আসুন, আত্মহত্যা প্রতিরোধে কাজ করি

একমাত্র বাসযোগ্য ও ছায়া সুনিবিড় এই পৃথিবী থেকে মানুষের বিয়োগাত্মক পরিণতি বিভিন্ন কারণে হয়ে থাকে। তার মধ্যে অন্যতম অনাকাঙ্ক্ষিত কারণ আত্মহত্যা। যার সঙ্গে একান্তভাবে জড়িত আমাদের চারপাশের পরিবেশ এবং ব্যক্তির আবেগ বা মন। বিভিন্ন অভিজ্ঞতা আর তা থেকে জন্ম নেয়া তীব্র কষ্ট, হতাশাসহ অন্যান্য নেতিবাচক বিষয়ের সম্মিলিত ও চূড়ান্ত পরিণতি আত্মহত্যা।

কেন গুরুত্বপূর্ণ

আত্মহত্যায় প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন মানুষ পৃথিবী থেকে বিদায় নিচ্ছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর বিশ্বে আত্মহত্যা করছেন ৭ লাখেরও বেশি মানুষ। করোনাকালীন সময়ে এক বছরে বাংলাদেশে আত্মহত্যায় মৃত্যু হয়েছে ১৪ হাজারেরও বেশি মানুষের। ডব্লিউএইচও'র তথ্যমতে, বিশ্বে মোট আত্মহত্যার ৭৭ শতাংশ ঘটছে স্বল্প ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে। তাদের মধ্যে আছে সব বয়স ও শ্রেণি-পেশার মানুষ। যাদের মধ্যে তরুণের সংখ্যাই বেশি।

বিশ্বজুড়ে ১৫-২৯ বছর বয়সীদের চতুর্থ সর্বোচ্চ মৃত্যুর কারণ আত্মহত্যা। ২০০০ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত এক দশকের পরিসংখ্যানে আত্মহত্যায় মৃত্যুর হার কমছে, এই তথ্য উঠে এসেছে। এতে দেখা গেছে, সারাবিশ্বে আত্মহত্যায় মৃত্যুর হার কমলেও আমেরিকা অঞ্চলে তা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। এসডিজি বা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বে আত্মহত্যার হার এক তৃতীয়াংশ কমিয়ে আনতে হবে।

আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস

প্রতি বছর ১০ সেপ্টেম্বর পালিত হয় বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য 'কাজের মাঝে জাগাই আশা'। প্রশ্ন হলো- আত্মহত্যা প্রতিরোধ করা যায় কিনা? হ্যাঁ, আত্মহত্যা প্রতিরোধ করা সম্ভব। তার জন্য সময়মত বাস্তবসম্মত ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। এরিমধ্যে জাতীয় আত্মহত্যা প্রতিরোধ কৌশল নিয়েছে বিশ্বের ৩৮টি দেশ। বেশ কিছু দেশ নিজেদের স্বাস্থ্যখাতে এ বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারে অন্তর্ভুক্ত করেছে।

আত্মহত্যাপ্রবণ হওয়ার ঝুঁকিগুলো

যেসব কারণে মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়, এর অন্যতম হচ্ছে বুলিং। চরম হতাশা ও অসহায় বোধ থেকে কিশোর-কিশোরীরা এই পথে পা বাড়ায়। মাদকাসক্তের মতো সমাজবিরোধী আচরণও আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ায়। বাংলাদেশে যেসব পারিবারিক, সামাজিক ও আর্থিক কারণে আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা যায়, সেগুলো হলো- সাইবার ক্রাইমের শিকার, যৌতুক প্রথা, বাবা-মায়ের মধ্যে সুসম্পর্ক না থাকা, পারিবারিক কলহ, পরকীয়া, প্রেমে ব্যর্থতা, চাকরি হারানো, দীর্ঘদিনের বেকারত্ব, দরিদ্রতা, প্রতারণার শিকার, ব্যবসায় বড় ধরনের ক্ষতি, প্রিয়জনের মৃত্যু, পরীক্ষায় আশানুরূপ ফল না পাওয়া, সন্তানের প্রতি বাবা-মায়ের তাচ্ছিল্য, মূল্যবোধের অবক্ষয়, পারিবারিক, ধর্মীয় ও সামাজিক দায়িত্ববোধের অভাব, যৌন সহিংসতা এবং নির্যাতনের শিকার হওয়া ইত্যাদি।

