেন না এবং যার ফলে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মনোমালিন্য হয়।

পুলিশ আইন ১৮৬১ অনুযায়ী সাপ্তাহিক ছুটির কোনো বিধান নেই। তবে বাহিনীর সদস্যরা 'বিশ্রাম' নিয়ে শারীরিক অবসাদ দূর করার জন্য এক দিন ছুটি নিতে পারেন।

স্বল্প ছুটি

সরকারি কর্মচারী হিসেবে কনস্টেবলদের সব সরকারি ছুটি পাওয়ার অধিকার আছে। তবে অনেকেই ধর্মীয় উৎসবের সময় কর্মস্থল ছেড়ে যেতে পারেন না।

জীবন বলেন, 'আমার ছুটি প্রয়োজন, কিন্তু আমি তা পাচ্ছি না। কাজের চাপ অনেক বেশি।'

জীবন সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে ১০ দিনের ছুটি চেয়ে আবেদন করেছেন, কিন্তু এখনো ছুটি অনুমোদন হয়নি।

এ বছরের শুরুর দিকে ঢাকার কনস্টেবল মেহেদী হাসান ও পাবনার উপ-পরিদর্শক হাসান আলীকে ছুটি মঞ্জুর হওয়ার জন্য বেশ কয়েক মাস অপেক্ষা করতে হয়। মেহেদীর বিয়ের পরিকল্পনা ছিল এবং হাসান বিসিএস পরীক্ষা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন বলে তাদের পরিবারের সদস্যরা জানায়। এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন সরদার বলেন, 'মেহেদী কোনো ছুটির আবেদনই করেননি।'

উল্লেখ্য, হাসান ও মেহেদী যথাক্রমে এ বছরের মার্চ ও আগস্টে আত্মহত্যা করেছেন।

পুলিশ গত ৩ বছরে বাহিনীর আরও ১৬ জনের আত্মহত্যার ঘটনার তদন্ত করছে।

২৯ সেপ্টেম্বর পুলিশের সদর দপ্তর থেকে সকল ইউনিট চিফকে বাহিনীর সদস্যদের 'কল্যাণ নিশ্চিত করতে' প্রয়োজন অনুযায়ী ছুটি মঞ্জুর করার নির্দেশ দেওয়া হয়।

সাবেক আইজিপি মোহাম্মদ নুরুল হুদা স্বীকার করেন, পুলিশ সদস্যরা প্রচুর পরিমাণ শারীরিক ও মানসিক চাপে থাকেন। তিনি প্রধান পুলিশ ইউনিটগুলোতে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দেওয়ার সুপারিশ করেন, যাতে তারা বাহিনীর সদস্যদের মানসিক চাপ কমাতে সহায়তা করতে পারেন। দীর্ঘ কর্মদিবস এবং রক্তাক্ত ও বিভীষিকাময় অপরাধের ঘটনার মোকাবিলা করে অনেক সদস্য মানসিক অবসাদে ভোগেন।

পুলিশ বাহিনীর ওপর গবেষণা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক মো. তৌহিদুল হক। তিনি জানান, নিম্নপদের পুলিশ কর্মকর্তারা কর্মক্ষেত্র ও পরিবারের দিক থেকে দ্বৈত চাপে থাকেন।

'তারা ২৪ ঘণ্টা উচ্চ-ঝুঁকির কাজে থাকেন এবং প্রায়ই তাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছ থেকে তিরস্কারের শিকার হন। তারা সারাক্ষণ ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকেন এবং পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোর জন্য খুব একটা সময় পান না। এই সবগুলো বিষয় একসঙ্গে ঘটলে যেকোনো মানুষ মানসিকভাবে ভেঙে পড়তে পারেন।'

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের সহকারী অধ্যাপক (মনোরোগ বিদ্যা) মুনতাসীর মারুফ এই বিষয়ে একমত প্রকাশ করেন। মানসিকভাবে ভেঙে পড়ার মতো পরিস্থিতি এড়াতে আগে থেকেই পুলিশ সদস্যদের মধ্যে মানসিক চাপের লক্ষণ খুঁজে বের করে তা সমাধানের সুপারিশ করেন তিনি।

পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) মো. কামরুজ্জামান রাসেল জানান, তারা এ ধরনের বিষয়গুলোর মোকাবিলা করার জন্য বাহিনীর সদস্যদের কাউন্সেলিং সেবা দিচ্ছেন। তিনি আরও জানান, করোনা মহামারির সময় তারা খুব বেশি ছুটি মঞ্জুর করতে পারেননি। সেসময় বাহিনীর অনেক সদস্য আক্রান্ত হওয়ায় সুস্থ সদস্যদের লকডাউন কার্যকর করতে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে।

তিনি বলেন, 'সংকট মুহূর্তে আমরা সবাইকে ছুটি দিতে পারি না। কিন্তু জরুরি পরিস্থিতির অবসান হলে পুলিশ সদস্যরা পুলিশ আইনের আওতায় থেকে ছুটি নিতে পারেন।'

প্রতিবেদনটি অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English

You have crushed fascism, now strengthen democracy and press freedom

The Daily Star Editor Mahfuz Anam's appeal to the ‘new generation leaders’

10h ago