এই পথে সহজে ঢোকা গেলেও বের হওয়া কঠিন
আশির দশকে রংপুর থেকে আমাদের বাসায় ঢ্যাড়ামদ্দী নামে একটা ছেলে এলো। ১২/১৩ বছর বয়সী ঢ্যাড়ার মূল কাজ ছিল দৌঁড়াদৌঁড়ি করে ফাই-ফরমাশ খাটা, টিভি দেখা আর খেলাধুলা করা। বাড়িশুদ্ধ লোক ওকে অক্ষর জ্ঞান দিতে গিয়ে হয়রান হয়েছে মাত্র, একটি লাইনও শেখাতে পারেনি।
ঢ্যাড়া চুরি করে খেতো। পোলাও-মাংস থেকে আলু সেদ্ধ, মিষ্টি থেকে কাঁচকলা- সবই বেশ পারদর্শিতার সঙ্গে হজম করে ফেলতো। সবার নজরদারি এড়িয়ে ঢ্যাড়া বেশ অনায়াসেই সব সাবড়ে ফেলতো। মাঝেমাঝে ওর এই চুরি করার ক্ষমতাকে ম্যাজিক বলে মনে হতো। তবে ওর নজর ছিল শুধু খাওয়া দাওয়ার দিকেই, অন্য কিছু চুরি করতো না।
রংপুরের আঞ্চলিক ভাষায় ঢ্যাড়া বলেছিল, 'মোর বাপ মোক চুরিবিদ্যা শিখাইছে। মোর বাপও চোর ছিলে, মুইও চোর। বাপের সাথোত থাকি মুইও শিখছি। ওমরালা মোক হাটোত ধরি যাইতো মাছ চুরি কইরবার তানে। চুরি কইরবার পাইল্লে খাওয়ান পাইতাম, না পাইল্লে খায়োনও নাই।' অর্থাৎ বাবা হাটে নিয়ে যেতো মাছ চুরি করার জন্য। চুরি করতে পারলে খাওয়া জুটতো, তা না হলে খাওয়া নেই।
ঢ্যাড়া বলেছিল, 'মোর আটখান মাও ছিলে। কায় যে মোর নিজের মাও মুই তাও জানো না। কোনদিন কাহো মোক আদর করি খাইতে দেয় নাই।' এর মানে হচ্ছে, ঢ্যাড়ার বাবা ৮ বিয়ে করেছিলেন। কে যে ওর আপন মা, ও জানতো না। কেউ ওকে কখনো আদর করে খেতে দেয়নি।
ওই অতটুকু ছেলে আমাদের বলেছিল, চোরের ছেলে চোরই হয়। বলেছিল, 'যাক কাহো আদর কারে না, সেই বাচ্চা কাড়ি খাবার শিখে।'
এই ঢ্যাড়া যে চুরিবিদ্যায় পাকা হবে, তা সহজেই অনুমেয়। খাবারের অভাবে চুরি করতো বলে, হয়তো ও খাবারটাই চুরি করতে শিখেছিল। একদিন ঢ্যাড়া ফিরে গেল সেই গ্রামে, যেখানে তাকে খাওয়ানোর বিনিময়ে নিজের বাবাই শিশু বয়সে চুরি বিদ্যা শিখিয়েছিলেন।
হঠাৎ করে ঢ্যাড়ার কথাটা মনে হলো হওয়ার কারণ হলো প্রথম আলোতে পড়া একটি প্রতিবেদন। সেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনাকালে বিভিন্ন অভিযোগে আটক শিশু-কিশোরদের প্রায় অর্ধেকের নামেই রয়েছে হত্যা ও ধর্ষণ মামলা।
গাজীপুরের টঙ্গী, কোনাবাড়ী ও যশোরের ৩টি শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে থাকা নিবাসীদের মামলার তথ্য অনুসারে, ২৪ শতাংশের বেশি শিশুর নামে হত্যা মামলা এবং প্রায় ২৬ শতাংশ শিশুর নামে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের মামলা আছে। এগুলোর অধিকাংশই ধর্ষণ মামলা। আমাদের জন্য খুব ভয়াবহ একটি তথ্য এটি। যদিও অনেক শিশুর পরিবারের অভিযোগ, ষড়যন্ত্র করে তাদের মামলায় জড়ানো হয়েছে।
