হিন্দু মুসলমানের ধর্মীয় সংস্কৃতির মধ্যে চমৎকার বিনিময় ছিল: নির্মলেন্দু গুণ

কবি নির্মলেন্দু গুণ। ছবি: সংগৃহীত

বাংলা ভাষার অন্যতম জনপ্রিয় কবি নির্মলেন্দু গুণ। কবি সুখেন্দু প্রকাশ গুণ ‍ও বীণাপাণি দেবীর পঞ্চম সন্তান। তার সাহিত্য কর্মে নারীপ্রেম, শ্রেণি সংগ্রাম ও স্বৈরাচার বিরোধিতা, সমাজ সমকাল প্রকাশ পেয়েছে। আর কীর্তির জন্য বাংলা একাডেমি, একুশে পদকসহ পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার।

সম্প্রতি কথা হয়েছে কবি নির্মলেন্দু গুণের সঙ্গে। 

আমাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রিতি নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

নির্মলেন্দু গুণ: যুগে যুগেই সরকার প্রধানরা আন্তঃধর্মীয় দাঙ্গার উৎসগুলোকে জিইয়ে রেখেছিল। তবু এরপরও আমি বলব—আমাদের যথেষ্ট সম্প্রীতি ছিল। ছোটবেলায় আমি হযরত মুহাম্মদ (স.) এর উপর রচনা লিখে প্রথম হয়েছিলাম। আমার স্কুলের মুসলিম শিক্ষক, শিক্ষার্থী সবাই এটাকে সাধারণভাবেই নিয়েছেন। এই পরিস্থিতিটা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। আরেকজনের কথা বলি, আমি যখন মেট্রিক পাশ করে কলেজে ভার্তি হয়েছি তখন আমার পরিচয় হয়েছিল মহারাজা রোডের বসবাসকারী একজন শিল্পীর সঙ্গে। তিনি ধর্মে মুসলমান ছিলেন, নাম ছিল রশিদ। তিনি চমৎকার প্রতিমা বানাতে পারতেন এবং আমাদের ময়মনসিংহ শহরে তার নির্মিত প্রতিমা দুর্গা, সরস্বতী পূজায় ব্যবহৃত হতো। একবার আমি তার কাছ থেকে একটি সরস্বতী প্রতিমা সংগ্রহ করেছিলাম। তার শিল্পকর্মের প্রতি আমার ভালোবাসা আছে বুঝতে পেরে তিনি আমাকে একটি চমৎকার সরস্বতী প্রতিমা বানিয়ে দিয়েছিলেন। তখন গ্রামে ইলেক্ট্রিসিটি ছিল না। আমরা হ্যাজাক লাইট জ্বালিয়ে স্টেশন থেকে সেই সরস্বতী প্রতিমা বহন করে নিয়ে গিয়েছিলাম আমাদের গ্রামের বাড়িতে। তারপর এটি একজন মুসলমান তৈরি করেছেন জানার পর আমাদের এলাকার বিভিন্ন গ্রাম থেকে মুসলমানরাও এসে এই প্রতিমা দর্শন করেছেন এবং তার সৃষ্টির প্রশংসা করেছেন। তিনি শুধু দেবী মূর্তি তৈরি করতেন এরকম নয়। তিনি অনেক সাধারণ কৃষকের ছবি, শ্রমিকের ছবি মৃৎশিল্পের ভেতর দিয়ে প্রকাশ করতেন। তার একটা স্টুডিও ছিল মহারাজা রোডে। এখন এর পাশেই রয়েছে মুকুল বিদ্যানিকেতন বলে একটা স্কুল। আমি অনেকবার তার স্টুডিওতে গিয়েছিলাম।

অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হলো ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী তার স্টুডিওতে হামলা করে এবং যত মূর্তি ছিল সেগুলো ভেঙে ফেলে। সেগুলো রক্ষা করতে গিয়ে রশিদ জীবন দান করেছিলেন। তিনি জীবন দিয়ে তার শিল্পকর্মকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে স্টুডিওতে তার শিল্পকর্মের উপরেই পড়ে মারা যান। পরে ক্ষিপ্ত পাক সেনারা তার মরদেহের পায়ে রশি বেঁধে শহর প্রদক্ষিণ করেছিল।