এ ছাড়াও, আত্মহত্যা প্রবণতার অন্যতম কারণ বিষণ্ণতা, ইনসমনিয়া ও সিজোফ্রেনিয়ার মতো মানসিক অসুস্থতা। বঞ্চনা, ক্ষোভ, একাকীত্ব, সামাজিক বিচ্ছিন্নতাও আত্মহত্যার ঝুঁকি বাড়ায়। বর্তমানে সাইবার বুলিংয়ের কারণে আত্মহত্যা সংশ্লিষ্ট আচরণ ক্রমেই বাড়ছে।

আত্মহত্যা নিয়ে আমাদের সমাজে কিছু স্টিগমা আছে। যেমন: আত্মহত্যা প্রবণতাকে ব্যক্তির গুরুতর সমস্যা হিসেবে আমরা মেনে নিই না। ফলে এই সমস্যা থেকে বাঁচতে ব্যক্তি নিজে অন্যের সাহায্য চাইতে আগ্রহ দেখায় না। আবার অন্যরাও আত্মহত্যাপ্রবণ ব্যক্তিকে সাহায্য করার বিষয়ে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখেন না।

আত্মহত্যার পূর্বাভাস জানুন

দ্রুত পরিবর্তনশীল এ সামাজিক পরিস্থিতিতে অনেকেই আত্মহত্যা করতে পারেন। কিশোর-কিশোরী ও তরুণ-তরুণীদের মধ্যে এর ঝুঁকি বেশি। প্রাণঘাতী এ সমস্যা থেকে তাদের উদ্ধারে সমাজের যে কেউ হতে পারেন একজন সক্রিয় কর্মী। এজন্য আত্মহত্যার আর্লি ওয়ার্নিং সাইন বা পূর্বাভাস সম্পর্কে সবার ধারণা থাকা প্রয়োজন।

আত্মহত্যার আর্লি ওয়ার্নিং সাইন হলো, বার বার মরে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করা, নিজেকে আঘাত করা, হঠাৎ করে ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন, ঘুম না হওয়া, খাওয়া-দাওয়ায় অনীহা, চরম হতাশা, পাপবোধ, চরম লজ্জিত ও অপদস্থবোধ ইত্যাদি। এ ছাড়াও, মৃত্যু সংক্রান্ত গান, চিত্রাঙ্কন ও লেখায় তার আগ্রহ বেড়ে যেতে পারে। নিজের প্রিয় জিনিসপত্র অন্যকে বিলিয়ে দেওয়া, হঠাৎ করেই সবার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা, এ সবই আত্মহত্যা প্রবণতার লক্ষণ। যারা আত্মহত্যার কথা চিন্তা করেন, তাদের কথা-বার্তায় সরাসরি মৃত্যুর কথা প্রকাশ পায়।

এ ছাড়াও, কিছু শারীরিক ও আচরণগত পরিবর্তন দেখা যায়। যেমন: দ্রুত ওজন বেড়ে যাওয়া, নিজের যত্ন নেওয়া ছেড়ে দেওয়া, শরীরের বিভিন্ন জায়গায় দাগ, কাটা, ঘা বা ইনজেকশনের সূচের দাগ।

