অবহেলায় শিশুর মৃত্যু: পরিবারকে সমঝোতার চাপ

রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালের ডাক্তার-কর্মচারীদের অবহেলায় ১১ মাস বয়সী শিশুর মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলে অভিযোগ জানানোর পর থেকে সমঝোতার জন্য চাপ আসতে শুরু করেছে বলে দ্য ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন ওই শিশুর বাবা-মা।

২২ আগস্ট রাজধানীর কেয়ার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের ৬ ঘণ্টা পর আব্দুল্লাহ আল সায়েম ও তানজুম আক্তারের একমাত্র সন্তান আজানের মৃত্যু হয়। এই দম্পতি জানান, তালু কাটা অপারেশনের পর তাদের ছেলের শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল।

তাদের অভিযোগ, অস্ত্রোপচারের পর আজানকে পোস্ট অপারেটিভ ও সাধারণ ওয়ার্ডে রাখা হয়েছিল, কিন্তু সেখানে কোনো ডাক্তার ছিলেন না।

আজানের শ্বাসকষ্ট শুরু হওয়ার পর তার বাবা-মা তাকে দুবার অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যান, কিন্তু সেখানকার ডাক্তাররা তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন বলেও অভিযোগ করেন তারা।

বিচার চেয়ে আব্দুল্লাহ আল সায়েমের পরিবার গত ২৯ আগস্ট স্বাস্থ্য অধিদপ্তর (ডিজিএইচএস) ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) কাছে পৃথক অভিযোগ দায়ের করেন।

অভিযোগে তারা জানান, তাদের সন্তান 'ডাক্তারদের অবহেলা' এবং 'হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতার' কারণে মারা গেছে। 

সায়েম গত বুধবার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'অভিযোগ জানানোর পর থেকেই আমাদের সমঝোতার জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে।'

'গত সপ্তাহে আমি এক ব্যক্তির কাছ থেকে ফোনকল পাই, যিনি নিজেকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় দেন। তিনি আমাকে অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেওয়ার অনুরোধ জানান।'

সায়েম আরও বলেন, 'যে ডাক্তার অপারেশন করেছিলেন, তিনি বারবার ফোন করে আমাদের ওপর মানসিক চাপ তৈরির চেষ্টা করছেন। আমি শুধু ন্যায়বিচার চাই।'

নবজাতকদের মধ্যে ক্লেফট প্যালেট বিরল কোনো সমস্যা নয়। এই সমস্যা নিয়ে জন্মানো শিশুদের ওপরের ঠোঁট ও তালুতে একটি দিক খোলা থাকে। এসব শিশুদের খেতে এবং কথা বলতে সমস্যা হয়, কারণ খাবার ও পানীয় গলা দিয়ে পেটে না গিয়ে সেই কাটা অংশ দিয়ে বের হয়ে যায়।

ঠোঁট ও তালুর কাটা অংশটিকে অপারেশনের মাধ্যমে সেলাই করে জুড়ে দিয়ে চিকিৎসা করা হয়।

আজানের সঙ্গে যা ঘটেছিল

গত ২২ আগস্ট আজানসহ আরও সাত শিশুর তালু কাটা অপারেশন পরিচালনা করেন ডা. বি কে দাস বিজয়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি দাতব্য সংস্থার অর্থায়নে আয়োজিত বিনামূল্যের ক্যাম্পেইনে ওই অপারেশন করা হয়।

ডা. বিজয় দুপুর আড়াইটা থেকে ৪টা ১৫ পর্যন্ত আজানের অপারেশন পরিচালনা করেন বলে জানান সায়েম ও তানজুম।

অপারেশনের পর অজ্ঞান অবস্থায় ছেলেটিকে পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ডে রাখা হয় এবং প্রায় সন্ধ্যা ৭টার দিকে তাকে সাধারণ ওয়ার্ডে স্থানান্তর করা হয়।

অভিভাবকরা তাদের লিখিত অভিযোগে বলেন, 'পোস্ট-অপারেটিভ ওয়ার্ড কিংবা সাধারণ ওয়ার্ডে কোনো ডাক্তার ছিলেন না। আমাদের সন্তানের শ্বাসকষ্ট বাড়তে থাকায় আমরা তাকে দুবার অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাই। দুবারই ডা. বিজয়সহ অন্যান্য ডাক্তাররা আমাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন।'

'ডিউটিতে থাকা নার্স আমাদের অজ্ঞান সন্তানকে সিরাপ খাওয়াতে বাধ্য করেন। ওষুধ সেবনের পর ওর অবস্থা গুরুতর পর্যায়ে চলে যায়। কিন্তু এবারও ডা. বিজয় রূঢ়ভাবে আমাদেরকে বলেন, এটি কোনো সমস্যা নয়। এরপর রাত ৯টার দিকে তিনি আমাদের অপারেশন থিয়েটার থেকে বের করে দেন।'

'আমরা আমাদের বাচ্চাকে সাধারণ ওয়ার্ডে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার পর রাত ১০টার দিকে সে মারা যায়।'

