‘মতপ্রকাশ কি ঘরবাড়ি ভাঙচুরের চেয়েও বড় অপরাধ?’

এক বছর বয়সী ইশান দাশ সৌম্য বিছানায় হাসতে হাসতে খেলছিল, কিন্তু পাশেই তার মা সুইটি রানী দাশ কান্নাভেজা চোখে ৬ মাস আগের একটি বিভীষিকাময় রাতের কথা স্মরণ করছিলেন।

'গত ৬ মাসে আমার স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে পেরেছি মাত্র একবার। কী এমন অপরাধ তার, যে কারণে গত ৬ মাস বিনা বিচারে ও বিনা জামিনে কারাগারে থাকতে হচ্ছে?—প্রশ্ন সুইটি রানী দাশের।

তার স্বামী, সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার নোয়াগাঁও গ্রামের ঝুমন দাশ (২৫), গত ১৬ মার্চ রাতে আটক হওয়ার পরদিন ১৭ মার্চ থেকে কারাগারে আছেন।

হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের তৎকালীন যুগ্ম-সম্পাদক মামুনুল হককে সমালোচনা করে ফেসবুকে পোস্ট দেয়ায় আটকের ৫ দিন পর ২২ মার্চ তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করে পুলিশ।

গ্রেপ্তারের পর থেকে এখন পর্যন্ত সুনামগঞ্জের আদালতে ৪ বার এবং উচ্চ আদালতে একবার নাকচ হয়েছে তার জামিন আবেদন।

দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে সুইটি বলেন, 'তিনি (ঝুমন) পরিবারের একমাত্র অর্থ উপার্জনকারী ব্যক্তি। এখন আমাদের সংসার চলছে মানুষের দান আর ঋণের টাকায়। এই ধারদেনা কীভাবে শোধ করবো তাও আমি জানি না।'

তিনি বলেন, 'তিনি জামিন পেলেও পরবর্তীতে আদালতে দীর্ঘদিন ধরে এই মামলা পরিচালনা করার সামর্থ্য আর আমাদের নেই।'

সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার পার্শ্ববর্তী দিরাই উপজেলায় গত ১৫ মার্চ হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের এক জনসমাবেশ হয়, যেখানে সংগঠনটির তৎকালীন যুগ্ম-সম্পাদক মামুনুল হক বক্তব্য রাখেন।

মামুনুল হকের সমালোচনা করে ১৬ মার্চ ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন ঝুমন। তার এই পোস্টকে কেন্দ্র করে দিরাই ও শাল্লা উপজেলার হেফাজত সমর্থক স্থানীয়দের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হয়।

সেদিন রাতে কয়েকশ হেফাজত সমর্থক ঝুমনের গ্রেপ্তার দাবিতে নোয়াগাঁওয়ের পার্শ্ববর্তী ধারাইন বাজারে সমবেত হয় এবং ঝুমন দাশকে গ্রেপ্তার না করা হলে হিন্দু অধ্যুষিত নোয়াগাঁওয়ে হামলার হুমকি দিতে থাকেন।

সে রাতের কথা স্মরণ করে সুইটি বলেন, '১৬ মার্চ রাত সাড়ে ৮টার দিকে কিছু মানুষ জড়ো হয়ে মিছিল নিয়ে আসে, আমার স্বামী ঝুমন দাশের ফাঁসি চায়, ওকে মেরে ফেলতে চায়। আমি তখনও বুঝতে পারিনি। তখন সে (ঝুমন) কোনো একটা কাজে বাইরে গিয়েছিল।'

তিনি বলেন, 'রাত সাড়ে ১১টার দিকে শাঁসখাই বাজারে আমার স্বামীকে আটক করে শাঁসখাই গ্রামের লোকজন। আমাদের গ্রামের সবাই তাদেরকে খবর পাঠিয়েছিল যে ওকে (ঝুমন) আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দিতে।'

সুইটি বলেন,'উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ও গ্রামের সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেন যে ওকে (ঝুমন) প্রশাসনের কাছে তুলে দেয়া হবে এবং সে রাতেই পুলিশের কাছে তাকে সোপর্দ করা হয়। আমি তখনও জানতাম না যে আমার স্বামীর উপর এতবড় একটা মামলা দেয়া হবে।'

