ক্রিকেটই ছিল যার বেঁচে থাকার অক্সিজেন

ছবি: সংগৃহীত

'মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ যেন সেই প্রাচীন নাবিক, আশঙ্কার ঢেউ উজিয়ে জাহাজ বন্দরে পৌছানো যার পেশাগত অভ্যাস। লোকটাকে আরো কিছুদিন সমাদরে সহ্য করা উচিত।'

গত ৮ সেপ্টেম্বর হাসপাতালের বিছানায় শুয়েই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এই পোস্ট দিয়েছিলেন জালাল আহমেদ চৌধুরী।

সেদিন মিরপুরে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে মাত্র ৯৪ রান তাড়া করতে গিয়ে চরম বিপদে পড়ে গিয়েছিল বাংলাদেশ দল। অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ পরে ৪৮ বলে ৪৩ রান করে দলকে জেতান। এর আগে ১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ও নিউজিল্যান্ডের টি-টোয়েন্টি সিরিজ শুরুর দিনই শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন গুণী এই ক্রিকেট ব্যক্তিত্ব।

কিন্তু ক্রিকেট যার রক্তে মেশা, রোগশয্যাতেও তা থেকে যেন বিচ্ছেদ হয় না! খানিকটা সেরে উঠতে হাসপাতালে বসেই উপভোগ করেন বাংলাদেশের খেলা।

শুধু বাংলাদেশের খেলা বলেই নয়। যেকোনো আকর্ষণীয় ক্রিকেট ম্যাচেই মজে অফুরান আনন্দ খুঁজে নিতে দেখা যেত জালাল আহমেদকে। অসুস্থ হওয়ার কদিন আগেই ভারত-ইংল্যান্ডের লর্ডস টেস্টের শেষ দিনের রোমাঞ্চে ভেসে লিখেছিলেন, 'উত্তেজনা, উৎকণ্ঠা, রোমাঞ্চ কী নেই টেস্ট ক্রিকেটে। শেষ দিনের শেষ বেলায় লর্ডস শেষ পাতার অক্ষর সাজাচ্ছে এক অনুপম ক্রিকেট থ্রিলারের। ভারত নিতে চায় তিন উইকেট, ইংল্যান্ড খেলে যেতে চায় পনের ওভার। দুই লক্ষ্যই আছে সম্ভাবনার বৃত্তে।'

ওই টেস্টেরই আরেকটা অংশে ক্রিকেটের রসে ডুবে যান তিনি, 'জো রুটের ব্যাটের পেশাদারী নান্দনিকতা আর গতিঋদ্ধ (মোহাম্মদ) সিরাজের আমুদে ছটফটানি দেখতে দেখতে উপভোগ্য হয়ে উঠেছে লর্ডসের ক্রিকেটউষ্ণ অপরাহ্ন। ম্যাচের নিক্তি ভারসাম্যাবস্থায়।'

কোনো ক্রিকেট ম্যাচে জালাল আহমেদের ফেসবুকের খেরোখাতায় আর পাওয়া যাবে না এমন কোনো পোস্ট। এসব হিসাব-নিকাশেরই যে বাইরে চলে গেছেন তিনি। মঙ্গলবার (২১ সেপ্টেম্বর) সকাল ১১টা ৫ মিনিটে চুয়াত্তরে থেমে গেল তার জীবনের ইনিংস।

তবে বাংলাদেশের ক্রিকেটের সব্যসাচী এই ব্যক্তিত্বের পরিচয় নিক্তিতে মাপার উপায় নেই! দেশের অন্যতম সেরা ক্রীড়া লেখক ছিলেন তো বটেই, ক্রিকেটের সঙ্গে তার জড়িয়ে পড়া একদম ক্রিকেটার হিসেবেই। সত্তর ও আশির দশকে দেশের শীর্ষ পর্যায়ে খেলেছেন।

জালাল আহমেদ পরে হয়ে যান কোচ। তার হাত ধরে বেরিয়েছে দেশের অনেক প্রতিভা। ১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফি দলকেও প্রথম একতাবদ্ধ করেন তিনিই। মাশরাফি বিন মর্তুজা, মোহাম্মদ আশরাফুলদের মতো তারকাদের কাছে ছিলেন গুরু। ক্লাব ক্রিকেটে রাখেন বিস্তর অবদান।

ছবি: সংগৃহীত

ক্রিকেট নিয়ে তার জানাশোনা ছিল প্রখর। লেখার হাত ছিল ধারাল। ক্রীড়া সাংবাদিকতাকে তাই ভালোবেসে ফেলেছিলেন। আমৃত্যু সেই লেখালেখির সঙ্গেই জড়িয়ে ছিলেন। স্থান করে নিয়েছিলেন ক্রীড়াপিপাসুদের অন্তরের মণিকোঠায়।

সর্বোপরি, আধুনিক ক্রিকেটের রঙিন-ঝলমলে যুগে জালাল আহমেদ ছিলেন এক শুভ্র মনের প্রতিমূর্তি, ক্রিকেটের আদিম ও কুলীন সত্ত্বার সমান্তরালে।

১৯৪৭ সালে বর্তমান ভারতের করিমগঞ্জে জন্ম তার। সিলেটের অংশ করিমগঞ্জ পরে রাজনৈতিক খেলায় হয়ে যায় ভিনদেশ। তিনি পরিবারসহ চলে আসেন এপার বাংলায়। দেশভাগের ক্ষত নিয়ে উপমহাদেশের এই অঞ্চলের শেকড়হীনদের ব্যথা ছিল তার বুকেও।