'যেহেতু আমাদের সন্তানের আগে থেকে স্নায়বিক জটিলতা ছিল, আমরা তার সব প্রেসক্রিপশন এবং পরীক্ষার রিপোর্টগুলো ডা. বিজয়কে দেখাই। কিন্তু তিনি জানান, অপারেশনের সঙ্গে সেগুলোর কোনো যোগসূত্র নেই', বলেন তারা। 

পরিবারটি আরও অভিযোগ করেছে, মৃত্যু সনদে তাদের সন্তানকে ভর্তি করার দিন হিসেবে ২১ আগস্টের পরিবর্তে ২২ আগস্ট লেখা হয়েছে।

মৃত্যু সনদে মৃত্যুর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে 'অ্যাসপিরেশন নিউমোনিয়া', যেটি এক ধরনের ফুসফুসের সংক্রমণ।

ডা. বিজয় দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বাচ্চাটি 'ল্যারিঞ্জোস্প্যাসমে' আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। এই সমস্যার কারণে সাময়িকভাবে কথা বলতে বা শ্বাস নিতে কষ্ট হয়।

সাধারণত ল্যারিঞ্জোস্প্যাসম ৬০ সেকেন্ড ধরে চলে। তবে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে এটি ২০ থেকে ৩০ মিনিট ধরেও চলতে পারে এবং আংশিকভাবে নিঃশ্বাস টেনে নিতে বাধার সৃষ্টি হতে পারে। তবে, নিঃশ্বাস বের করার প্রক্রিয়াটি তখনো সহজতর থাকে বলে জানিয়েছেন মেডিকেল বিশেষজ্ঞরা।

এই সংবাদদাতা তিন জন ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলেছেন, যাদের মধ্যে একজন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞও ছিলেন। তারা প্রত্যেকেই জানিয়েছেন, ল্যারিঞ্জোস্প্যাসমের কারণে মৃত্যু ঘটার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তবে, অ্যাসপিরেশন নিউমোনিয়ার ক্ষেত্রে সময়মতো চিকিৎসা করা না হলে তা খুবই ভয়াবহ হতে পারে।

গাজীপুরের শফিপুরে অবস্থিত মডার্ন হাসপাতালের শিশু চিকিৎসক ডা. এ কে এম শাফায়াত লস্কর দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ল্যারিঞ্জোস্প্যাসম অথবা অ্যাসপিরেশন নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে কোনো শিশু মারা যাওয়ার কথা না। নিশ্চিতভাবেই শিশুটির অন্য কোনো জটিলতা ছিল।'

জাতীয় ক্যান্সার ইনস্টিটিউট হাসপাতালে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আরেকজন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. লস্করের সঙ্গে একমত হন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ডাক্তার বলেন, 'শিশুর মৃত্যুর পেছনে অন্য কোনো কারণ থাকতে পারে। হয়তো সে অপারেশনের জন্য প্রস্তুত ছিল না। কিন্তু অ্যানেস্থেসিস্ট সে ব্যাপারে জানতেন না।'

১১ সেপ্টেম্বর ডা. বিজয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, 'আমি স্বীকার করি, সে মুহূর্তে সেখানে (ওয়ার্ডে) একজন ডাক্তার থাকলে ব্যাপারটা ভিন্ন হতো।'

তবে, তিনি শিশুটির অভিভাবকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের অভিযোগটি নাকচ করে দেন।

রোববার দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আবারও কথা বলতে গিয়ে ডা. বিজয় বলেন, 'সায়েমকে কে ফোন করেছে সে ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না।' কেন তিনি বারবার সায়েমকে ফোন করছেন, সে প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, 'শোকপ্রকাশ করা ছাড়া আমার আর তাদের কিছু দেওয়ার নেই। আমি সে উদ্দেশ্যেই ফোন করছিলাম।'

মঙ্গলবারে কেয়ার হাসপাতালের অন্যতম পরিচালক ডা. গোলাম মোর্শেদ সুমনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, 'বিষয়টি নিয়ে এখনো তদন্ত চলছে। এ মুহূর্তে আমাদের কোনো মন্তব্য নেই।'

ইতোমধ্যে ৯ সেপ্টেম্বর বিএমডিসি ডা. বিজয়কে ১৫ দিনের মধ্যে লিখিত ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য একটি নোটিশ পাঠিয়েছে।

এ ছাড়া, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে এই বিষয়টির তদন্ত করে একটি প্রতিবেদন জমা দেওয়ারও নির্দেশ দিয়েছে।

সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের পরিচালক ডা. খলিলুর রহমান গতকাল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা এ সপ্তাহের শুরুর দিকে একটি কমিটি করেছি। কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার অনুরোধ করা হয়েছে।'

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান।

 

Comments

The Daily Star  | English

Teknaf customs in limbo as 19 mt of rice, authorised by AA, reaches port

The consignment of rice weighing 19 metric tonnes arrived at Teknaf land port on Tuesday evening with the documents sealed and signed by the Arakan Army

5h ago