ঝুমনকে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় আটকের পর ১৭ মার্চ আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়।

স্থানীয় হেফাজতে ইসলাম সমর্থকদের শান্ত করতে ঝুমন দাশকে আটক করা হলেও পরদিন ১৭ মার্চ সকালে হেফাজতে ইসলাম সমর্থকরা হামলা চালায় নোয়াগাঁওয়ে। হামলায় হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্তত ৯০টি ঘর ও ৪টি মন্দির ভাঙচুর করেন তারা।

সুইটি বলেন, 'উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন চেয়ারম্যানসহ প্রশাসনের সবাই বলেছিলেন যে কোনো ভয় নাই, কোনো দুর্ঘটনা ঘটবে না এবং সবাই শান্তিতে থাকতে পারবে। শান্তির জন্য আমার স্বামীকে আগের রাতে ধরে পুলিশে দেয়ার পরও হামলা হবে তা আমি কল্পনাও করিনি।'

তিনি বলেন, 'সকাল সাড়ে ৭টার দিকে মিছিল দিয়ে চতুর্দিক থেকে গ্রাম ঘিরে ফেলে গ্রামে ঢুকে যায় তারা।'

সেদিন ধারাইন বাজারের কালিমন্দিরসহ গ্রামের অন্তত ৪টি মন্দিরে ভাঙচুর চালায় হামলাকারীরা। হামলায় গ্রামবাসীদেরও কয়েকজন আহত হন। ঝুমন দাশের স্ত্রী সুইটিও হামলাকারীদের লাঠির আঘাতে আহত হয়েছিলেন।

'ওরা যখন গ্রামে ঢুকে যায় তখন আমি পালাতে পারিনি। আমার ছেলেকে নিয়ে আমার ননদ পালিয়ে যেতে পারে। আমি ঘরের ভিতরেই লুকিয়ে ছিলাম। তারা বাড়িতে ঢুকে প্রথমে ভাঙচুর করে চলে যাওয়ার সময় কেউ তাদেরকে বলে যে এটাই ঝুমন দাশের ঘর। তখন তারা আবারো ঘরে ঢোকে।'

'আবার ভাঙচুর শুরু করার সময় আমার শাড়ির আঁচল দেখতে পেয়ে তারা আমাকে 'মালাউনের বাচ্চা' বলে বের হতে বলে। আমি তখন অনেক ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তারপর তাদের একজন লাঠি দিয়ে আমার মাথায় আঘাত করতে চায়, তখন আমি হাত দিয়ে ফেরাতে গেলে আমার বাম হাতে আঘাত লাগে। তারা আমার গলায় ছুরিও ধরে রাখে এবং যা কিছু আছে স্বর্ণ টাকাপয়সা সব দিয়ে দিতে বলে। তখন আমি ভয়ে সবকিছু দিয়ে দিই।'

হামলার পরদিন শাল্লা থানায় দুটি মামলা করা হয়। একটি দায়ের করেন হবিবপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং নোয়াগাঁওয়ের বাসিন্দা বিবেকানন্দ মজুমদার বকুল এবং অপর মামলাটি করেন শাল্লা থানার উপ-পরিদর্শক আব্দুল করিম।

দুটি মামলায় দিরাই উপজেলার সরমঙ্গল ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার ও পার্শ্ববর্তী নাচনি গ্রামের বাসিন্দা শহিদুল ইসলাম স্বাধীনকে প্রধান আসামি করা হয় এবং অসংখ্য ব্যক্তির নাম উল্লেখ ছাড়াও দেড় হাজার আসামিকে অভিযুক্ত করা হয়।

মার্চের ২০ তারিখে মৌলভীবাজার থেকে আটক করা হয় শহিদুল ইসলাম স্বাধীনকে। শেষ পর্যন্ত মোট ৪৮ জনকে এই মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।

পরবর্তীতে পহেলা এপ্রিল, ঝুমন দাশের মা নিভা রানী দাশ সুনামগঞ্জের আদালতে শহীদুল ইসলাম স্বাধীনকে প্রধান আসামি করে মোট ৭২ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত ২ হাজার জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন।

