আমলাতান্ত্রিক নীতিতে চলে গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিএমআরসি

দেশের স্বাস্থ্য গবেষণায় অগ্রাধিকার ক্ষেত্রগুলো নির্ধারণ ও সহজতর করার বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ মেডিক্যাল রিসার্চ কাউন্সিল (বিএমআরসি) করোনা মহামারি চলাকালীন বেশিরভাগ সময় আমলাতান্ত্রিক জটিলতার মধ্য দিয়ে গেছে।

করোনাভাইরাসের টিকা প্রাণীর ওপর পরীক্ষা করার জন্য আনুষ্ঠানিক অনুমোদন নিতে হবে- কেবল এই তথ্যটুকু স্থানীয় ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান গ্লোব বায়োটেক লিমিটেডকে জানাতে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৫ মাস সময় নিয়েছে বিএমআরসি।

এ ছাড়াও, গত এপ্রিলে বুয়েট এমন একটি যন্ত্র তৈরি করে যা উচ্চ-প্রবাহের অক্সিজেন সরবরাহ করতে পারে। সারাদেশের হাসপাতালগুলো যখন হাই-ফ্লো নাসাল ক্যানুলার জন্য হাহাকার করছে, তখন বুয়েটের এই আবিস্কার পুরোদেশেই স্বাস্থ্যখাতের চিত্র পাল্টে দিতে পারত।

কিন্তু, অক্সিজেট নামের ওই ডিভাইসটি হাসপাতালে পরীক্ষার অনুমতি দিতেই ৩ মাস সময় নেয় বিএমআরসি। অনুমতি আসতে আসতেই করোনা সংক্রমণ কমতে থাকে।

বিএমআরসির এক কর্মকর্তা জানান, এই ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার দক্ষতাসম্পন্ন সদস্য কাউন্সিলে নেই। এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন এমন কারো খোঁজও করেনি কাউন্সিল।

গত বছরের ১৮ জুলাই দেশের ৭টি হাসপাতালে চীনের সিনোভ্যাক টিকা মানবদেহে পরীক্ষার অনুমোদন দেয় বিএমআরসি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টিকার পরীক্ষা যদি এখানে সম্পন্ন হতো, তবে বেশ ভালোসংখ্যক টিকা পেতে পারতে বাংলাদেশ।

এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে ১ মাসেরও বেশি সময় নিয়ে নেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে বাংলাদেশে পরীক্ষা চালানোর ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানটি।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ক্ষেত্রে একটি স্বাধীন সংস্থা হিসেবে বিএমআরসি অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারতো। দেশের মহামারি পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়ে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে আহ্বান জানাতে পারতো। কিন্তু তেমন কিছুই হয়নি।

কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, 'মহামারির সময়ে গবেষণার সুবিধার্থে বিএমআরসি অনেক কিছুই করতে পারত। কিন্তু তারা কী ভূমিকা পালন করেছে জানি না।'

দেশে করোনা শনাক্ত হওয়ার ১১ মাস পর গত ফেব্রুয়ারিতে বিএমআরসি একটি তালিকা প্রকাশ করে। যেখানে উল্লেখ করা ছিল, কোন কোন ক্ষেত্রে গবেষণার জন্য সংস্থাটি তহবিল এবং অন্যান্য সুবিধা দেবে। কর্মকর্তারা জানান, বিএমআরসি ৫১টি গবেষণায় অর্থায়ন করেছে।

অর্থায়ন করা গবেষণা সম্পর্কে জানতে বিএমআরসির পরিচালক ডা. রুহুল আমিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, 'কিছু গবেষণা চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।'

তবে, কোনো গবেষণা সম্পর্কেই সুনির্দিষ্ট জবাব দিতে পারেননি তিনি।

অন্যান্য দেশের গবেষণা সংস্থাগুলোর অর্জনের সঙ্গে তুলনা করে তিনি আরও বলেন, মহামারির মধ্যে বিএমআরসির সাফল্য হতাশাজনক বলে মনে হতে পারে।

গত ফ্রেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিএমআরসির পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন ডা. মাহমুদ-উজ-জাহান। তিনি জানান, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তহবিলের অভাব বিএমআরসির দুর্বলতার জন্য দায়ী।

শ্লথগতির সংস্থা

গত বছরের ২০ জুলাই গ্লোব বায়োটেক লিমিটেড ঘোষণা দেয় যে, তারা বঙ্গভ্যাক্স নামের একটি করোনার টিকা তৈরি করেছে। চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারি বায়োটেকের চুক্তিভুক্ত গবেষণা সংস্থা (সিআরও) বিএমআরসির কাছে মানবেদেহে প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ে বঙ্গভ্যাক্স প্রয়োগ পরীক্ষার প্রোটোকল জমা দেয়।

গত ৯ ফেব্রুয়ারি এই পরীক্ষার জন্য বিএমআরসি ১০০টিরও বেশি বিষয়ে অতিরিক্ত তথ্য চায়। এর ৮ দিন পর সে তথ্যও জমা দেয় সিআরও।

সিআরও তথ্য দেওয়ার ৫ মাস পর বিএমআরসি জানায়, প্রথমে বানর বা শিম্পাঞ্জির ওপর বঙ্গভ্যাক্সের পরীক্ষা চালানো উচিত।

করোনা পরিস্থিতিতে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে গবেষণার ক্ষেত্রে কঠোর নিয়ম শিথিল করা হয়েছে উল্লেখ করে বায়োটেকের সিনিয়র ম্যানেজার মোহাম্মদ মহিউদ্দিন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমাদেরকে সাহায্য করার পরিবর্তে প্রক্রিয়ার প্রতিটি ধাপে বাধা এবং অপ্রয়োজনীয় বিলম্ব সৃষ্টি করেছে বিএমআরসি।'

২৯ মে বিএমআরসির নৈতিক কমিটির প্রধান জাতীয় অধ্যাপক শাহলা খাতুন বলেছিলেন, 'সরকারের নীতি হচ্ছে ধীরে চলো।'

বিজ্ঞানের বিষয়েও সরকারের এমন নীতি কার্যকর হওয়া উচিত কি না জানতে চাইলে অধ্যাপক শাহলা বলেন, 'এটা আমার বলার বিষয় না। আমরা ট্রায়ালের ((বঙ্গভাক্স)) বিষয়ে আমাদের সিদ্ধান্ত দিয়েছি। এটা তাদের উপর ছিল (বিএমআরসির এক্সিকিউটিভ বডির আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদনের ঘোষণা দেওয়ার কথা)।'

বায়োটেককে কেন এই প্রতিক্রিয়ার জন্য ৫ মাস অপেক্ষা করতে হয়েছে, জানতে চাইলে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি বিএমআরসির পরিচালক রুহুল আমিন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, 'বায়োটেকের টিকা নিয়ে কিছু সমস্যা থাকতে পারে। তারপরও আমি মনে করি না যে বিএমআরসি সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে।'

একজন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, 'কাউন্সিলের বেশিরভাগ সদস্যকে গবেষণার পরিবর্তে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।'

এ কারণেই কাউন্সিল এই অবস্থায় আছে বলে মনে করেন ওই বিশেষজ্ঞ।

অনুবাদ করেছেন আব্দুল্লাহ আল আমীন

Comments

The Daily Star  | English

Public admin reforms: Cluster system may be proposed for ministries

The Public Administration Reform Commission is likely to recommend reducing the number of ministries and divisions to 30 from 55 to improve coordination and slash the government’s operational cost.

8h ago