কেন শিশুদের বিরুদ্ধে এত মামলা? কেন এত শিশু অপরাধীর খাতায় নাম লেখাল? তাও আবার ছোটখাটো কোনো মামলা না, খুন ও ধর্ষণের মামলা। ঢ্যাড়ার মতো শুধুই খাবার চুরি করার মতো ছোটখাটো অপরাধ নয়। সময়ের সঙ্গে শিশুর অপরাধের ক্ষেত্র বেড়েছে, মন-মানসিকতাও জটিল হয়েছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, পারিবারিক বন্ধন ও নৈতিক মূল্যবোধের অভাব এবং অর্থনৈতিক সংকট থাকা অনেক পরিবারের শিশু হত্যা, ধর্ষণ, চুরি-ছিনতাই ও মাদক অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। করোনাকালে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণেও অনেক শিশু এ ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে পারিবারিক বিরোধ থেকেও শিশুদের মামলায় জড়ানো হয়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলার ক্ষেত্রে বেশিরভাগ শিশুই না বুঝে জড়িয়ে যায়।
শিশু-কিশোরদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে এইভাবে জড়িয়ে পড়া নি:সন্দেহে উদ্বেগজনক। শিশু অপরাধ বিষয়ক গবেষক প্রথম আলোকে বলেছেন, ওই শিশুদের সামাজিক বন্ধন খুব দুর্বল এবং এই সামাজিক বন্ধনহীনতা সমস্যা তৈরি করেছে। অনেকেই মা-বাবার ভালোবাসা পায় না। কোনো কোনো মা-বাবা পরিবারের অন্য সদস্যদের কাছে তাদের রেখে চলে গেছেন। সেই পরিবার থেকে তাদের লালনপালনে সামাজিকীকরণের ধাপগুলো মেনে চলা হয়নি। গ্রামের অনেক শিশু স্কুলেও যথাযথ শিক্ষা পায়নি। আদর্শিক জায়গা থেকে তাদের সামনে কোনো 'রোল মডেল' নেই। দারিদ্র্যকে অনেকে কারণ বললেও, আদতে তা মূল কারণ নয়।
দারিদ্র্যই যে মূল কারণ নয়, এর প্রমাণও আমরা পেয়েছি। কয়েক বছর আগে সকালের দিকে আসাদ এভিনিউ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখলাম ৫/৬ জন কিশোর তাদের স্কুল ড্রেস পরেই মোহাম্মদপুর টাউনহলের ভেতরের দিকে চলে গেল। পরে জানতে পেরেছিলাম, ছেলেগুলো এই সময়ে স্কুলে না গিয়ে ড্রেস পরে, কাঁধে ব্যাগ নিয়ে মাদক গ্রহণ করে। বাবা-মা স্কুলে নামিয়ে দিয়ে যায়। আর এরা কোনো এক কায়দায় স্কুলে না ঢুকে এদিকÑওদিক চলে যায়।
সেদিন ব্যাপারটা নিয়ে বিচলিত বোধ করেছিলাম। একটা শঙ্কা কাজ করছিল বাচ্চাগুলোর জন্য। মায়া হচ্ছিল বাবা-মায়েদের জন্য। বাবা-মা এবং এই সন্তানদের কেউই হয়তো জানে না ভবিষ্যতে কী অপেক্ষা করছে তাদের জন্য। ব্যাপারটা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। এই খবরটা পড়ে আবার মনে হলো।
আমরা সংবাদমাধ্যমে এরকমই আরো কিছু কিশোর দল তৈরির খবর পেয়েছি, যারা এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। এই বয়সের বাচ্চারা মারামারি, হৈচৈ, ঝগড়া-বিবাদ করতেই পারে। কিন্তু তাই বলে খুন, ধর্ষণ, নিজেদের মধ্যে সংঘাত, বন্ধুকে মেরে ফেলা, মারার আগে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়া-এগুলোও?
