সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম

কমিউনিটি গাইডলাইন গুরুত্বপূর্ণ হলেও সব ক্ষেত্রে যথার্থ নয়

বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি কামরুল হোসেন মোল্লার হাইকোর্ট বেঞ্চ গত ৫ সেপ্টেম্বর জনস্বার্থে করা একটি মামলার শুনানির সময় বিটিআরসিকে বলে, তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে মানহানিকর ও ভাইরাল হওয়া কন্টেন্টগুলো অপসারণের ব্যাপারে ইচ্ছুক না।

গণমাধ্যম পরীমণির চরিত্র হননের চেষ্টা করেছে উল্লেখ করে হাইকোর্ট বেঞ্চ জানায়, বিষয়টি এতদূর গড়ায় যে বিটিআরসি সেগুলো 'অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া বন্ধ করতে পরাতো। কিন্তু তারা সেটা করেনি... তারা যেন সেটা উপভোগ করছে।' এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য তারা হাইকোর্টের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনার অপেক্ষা করেছে।

এর জবাবে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার জানান, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে কনটেন্ট সরানোর সক্ষমতা বিটিআরসির নেই। 'সরকার অসহায়' উল্লেখ করে সংবাদ সম্মেলনে জব্বার বলেন, ফেসবুক ও ইউটিউব প্রায়ই মানহানিকর কনটেন্ট অপসারণে বাংলাদেশের অনুরোধে সাড়া দেয় না। কারণ সেগুলো তাদের কমিউনিটি গাইডলাইন লঙ্ঘন করে না।

খালি চোখে, এই এদিক-ওদিক ছোটাছুটির বিষয়টি কানামাছি খেলা ছাড়া আর কিছু না। তবে, সোশ্যাল মিডিয়া জায়ান্টরা কীভাবে কমিউনিটি গাইডলাইন ও ঝুঁকি মূল্যায়ন করে সেগুলো বোঝার জন্য সূক্ষ্ম বিষয়গুলো সম্পর্কে জানা প্রয়োজন।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আফগানিস্তানের সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনাগুলো বাংলাদেশের রাজনীতি ও নিরাপত্তা পরিমণ্ডলকে ঠিক ততটাই প্রভাবিত করেছে, যতটা করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোকে। নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সংস্কৃতি, প্রথা, রাজনীতিতে নীতিগত পার্থক্য করেছে। তবে, একটি বিষয় যেটি সব সময় একই, সার্বজনিন। সেটা হলো কোনো ঘটনার প্রতি আমাদের প্রতিক্রিয়া।

অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও এসব বিষয়ে সর্তক, ঘটনার অগ্রগতি সম্পর্কে মনোযোগী এবং জনগণের জন্য সমন্বিত, স্বচ্ছ ও উন্মুক্ত সরকার ব্যবস্থা আশা করে। আমরা এটা জানি, কারণ সরকারগুলো মনোলিথিক প্রতিষ্ঠান, কোনো নীতিমালা ঘোষণার আগে মন্ত্রিসভায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে পারে। যেটি নীতিমালার একক উৎস হিসেবে কাজ করে, যাকে আমরা নিয়ম বা আইন বলতে পারি।

এর বিপরীতে, সমাজের সর্বস্তরের বিভিন্ন মানুষের অসংখ্য মতামত তুলে ধরার দায়িত্ব রয়েছে সমাজিক যোগাযোগমাধ্যমের।

গতিশীল বিশ্বের ঘটনাগুলো প্রতিনিয়ত মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে প্রভাবিত করে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোকে একটি মধ্যম পন্থা খুঁজতে চাপ দেওয়া হয়। যার উদ্দেশ্য খুব সহজ: ব্যবহারকারীদের ভুল তথ্য, বিদ্বেষমূলক বক্তব্য এবং যেকোনো ঘটনা থেকে শুধু বিশ্বকেই নয়, কোম্পানিগুলোর সুনামকেও নেতিবাচকভাবে প্রভাব থেকে রক্ষা করা। তারা মতামত নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, কিন্তু বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর প্রতিক্রিয়া জানতে পারে এবং নিরাপদ অনলাইন আচরণের রূপরেখা নির্ধারণের জন্য সেগুলোর প্রভাবকে 'মানসম্মত' করতে পারে। 