অতীতে আমরা দেখেছি হিন্দু মুসলমানের যে ধর্মীয় সংস্কৃতি তার মধ্যে একটা চমৎকার বিনিময় ছিল। আমরা জানি ভাই গিরীশ চন্দ্র সেন, তিনি ব্রাহ্ম ধর্মের একজন অন্যতম পথ প্রদর্শক। তিনি পবিত্র কোরআন অনুবাদ করেছিলেন। তিনি আরবি ভাষা শিক্ষা গ্রহণের জন্য কেশব সেনের নির্দেশে এলাহবাদ গিয়ে ছয় বছর ধরে এই আরবি ভাষা শিখেছেন শুধু কোরআন শরীফ বাংলা অনুবাদ করার লক্ষ্যকে সামনে নিয়ে। সুতরাং হিন্দু ধর্মের প্রতি রশীদের যে রকম ভালোবাসার প্রমাণ আমরা পাই,তেমনি ভাবে ইসলাম ধর্মের প্রতি তাদের পবিত্র কোরআন অনুবাদ করার জন্য আমরা একজন ভাই গিরীশ চন্দ্র সেনকেও দেখতে পাচ্ছি। সেরকম সম্প্রীতিগুলো কি আছে?

এই সম্প্রীতি কীভাবে ফিরিয়ে আনা যায় বলে মনে করেন?

নির্মলেন্দু গুণ: জনগণের পাশাপাশি এগুলো এখন একমাত্র রাষ্ট্রই পারে। আমাদের রাষ্ট্রের যে মৌলিক কাঠামো তার মধ্যে একটি ধর্মনিরেপেক্ষতা। এর আলোকে অনেকগুলো আইনও আছে। সেগুলো কার্যকরের মধ্য দিয়েও সম্প্রীতি ফিরিয়ে আনা যায়। ১৯৭০-এর নির্বাচনের পূর্বে জাতির উদ্দেশে ভাষণে বঙ্গবন্ধু এগুলো স্পষ্ট ব্যাখ্যা করে গেছেন। সুতরাং ধর্ম নিরপেক্ষতাকে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। এই অস্বীকারকারীদের হাতে কখনোই দেশের পতাকা তুলে দেওয়া যাবে না।

এবারের পূজা কিভাবে কাটাচ্ছেন?

নির্মলেন্দু গুণ: আমার বাড়িতে দুর্গাপূজা না হলেও প্রতি বছরই আমি এলাকায় যাই। এইবার তো করোনা। কোথায় যাব আর! গতবারের মতো ঘরেই কাটছে।

কেন করোনার সঙ্গে কি আর পারা গেল না?

নির্মলেন্দু গুণ:  পারা যেত, যদি না এটা আমাদের তৈরি না হত। এটা তো আমরাই তৈরি করছি।

আপনি বলছিলেন আপনার বাড়িতে পূজা হয় না? এর কারণটা কী?

নির্মলেন্দু গুণ: আমাদের বাড়িতে পূজা যে হতো না তা নয়, হতো। সেই পূজা বন্ধ হওয়ার পেছনে একটা গল্প আছে। কোনো এক দুর্গাপূজার সময় আমাদের পূর্ব পুরুষদের একজনকে নাকি বাঘে খেয়েছিল। ওই ঘটনা থেকে সবাই দুর্গার প্রতি ক্ষিপ্ত যে দুর্গা তার পূজারীকে বাঘের মুখে তুলে দেয় তার অর্চনা  হবে! আমাদের আশপাশের গ্রামের লোকজন বলত, গুণরা হচ্ছে কৃপণ। পূজার খরচ এড়ানোর জন্যই তারা মানুষকে এই গল্প শুনায়। আমি দ্বিতীয় কারণটাই বিশ্বাস করি।

দুটোই মিথের মতো মনে হচ্ছে। মাত্র এক জেনারেশনে এরকম মিথ কিভাবে তৈরি হতে পারে!