শিশু-কিশোর অপরাধীদের অধিকাংশের বয়সই ১৪ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে। উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তানরা যেমন আছে, তেমন আছে নিম্নবিত্ত ঘরের পড়াশোনা না জানা কিশোর-তরুণরা। দেখা যাচ্ছে, শিক্ষিত, স্বচ্ছল ও ধনী পরিবারের বেপরোয়া বা বখাটে সন্তানরা চলছে সমাজের বঞ্চিত পরিবারের লেখাপড়া না করা কিছু মাস্তানের কথায়। অপরাধীদের তালিকায় কিশোরী-তরুণীরাও রয়েছে। এরা মাদক ও যৌন ব্যবসার কেন্দ্রবিন্দু।
বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে শিশু-কিশোরদের সংশ্লিষ্ট হওয়ার হার উদ্বেগজনকভাবে বাড়ার বিষয়টি কিন্তু খুব সম্প্রতি ঘটেনি। অনেকদিন ধরেই ধীরে ধীরে এটি বাড়ছে। কিন্তু আমরা নজর দিইনি এবং এখনও দিচ্ছি না। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বারবার বলে আসছেন, অপরাধী চক্র নিজেদের স্বার্থেই অপরাধের সঙ্গে শিশু-কিশোরদের জড়িত করছে এবং এই হার দিন দিন বাড়ছে।
এদের মধ্যে অনেকেই পথশিশু। পথশিশুদের নামমাত্র মূল্যে অপরাধ জগতে ভিড়িয়ে নেয়া যায় এবং এরা মাদক ব্যবহারের মাধ্যমে নিজেরাই অপরাধ জগতের সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে। পথশিশু বলেই হয়তো আমরা বিষয়টি আমলে নেইনি। কিন্তু এখন তো আগুনের আঁচ আমাদের মতো শহুরে পরিবারের সন্তানদের গায়েও লাগছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে ২০১৬ সালের হিসেব অনুযায়ী, শতকরা ৪৪ ভাগ পথশিশু মাদক চালানের সঙ্গে জড়িত। ৩৫ ভাগ পিকেটিং এর সঙ্গে, ১২ ভাগ ছিনতাইয়ের সঙ্গে, ১১ ভাগ মানব পাচারের সঙ্গে এবং ২১ ভাগ অন্যান্য অপরাধের সঙ্গে জড়িত। অথচ প্রথম আলোর প্রতিবেদনে আমরা দেখছি, শিশুরা হত্যা ও ধর্ষণের মতো ভয়াবহ অপরাধের সঙ্গে অত্যাধিক হারে যুক্ত হয়েছে।
মূলত পরিবারের অভাব, প্রাচুর্য, শিক্ষার অভাব, শাসনহীনতা, অভিভাবকের উদাসীনতা, মূল্যবোধের সংকট, পরিবারের ভেতরে অপরাধীর বা অপরাধের উপস্থিতি শিশুকে বিপদের মুখে এনে দাঁড় করায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বন্ধু-বান্ধবরাই শিশু কিশোরদের অপরাধ জগতের দিকে টেনে নিলেও, অপরাধীরা দরিদ্র শিশুদের খাবার ও আশ্রয়ের কথা বলেও এই জগতে টেনে আনে। এ ছাড়া, সমাজের মধ্যে বিরাজমান ফারাকও শিশুকে অপরাধী হওয়ার পথ দেখায়।
স্বচ্ছল পরিবারের বাবা-মায়েরা তাদের ব্যস্ততা ও অসচেতনতার কারণে সন্তানকে পর্যাপ্ত সময় দিতে, তাদের যতœ নিতে, তাদের কাজকর্মের প্রতি দৃষ্টি দিতে এবং পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ বজায় রাখার মত শিক্ষা দিতে পারছে না। আর ব্যক্তিগতভাবে সময় দিতে না পারার এই ব্যর্থতা ঢাকতে গিয়ে সন্তানের হাতে তুলে দেওয়া হয় অপরিমিত অর্থ, প্রাচুর্য ও যা খুশি তাই করার স্বাধীনতা। ফলে তাদের সন্তান হয়ে উঠে বেপরোয়া, দুর্বিনীত ও অপরাধী। এসব বখে যাওয়া শিশু-কিশোর সহজে এই মন্দ পথে পা বাড়ায়। দাগী অপরাধীরাও খুব সহজে তাদের ব্যবহার করার সুযোগ পায়।
এ ক্ষেত্রে অভিভাবক সন্তানকে সময় দেওয়ার পরিবর্তে ফ্যাসিলিটি দেওয়ার ব্যাপারে বেশি উৎসাহী থাকে। তারা মনে করে, এটাই যথেষ্ট প্যারেন্টিং। তাই শিশু-কিশোরদের হাতে থাকা গাড়ি, মোটরসাইকেল, দামি ফোন, ঘড়ি, জামা-কাপড় - সবই ব্যবহৃত হচ্ছে অপরাধ কার্যক্রমের। শিশুরা বুঝতেই পারে না যে, এই পথে সহজে ঢোকা গেলেও বের হওয়া কঠিন।
শাহানা হুদা রঞ্জনা, সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)
Comments