২০২০ সালের অক্টোবরে, স্যামুয়েল প্যাটি নামে ফ্যান্সের একজন স্কুল শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে হজরত মোহাম্মদ (স.)-এর ক্যারিকেচার প্রদর্শন করলে ইসলামপন্থীরা তাকে হত্যা করে। এই ঘটনার প্রাথমিক আঘাত ও আতঙ্ক কাটিয়ে ওঠার পর ফ্রান্সের, বিশেষ করে ইউরোপের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে অতি রক্ষণশীল সমালোচনার আধিপত্য দেখা যায় এবং মুসলিম শরণার্থী গ্রহণের বিষয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সিদ্ধান্তের প্রতি প্রতিনিয়ত বিদ্বেষমূলক বক্তব্য দেখা যায়।

তখন সোস্যাল মিডিয়া জায়ান্টদের লক্ষ্য ছিল কনটেন্টগুলো পর্যবেক্ষণ করা। যাতে অনলাইনের উত্তেজনার কারণে প্যারিসের রাস্তায়ও সহিংসতা ছড়িয়ে না পড়ে। এর পরপরই, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ এক বক্তৃতায় স্যামুয়েল প্যাটিকে বাক স্বাধীনতার পক্ষে 'কোয়ায়েট হিরো' হিসেবে অভিহিত করেন।

এই ঘটনার কিছুদিনের মধ্যেই, পাকিস্তানের রাস্তায় ফ্রান্সবিরোধী বিক্ষোভের আহ্বান জানিয়ে ফেটে পড়ে সে দেশের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। তারা সরকারের কাছে ফরাসি দূতকে বহিষ্কারের দাবি জানায়। সে সময় সোশ্যাল মিডিয়া জায়ান্টদের উদ্দেশ্য ছিল, অনলাইনের উত্তাপ যেন অফলাইনে সহিংসতায় রূপ না নেয়, সেটা বন্ধ করা।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর উদ্দেশ্য ছিল অফলাইনে সংঘাতের ঝুঁকি কমানো। যেটি খুব বাজেভাবে সামাজিক নীতিগুলোর সঙ্গে প্রতিফলিত হয়। যেখানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যেমন, ফেসবুক এসব ঘটনার প্রতিক্রিয়ার সামগ্রিকতায় সৃষ্ট ক্ষতি কমাতে ব্যাপভাবে বিনিয়োগ করে। যদিও ক্ষতির ধরন বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন রকম হয়। তবে, এই ধরনের ক্ষতির গুরুত্ব একই থাকে। এ ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কোম্পানিগুলোর যুক্তি হচ্ছে, তাদের ঝুঁকি বিশ্লেষণের একটি বড় অংশ যতটা সম্ভব এসব ঘটনার প্রভাব হ্রাসের সঙ্গে সম্পর্কিত।

এসব মিডিয়া জায়ান্টরা বছরের পর বছর ধরে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে তাদের কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ডগুলোকে সংশোধন করেছে। এই কারণেই, বিভিন্ন দেশের সরকার যখন সোশ্যাল মিডিয়া জায়ান্টদের কাছে অনুরোধ জানায়, তখন তারা সাড়া দেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের কমিউনিটি পলিসির ওপর নির্ভর করা।

কমিউনিটি পলিসিগুলো কি যথেষ্ট? দক্ষিণ এশিয়া, ল্যাটিন আমেরিকা ও আফ্রিকার ক্রম বিকাশমান বাজারে কমিউনিটি পলিসির প্রতিরক্ষা দেয়ালগুলো প্রতিনিয়ত পরিবর্তীত হচ্ছে। সেগুলো বলতে চাচ্ছে, নির্দিষ্ট নীতিমালাগুলো ওই অঞ্চলে বিদ্যমান পারস্পরিক সম্পর্কিত সমস্যাগুলোকে যথাযথভাবে প্রতিনিধিত্ব করে না।

ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত ও ক্রমাগত পরিবর্তনশীল এই বিশ্ব প্রতিনিয়ত নতুন সব হুমকির মুখে পড়ছে। এটা নিশ্চিত যে কমিউনিটি পলিসিগুলোর প্রতিনিয়ত সংস্কার প্রয়োজন, যাতে বিশ্বের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব থাকে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর অঞ্চলভিত্তিক প্রতিটি বাজারের জন্য কমিউনিটি পলিসি এবং অপারেশন টিম আছে এমনটা আশা করা বোকামি হবে। তবে, মানসম্মত কমিউনিটি গাইডলাইন সুবিধাগুলো সম্পূর্ণরূপে উপলব্ধি করতে, নিত্য-নতুন তৈরি হওয়া বিপদগুলোকে আরও কাছাকাছি থেকে, আরও স্থানীয়ভাবে মনোনিবেশ করে কমানো দরকার।

Comments

The Daily Star  | English

Fire breaks out at tissue warehouse in Narayanganj

Upon receiving the information, 19 firefighting units from various stations rushed to the scene and are currently working to bring the blaze under control

15m ago