গত ৯ সেপ্টেম্বর প্রথম দফায় হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে ফেসবুকে তার চিরায়ত লেখনি শক্তি দিয়ে জালাল আহমেদ জানান দিয়েছিলেন বেঁচে থাকার, 'আটদিন পর হাসপাতালের বাইরে। মুঠোমুঠো ঔষধ,বাড়তি অক্সিজেনের ব্যবস্থা আর নানা বিধিনিষেধ দিয়ে ডাক্তার বাড়ি পাঠিয়েছেন। বাড়ি বলতে বোনের বাসা, আমার বিপত্নীকের ডেরায় ফেরা যাবে না, সেবা-যত্নের অভাবের কারণে। বিপন্ন ফুসফুস নিয়ে আরো কিছুদিন ঠেলা ধাক্কার জীবনযাপনের অনুশীলন করতে হবে। আমার মাঠতুতো অনুজেরা এ কদিন আমাকে প্রচণ্ড মানসিক শক্তি যুগিয়েছেন। আমার পায়ের নিচের মাটি হয়ে, মাথার উপর আকাশ হয়ে ছিলেন এবং আছেন পুত্র-কন্যা, ভাইবোনসহ সকল আত্মীয়-স্বজনেরা। নিকটজনদের এই আত্মিক বন্ধন, আল্লাহর বিশেষ নিয়ামত, আলহামদুলিল্লাহ।

উদ্বিগ্ন বন্ধুদের যোগাযোগ, প্রতিবেশীদের সহযোগিতা আমাকে প্রফুল্ল রেখে নিরাময়ে সহায়তা করছে। সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা। আমার তিন তরুণ ভাগ্নে দিবানিশি পালা করে হাসপাতালে সঙ্গ দিয়েছে এবং এখনো তাদের মূল্যবান কর্মসময় হাসিমুখে আমাকে উপহার দিয়ে যাচ্ছে। তিনজনই বিশ্ববিদ্যালয় সমাপ্ত করে সম্মানজনক পেশায় নিয়োজিত। এরা পরস্পর খালাতো ভাই। দোয়া করি তাদেরকে আল্লাহ যথাসময়ে টুকটুকে সুশীলা সহধর্মিণী দান করুন।

বুঝতে পারছি, এ পর্যন্ত যাপিত জীবনের সম্পূর্ণ বিপরীতভাবে প্রাত্যহিকতা পালন করতে হবে এখন থেকে। সুস্থ থাকার জন্য প্রিয় অভ্যাস ভুলে থাকার সাধনায় হতেই হচ্ছে হিমকাতর। এ কাতরতা অজেয় নয়। সবাই শুভকামনা রাখবেন।'

Jalal Ahmed Chowdhury
জালাল আহমেদ চৌধুরী। ফাইল ছবি

পরদিন আম্পায়ার নাদির শাহর মৃত্যুর খবর ব্যথিত করে তোলে তাকে। সেই দুঃখগাঁথাও ভাগ করেছিলেন ফেসবুকে, 'রোগশয্যায় শুয়ে খেলা দেখছি। টিভির পর্দা জুড়ে আম্পায়ার (শরফুদ্দৌলা) সৈকতের ছবি ভাসলেই মনে হয় অন্যপ্রান্তে নাদির শাহ আছে। ওভার শেষ হলে মুখোমুখি দেখতে পাব। মুহূর্তকালের কল্পনা ভেসে যায় বাস্তবতার পাথুরে আঘাতে। নাদির শাহ তো আর আসবে না। তাঁর সদাহাস্য মুখ, মন আর ক্রিকেটীয় মাধুর্য নিয়ে সে এখন প্রকৃতিতে একাকার। ক্রিকেটজনতার স্মৃতিতে অম্লান থাকবে তার আম্পায়ারিং ভঙ্গী, তার ক্রিকেটীয় বাকচাতুর্য। পিঞ্চহিটিং ওপেনার ও লেগস্পিনারটি হয়তো হারিয়ে গেছে আম্পায়ারিং জনপ্রিয়তার আড়ালে কিন্তু নাদিরের সমসাময়িক ক্রিকেটাররা মনে রাখবেন তার সোজা ব্যাটের আগ্রাসন আর ফ্লাইটেড কব্জিঘুরানো বলগুলোকে। প্রিয় অনুজকে হারানো শোকাহত আমরা মনে রাখব আরো বহুবিধ অনুষঙ্গের বাবুকে। আমাদের ক্রিকেট আড্ডাগুলোতে বহুদিন বইবে নাদির শাহ নামের উদাসী হাওয়া।

আমাদের সম্মিলিত প্রার্থনা নাদিরের বিদেহী আত্মার চিরকল্যাণের জন্য। নিশ্চয় আল্লাহ অজাতশত্রু, পরোহিতকারী, পরমবিশ্বাসী তার বান্দাকে ক্ষমা করে হেফাজতে রাখবেন। মানুষের ভালোবাসা অবশ্যই পরকালের পাথেয়। আমিন।'

ঠিক এগার দিন পর তার জন্যও এমন শোকগাঁথা লিখতে হবে তখন কি টের পেয়েছিলেন?

জীবনের প্রায় পুরোটা সময় ক্রিকেট নিয়ে পড়েছিলেন, ক্রিকেটই যেন ছিল তার বেঁচে থাকার অক্সিজেন।

ক্রিকেটের মতো রবীন্দ্রনাথের গানেরও ভীষণ সমঝদার ছিলেন জালাল আহমেদ। তার বিদায় বেলায় তাই রবীন্দ্রনাথে আশ্রয় নেওয়াই যায়, 'আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহ দহন লাগে।' 

Comments

The Daily Star  | English

5 killed as train hits auto-rickshaw in Cumilla

The accident took place when the Chattogram-bound Chattala Express train hit a battery-run auto-rickshaw in Kalikapur area

21m ago