নির্মলেন্দু গুণ: না, না বিষয়টা মিথ বা মিথের মতো না। আরও কথা আছে এর পেছনে—বাবার কাছে শুনেছি,আমার ঠাকুর দাদা ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণ করায় আমাদের বাড়িতে দুর্গাপূজা হতো না। ব্রাহ্মণরাও আমাদের বাড়িতে পূজা-আর্চা করতে চাইতেন না। এর জন্য আমরা প্রায় একঘরে হয়ে গেছিলাম। এরপর আমার ঠাকুর দাদা প্রায়শ্চিত্ত করে হিন্দু ধর্মে ফিরে এলেও মূর্তি পূজাটা আমাদের পরিবারে খুব বেশি হয় না। তবে বিদ্যার দেবী হিসেবে আমার বাবা সরস্বতী পূজা করতে দিতেন। সরস্বতীতে আমরা খুব মহাসমারোহে প্রতিমা কিনে নিয়ে আসতাম ময়মনসিংহ থেকে, বারহাট্টা থেকে। এখনকার প্রতিযোগিতার মতো আমাদের মধ্যেও একটা প্রতিযোগিতা হতো—কার প্রতিমা কত সুন্দর হয়।

এটাতো আপনার পূর্ব পুরুষদের কথা বললেন। আপনার কবিতায় পূজা কিভাবে এসেছে?

নির্মলেন্দু গুণ: আমি বিভিন্ন সময়ে দুর্গাপূজা উপলক্ষে মা দুর্গাকে নিয়ে কবিতা লিখেছি। আমি তাকে সশস্ত্র সুন্দরী বলে বিবেচনা করেছি। আমার দুর্গা, সশস্ত্র সুন্দরী কবিতায় আমি লিখেছি- 'এইদিন চোখেই পড়েনি, তোমার সশস্ত্র মূর্তি/ লুক্কায়িত ছিল আলোর আঁধারে, আজ উদ্ভাসিত/ দিকে দিকে, আঁধারের অপূর্ব আলোয়।/ নিরস্ত্র ভক্তের চোখে আজ হঠাৎ পড়েছে ধরা/ শঙ্খ-পদ্মা-গদা-চক্র-ত্রিশূলের প্রতীক তর্পণ।/ সশস্ত্র তোমাকে মানায়।'

দেবী দুর্গাকে আমরা প্রতিটি সংসারেরই একজন বলে মনে করি। আমরা এই বিশ্বাস করি দুর্গা তার পিতৃগৃহে ফিরে আসছেন স্বামীগৃহ থেকে। একজন গরিব পিতার কন্যা যখন পিতৃগৃহে ফেরেন অনেক সময়ই পিতারা বিব্রত হন তাদের আপ্যায়ন, থাকা, নিরাপত্তা চিন্তায়। পিতৃমন সবসময় আনন্দের পাশাপাশি একটু বিচলিত থাকে। সেই রকম একজন বিচলিত পিতার দৃষ্টি থেকে এই দুর্গার পিতৃ গৃহে আগমনকে আমার 'দুর্গা উপাখ্যান' কবিতাটির মধ্যে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। বিসর্জনের উপরও আমার আলাদা কবিতা আছে- 'কি থাকে তোমার যদি বাংলার মাটি জলে থাকা সোনার প্রতিমা থেকে/ গত শরতের খড়গুলি ক্রমান্বয়ে খুলে ফেলি...।'

আপনার পূজা প্রসঙ্গ/ ভাবনাটি রবীন্দ্রনাথের মতো মনে হচ্ছে!

নির্মলেন্দু গুণ: হ্যাঁ। রবীন্দ্রনাথও তো ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন। যারা ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষিত থাকে তারা এই পুজোটা করেন না। তবু রবীন্দ্রসাহিত্যে আমরা দেখি পুজোর সুন্দর বিবরণ। তার কাব্য, ছোটগল্প, চিঠিপত্রে, গীতিনাট্যে, সঙ্গীত, শিশুকাব্য গ্রন্থে আমরা দুর্গাপূজাকে বিভিন্নভাবে পাই।

Comments