প্রতিরোধের উপায়

যদি কখনো মনে হয় যে, আপনার পাশের মানুষটি এ ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারে, তবে দেরি না করে তার কাছে সরাসরি এ বিষয়ে জানতে চান। এক মুহূর্ত দেরি না করে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রথমেই তার কাছে সরাসরি জানতে হবে, সে আত্মহত্যার কথা ভাবছে কিনা, সে কতখানি ঝুঁকিতে আছে, নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পরখ করতে হবে। আপনি নিজে যদি এ বিষয়ে জানতে আত্মবিশ্বাসী বা অভিজ্ঞ না হয়ে থাকেন, তবে দ্রুত এমন কাউকে খুঁজে বের করতে হবে, যিনি এ বিষয়ে জানেন।

আত্মহত্যা এমন একটি জনস্বাস্থ্য সমস্যা, যা প্রতিরোধযোগ্য। একে মোকাবিলা করতে প্রয়োজন সমন্বিত পদক্ষেপ। আত্মহত্যা প্রতিরোধের ৪টি প্রমাণিত ও কার্যকর ইন্টারভেনশনের সুপারিশ আছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার। এগুলো হলো-

* আত্মহত্যার সরঞ্জাম হাতের কাছে সহজলভ্য না রাখা (যেমন: কীটনাশক, আগ্নেয়াস্ত্র, নির্দিষ্ট কিছু ওষুধ ইত্যাদি)।

* আত্মহত্যা নিয়ে দায়িত্বশীল প্রতিবেদন প্রচারে গণমাধ্যমকে যুক্ত করে প্রশিক্ষণ প্রদান।

* কিশোর-কিশোরীদের সামাজিক ও আবেগীয় জীবন দক্ষতায় পারদর্শী করা।

* আত্মঘাতী আচরণ দ্রুত শনাক্ত করা, যাচাই করা, ব্যবস্থা নেওয়া এবং ফলোআপ করা।

মনে রাখতে হবে, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা দ্রুত নিলে আত্মহত্যা প্রতিরোধ করা সম্ভব। কেউ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকলে আমরা যে কয়টি পদক্ষেপ নেব, তা হলো, অন্য কাউকে জানানো, পরিবারের কেউ হলে ভালো হয়, দ্রুত বিশেষজ্ঞের সাহায্য নেওয়া, আত্মহত্যা প্রবণ ব্যক্তি যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো সাহায্যের আওতায় না আসছে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে একা না ছাড়া ইত্যাদি।

আত্মহত্যার চিন্তা মাথায় এলে তা লুকিয়ে রাখবেন না। বন্ধু বা বিশ্বস্ত কোনো ব্যক্তির সঙ্গে তা শেয়ার করুন। নিজের ওয়ার্নিং সাইনগুলো চিনুন। ওয়ার্নিং সাইনগুলো দেখামাত্র বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। এ ছাড়া, আত্মহত্যার চিন্তা থেকে দূরে রাখে এমন কাজে দ্রুত সম্পৃক্ত হোন, সামাজিক সম্পর্কগুলো বাড়ান এবং মানসিক সহায়তা দিতে পারবে এমন কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখুন, ক্ষতিকর ও বিষাক্ত দ্রব্য যা দিয়ে আপনি আত্মহত্যার চেষ্টা করতে পারেন, তা আশপাশ থেকে সরিয়ে ফেলুন, নিজ দায়িত্বে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। যেমন: ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, প্র্যাকটিসিং সাইকোলজিস্ট, সাইকিয়াট্রিস্ট অথবা সাইকোথেরাপিস্ট। এ ছাড়াও, জরুরি সেবা পেতে হটলাইন সেবায় যোগাযোগ করুন। যেমন: ৯৯৯ অথবা ১৬২৬৩ নম্বরে।

নাঈমা জান্নাত: ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট

nznurany@yahoo.com

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Matarbari project director sold numerous project supplies

Planning Adviser Prof Wahiduddin Mahmud today said the Matarbari project director had sold numerous project supplies before fleeing following the ouster of the Awami League government on August 5.

1y ago