ঝুমনের জামিন হয় না, হামলাকারীরা মুক্ত

১৬ মার্চ আটকের পর ২২ মার্চ পুলিশ ঝুমন দাশের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা করে। সেই মামলায় ঝুমনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয় ২৪ মার্চ।

মামলাটি প্রথমে শাল্লা থানার উপ-পরিদর্শক আমির খসরু তদন্ত করেন এবং পরে তদন্তভার সুনামগঞ্জ জেলা পুলিশের গোয়েন্দা শাখাকে দেয়া হয়।

এপ্রিলের ২০ তারিখ ঝুমন দাশের দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন সুনামগঞ্জের আদালত এবং এপ্রিলের ২৯ তারিখ একই আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারা অনুযায়ী স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করেন।

মে মাসের ২ তারিখ থেকে জুলাই মাসের ২১ তারিখ পর্যন্ত সুনামগঞ্জ আদালতে ৪ বার এবং উচ্চ আদালতে একবার ঝুমন দাশের জামিন নামঞ্জুর হয়।

জুলাইয়ের ২৭ তারিখে ঝুমন দাশকে একমাত্র আসামি হিসেবে অভিযুক্ত করে সুনামগঞ্জ আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় সুনামগঞ্জজেলা পুলিশের গোয়েন্দা শাখা।

গোয়েন্দা শাখার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইকবাল বাহার চৌধুরী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যে সব ধারায় ঝুমন দাশের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল, তা সবই তদন্তে সত্য প্রমাণিত হয়েছে। তিনি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন এবং তার ফেসবুক পোস্টের সত্যতা ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টের (সিআইডি) ফরেনসিক বিভাগ থেকেও নিশ্চিত হওয়া গেছে।'

যখন ঝুমন দাশ বিনা জামিনে কারান্তরীণ, তখন নোয়াগাঁওয়ে হামলার নেতৃত্বদানকারীসহ অন্যান্য হামলাকারীরা জামিনে মুক্ত।

ঝুমনের স্ত্রী সুইটি দাশের প্রশ্ন, 'মত প্রকাশ কি মানুষের বাড়িঘর ও মন্দির ভাঙচুরের চেয়েও বড় অপরাধ?'

গত ২১ জুন হামলার ঘটনার প্রধান আসামি শহিদুল ইসলাম স্বাধীনের জামিন মঞ্জুর করেন সুনামগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ। এছাড়াও এই মামলার আরও অন্তত ১৮ আসামি বিভিন্ন সময়ে আদালত থেকে জামিন পেয়েছেন।

ঝুমনের আইনজীবী দেবাংশু শেখর দাশ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রায় সবকটি ধারাই জামিন অযোগ্য। আদালত এই অজুহাতেই জামিন নামঞ্জুর করছেন। কিন্তু আমাদের যুক্তি এই ঘটনাটি নিছক কোনো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলা নয়, বরং এর সাথে জড়িয়ে আছে একটি সাম্প্রদায়িক হামলাও এবং এই বিষয়টি বিবেচনায় আনতে হবে।'

উচ্চ আদালতের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'জামিন একান্তই আদালতের এখতিয়ার এবং আইনে না থাকলেও একজন বিচারক বিভিন্ন দিক বিবেচনায় জামিন মঞ্জুর করতে পারেন। ঝুমন একটি শিশুসন্তানের পিতা, তার পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি—এসব নানাদিক বিবেচনা করে আদালত তার জামিন দিতে পারেন।'

তিনি বলেন, 'নোয়াগাঁওয়ে হামলার প্রধান অভিযুক্ত ব্যক্তিসহ অনেকেই জামিনে আছেন। লেখালেখি এবং মত প্রকাশ কি একটি গ্রামে ন্যাক্কারজনক হামলার চেয়েও গুরুতর অপরাধ- আদালত এই বিষয়টি জামিনের বিবেচনায় রাখতে পারেন।'

সর্বশেষ ঝুমন দাশের আইনজীবী হিসেবে আইনবিদ জেড আই খান পান্না উচ্চ আদালতে সম্প্রতি একটি জামিন আবেদন করেছেন, যার শুনানি এখনো হয়নি।

Comments

The Daily Star  | English

Crowd control: Police seek to stop use of lethal weapon

The police may stop using lethal weapons and lead pellets for crowd control as their widespread use during the July mass uprising led to massive casualties and global criticism.

1h ago