তাদেরকে জাগাতে আর কতজনকে জীবন দিতে হবে?
বন্দর নগরী চট্টগ্রামে খোলা ড্রেন যেনো এক মরণফাঁদ! মাত্র ৩ মাসের ব্যবধানে ড্রেনে পড়ে কমপক্ষে ৪ জন মারা গেলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোনো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়নি। মনে হচ্ছে, তারা যেনো ঘুমিয়ে আছেন।
কর্তৃপক্ষের চরম অবহেলার সর্বশেষ শিকার চট্টগ্রামের ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের স্নাতক প্রথমবর্ষের শিক্ষার্থী সেহেরিন মাহবুব সাদিয়া। গত সোমবার রাত ১০টার দিকে আগ্রাবাদের বাদামতলী এলাকার একটি খোলা ড্রেনে পড়ে গিয়ে ১৯ বছর বয়সী সাদিয়ার মৃত্যু হয়। তিনি তার নানা ও মামার সঙ্গে হেঁটে গাড়ির দিকে যাচ্ছিলেন। এসময় পা পিছলে ড্রেনে পড়ে যান। দমকলকর্মীরা কয়েক টন আবর্জনা সরিয়ে প্রায় ৫ ঘণ্টা চেষ্টা চালানোর পর তার মরদেহ উদ্ধার করেন।
সম্প্রতি চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ প্রকল্পের প্রয়োজনে, ড্রেন সংলগ্ন রাস্তাটিকে সংকুচিত করা হয়েছে।
এছাড়াও, রাস্তা সংলগ্ন সড়ক বাতিগুলো বেশ কয়েকমাস ধরে অকেজো থাকায় পুরো এলাকা অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। সড়কে যথোপযুক্ত আলোর ব্যবস্থা করা যেকোনো সিটি করপোরেশনের মূল দায়িত্বগুলোর একটি।
সাদিয়ার করুণ মৃত্যুর ঘটনায় চট্টগ্রামসহ সারা দেশের জনগণের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে, কিন্তু এতে সিডিএ কিংবা চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (সিসিসি) মধ্যে কোন উদ্বেগ কিংবা সংবেদনশীলতা তৈরি হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না।
এ ধরনের দুর্ঘটনা যাতে আর না হয়, তা প্রতিরোধ করার দায়িত্ব প্রকৃতপক্ষে কার, এটা নিয়ে এখন কর্তৃপক্ষরা একে অপরের ওপর দোষ চাপানোয় ব্যস্ত।
সিডিএ'র প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সিটি করপোরেশন তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে।'
তিনি বলেন, 'আমাদের হাতে ড্রেনের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার মাত্র ২ বছর হয়েছে। এর আগে সিটি করপোরেশন কী করেছিল? তারা ড্রেনের চারপাশে কোনো ধরনের নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করেনি।'
তিনি আরও জানান, ড্রেন পরিষ্কার রাখার দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের।
কেন সিডিএ এ ধরণের কোনো বেষ্টনী তৈরি করেনি, এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, তারা জলাবদ্ধতা সমস্যার সমাধান করার একটি প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার পর ড্রেনের চারপাশে বেড়া দেবেন। আপাতত তারা উন্নয়ন কাজ চলছে এরকম ড্রেনগুলোর চারপাশে অস্থায়ী নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করবেন।
পথচারীদের নিরাপত্তার জন্য এই অস্থায়ী বেড়া তৈরি করতে তারা কেন দেরি করলেন, এ প্রশ্নের কোনো উত্তর দেননি কাজী হাসান।
তিনি দাবি করেন, সোমবারের দুর্ঘটনার জন্য যে ড্রেনটি দায়ী, সেটি একটি ছোট ড্রেন এবং এ কারণে এটি সম্পূর্ণরূপে সিসিসি'র এখতিয়ারে আছে।
দ্য ডেইলি স্টার সিসিসি'র প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে, কিন্তু তিনি ফোন ধরেননি।
সিসিসি মেয়র রেজাউল করিম গত মঙ্গলবার ঘটনাস্থল সরেজমিনে পরিদর্শন করে দুর্ঘটনার জন্য পরোক্ষভাবে সিডিএকে দায়ী করেন।
তিনি সাংবাদিকদের বলেন, 'কারা এই দুর্ঘটনার জন্য দায়ী, তিনি তা বলবেন না। আগে ড্রেনের চারপাশে একটি রেইলিং (বেড়া) ছিল, কিন্তু এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ার পর সেটি সরিয়ে নেওয়া হয়।'
তিনি আরও বলেন, 'যদি একটি সতর্কসূচক নির্দেশিকা বা লাল পতাকা থাকতো, তাহলে মানুষ বিপদ সম্পর্কে জেনে আরও সতর্ক হতে পারত। যারা (সিডিএ) এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করছে, তারা তাদের দায়িত্ব অবহেলা করেছে।'
স্থানীয় ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, যেখানে দুর্ঘটনা ঘটেছে, সেখান থেকে সিডিএ ড্রেনের ওপর থেকে স্ল্যাব তুলে নিয়েছে এবং ফুটপাথের আকার ৫ ফুট থেকে কমিয়ে ১.৫ ফুটে নামিয়েছে।
গতকাল দুর্ঘটনাস্থল সরেজমিনে পরিদর্শন করে দেখা গেছে সিসিসি সেখানে একটি বাঁশের তৈরি বেড়া স্থাপন করেছে।
আগ্রাবাদের বাদামতলী এলাকার দোকানদার পরিমল বড়ুয়া জানান, গত ৫ দিনে ২ নারীসহ কমপক্ষে ৭ জন ব্যক্তি একই জায়গায় ড্রেনে পড়ে গেছেন।
তিনি বলেন, 'আমরা কোনোমতে তাদেরকে উদ্ধার করতে পেরেছি। এ ধরনের দুর্ঘটনাগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রাতের বেলায় হচ্ছে, কারণ এই জায়গাটি অন্ধকার থাকে এবং পথচারীরা দূর থেকে ড্রেন দেখতে পান না।'
সিসিসি'র সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, শহরে ৯৪৬ কিলোমিটার ড্রেন আছে, যার বেশিরভাগ অংশই খোলা, সংকুচিত এবং প্লাস্টিক ও অন্যান্য আবর্জনায় ভর্তি।
সিডিএ শহরের জলাবদ্ধতা সমস্যার সমাধানের জন্য একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এ কারণে সিসিসি ড্রেনগুলোর দায়িত্ব সিডিএ'র কাছে হস্তান্তর করেছে। প্রকল্পের আওতায় সিডিএ ড্রেনগুলোকে আরও বড় করছে, যাতে সেখান থেকে পানি সহজে নদীতে প্রবাহিত হতে পারে।
সিডিএ সারা শহর জুড়ে বিস্তৃত প্রায় ১ হাজার ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ ড্রেনগুলোর উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ করবে।
যে ড্রেনগুলোকে প্রসারিত করা হয়েছে, সেগুলো এখন পর্যন্ত খোলা রেখে দেওয়া হয়েছে। এ কারণে এলাকাগুলোতে যখন জলাবদ্ধতা দেখা দেয়, তখন ড্রেন এড়িয়ে চলতে পথচারীরা সমস্যায় পড়েন। রাতের অন্ধকারেও একই সমস্যায় পড়েন তারা।
সরেজমিনে পরিদর্শন করে শহরের দুই নাম্বার গেট থেকে বহদ্দারহাট পর্যন্ত সিডিএ'র ২ কিলোমিটার দীর্ঘ ড্রেন সম্পূর্ণ খোলা অবস্থায় পাওয়া গেছে। এই এলাকায় তীব্র জলাবদ্ধতা সমস্যা আছে। আগ্রাবাদের অ্যাক্সেস সড়ক, বন্দরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনকারী সড়ক এবং শেখ মুজিব সড়কের কিছু অংশেও ড্রেনগুলোকে খোলা অবস্থায় থাকতে দেখা গেছে।
বহদ্দারহাট এলাকার বাসিন্দা শহীদুল ইসলাম স্বপন দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, জলাবদ্ধতার সময় কোনটা সড়ক আর কোনটা ড্রেন, তা বোঝা খুবই কষ্টকর।
তিনি বলেন, 'অন্তত একটি সতর্কতামূলক নির্দেশিকা থাকলেও মানুষ ড্রেনে পিছলে পড়া এড়িয়ে চলতে পারবে।'
নগর পরিকল্পনাবিদ ও প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া জানান, ঠিকাদারকে দেওয়া যেকোনো সরকারি প্রকল্পের শর্তে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা থাকে, প্রকল্পের কাজ চলাকালীন সময় সার্বক্ষণিক জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, 'ড্রেন ও খালগুলো খোলা রেখে দেওয়া হয়, যার কারণে পথচারীদের দুর্ঘটনায় পড়ার ঝুঁকি বাড়ে। সিসিসিও এই দায়িত্ব এড়াতে পারে না, কারণ তারাও বেশিরভাগ ড্রেনে আচ্ছাদন কিংবা বেড়া দেয়নি।'
ইতোমধ্যে, একের পর এক মানুষ ড্রেনে পড়ে মারা যাচ্ছেন।
১৫ আগস্ট ৫০ বছর বয়সী সবজি বিক্রেতা সালেহ আহমেদ শহরের মুরাদপুর এলাকার একটি ড্রেনে পা পিছলে পড়ে যান। দমকলকর্মীরা ৩ দিন উদ্ধারপ্রচেষ্টা চালিয়েও তার মরদেহ খুঁজে পায়নি। এরপর তারা উদ্ধার কার্যক্রমের সমাপ্তি ঘোষণা করেন।
এর আগে, ৩০ জুন একটি সিএঞ্জিচালিত অটোরিক্সা ষোলশহর এলাকার একটি ড্রেনে পড়ে যায়। ঘটনাস্থলেই ২ জন যাত্রী নিহত হন।
সাদিয়ার মরদেহ উদ্ধারের কয়েক ঘন্টা পর তার সহপাঠীরা শেখ মুজিব সড়ক অবরুদ্ধ করে রাখেন। কর্তৃপক্ষের অবহেলার প্রতিবাদ করেন তারা এবং তার মৃত্যুর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের দাবি জানান।
অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান
Comments