ইরাকে বন্দি ছেলেকে বাঁচাতে মরিয়া পিতা

বাদল মিয়া রাজধানীর কারওয়ান বাজারের ফুটপাথে বসে মাছ বিক্রি করছিলেন গত ৩ আগস্ট সকাল ৯টায়। হঠাৎ তিনি ইমো মেসেজিং অ্যাপে একটি ভিডিও বার্তা পেলেন।

ভিডিও বার্তা খুলে তিনি দেখতে পেলেন, তার ইরাকপ্রবাসী ২২ বছর বয়সী ছেলে আবদুল্লাহ হক রাব্বী শেকল দিয়ে হাত ও পা বাঁধা অবস্থায় মাটিতে পড়ে আছেন। তাকে দেখে খুব দুর্বল মনে হচ্ছিল। তিনি পানির জন্য আকুতি জানাচ্ছিলেন।

এর কয়েক মুহূর্ত পর ইমোতে একটি ভিডিও কল পেলেন বাদল মিয়া। অজ্ঞাত তরুণ সেই কলে তাকে জানালেন, তারা তার ছেলেকে অপহরণ করেছেন এবং ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিতে হবে ছেলেকে ছাড়িয়ে নিতে। টাকা না পেলে রাব্বীকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারার হুমকি দেওয়া হয়।

বাদল অপহরণকারীদের জানান, তার কাছে এত টাকা নেই। তিনি খুব বেশি হলে পাঁচ লাখ টাকার মতো জোগাড় করতে পারবেন। অপহরণকারীরা এতে রাজি হয়।

কয়েক মিনিট পরই অপহরণকারীরা বাদলকে রাজধানীর খিলগাঁওয়ের একটি বেসরকারি ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট নম্বর দেয়। সেখানে শিগগির টাকা জমা দিতে বলা হয়।

ভিডিও কলটি পাওয়ার দুদিনের মাথায় গত ৫ আগস্ট ওই অ্যাকাউন্টে টাকা জমা দেন বাদল। আত্মীয় স্বজনের কাছ থেকে ধার করে এবং জমি বিক্রি করে টাকার ব্যবস্থা করেন তিনি।

তবে এখনও পাওয়া যায়নি রাব্বীর কোনো হদিশ।

সম্প্রতি হাতিরঝিল থানায় এ বিষয়ে একটি মামলা দায়ের করেছেন বাদল।

দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে গত মঙ্গলবার তিনি জানান, রাব্বী তার তিন সন্তানের মধ্যে বড়। রাব্বী বৈধভাবে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে ইরাকে যান এবং সেখানে কুর্দিস্থানের একটি রেস্তোরাঁয় কর্মরত ছিলেন।

মহামারির মধ্যে রেস্তোরাঁটি বন্ধ হয়ে যায় এবং রাব্বীসহ আরও অনেকে কর্মহীন হয়ে পড়েন।

মামলার নথিতে বাদল উল্লেখ করেন, 'এ বছরের ২৫ জুলাই ইরাকে রাব্বীর সঙ্গে তিন যুবকের দেখা হয়, যাদের একজনের নাম শিহাব। তারা আমার ছেলেকে ইউরোপে আকর্ষণীয় চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেখায়। আমার ছেলে জানায়, সে ইউরোপে যদি চাকরি পেয়ে যায় তাহলে আমার কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা নেবে।'

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপ পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. শহিদুল্লাহ দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, তারা আট সদস্যের একটি আন্তর্জাতিক মানব পাচারকারী দলের সঙ্গে এই ঘটনার সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছেন।

তিনি আরও জানান, দলের চার জন ইরাকে অবস্থান করছেন। তারা হলেন ফরিদপুরের জহুরুল ইসলাম (৩০), হাবিব ফকির (২২), জিয়াউর রহমান (২৫) এবং সুনামগঞ্জের শিহাব উদ্দিন (২৩)।

ডিসি শহিদুল্লাহ বলেন, 'আমরা মামলাটি তদন্ত করছি। অভিযুক্ত আসামিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া ও অপহরণের শিকার ব্যক্তিকে উদ্ধারের জন্য পুলিশের সদর দপ্তরে ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরোর (এনসিবি) সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করেছি।'

মুক্তিপণের টাকার যাত্রা

মুক্তিপণের টাকার বিষয়ে তদন্তকারীরা জানান, জহুরুল ফোনে রনি নামের এক তরুণের সঙ্গে কথা বলেন এবং তাকে একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বর দিতে বলেন। রনি ও জহুরুল ফরিদপুরের একই গ্রামের বাসিন্দা।

রনি জহুরুলকে তার ভাবী শাহনাজ বেগমের অ্যাকাউন্টের তথ্য দেন। এই অ্যাকাউন্টেই মুক্তিপণের টাকা পাঠান বাদল।

রাব্বীর ওপর নির্যাতন চালান শিহাব এবং বাদলের কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা দাবি করেন।

রাজারবাগের প্রশান্তি হাসপাতালে নার্স হিসেবে কর্মরত শাহনাজ গত ৯ আগস্ট ব্যাংকে যান এবং ফরিদপুরের আরেকটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পাঁচ লাখ টাকা স্থানান্তর করেন। তদন্তকারী কর্মকর্তারা খিলগাঁওয়ের ব্যাংকটির সিসিটিভি ফুটেজ ও ব্যাংক কর্মকর্তাদের বরাতে এই তথ্য জানান।

পরের দিন রনি ফরিদপুরের ব্যাংকে গিয়ে আরেকটি বেসরকারি ব্যাংকে জহুরুলের অ্যাকাউন্টে দুই লাখ ৬০ হাজার টাকা পাঠান। রনি বাকি দুই লাখ ৪০ হাজার টাকা উঠিয়ে নেন।

এরপর রনি তার চাচাতো ভাই মুরাদ ফকিরের (২৪) অ্যাকাউন্টে এক লাখ টাকা পাঠান। জহুরুলের স্ত্রী আতিয়া সুলতানা নিপাকে ৯০ হাজার টাকা দেন মুরাদ। তদন্তকারীরা জানান, মুরাদ ইরাক থেকে এক মাস আগে বাংলাদেশে এসেছেন।

তদন্তকারীরা আরও জানান, রনি প্রবাসী জিয়াউর রহমানের বাবা লাল মিয়াকে এক লাখ টাকা এবং হাবিবের বাবা ইউনুস ফকিরকে ৩০ হাজার টাকা দেন। রনি মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে শাহনাজকে তিন হাজার টাকা পাঠান এবং নিজের কাছে সাত হাজার রেখে দেন।

জহুরুলের অ্যাকাউন্টে পাঠানো দুই লাখ ৬০ হাজার টাকার মধ্যে দুই লাখ ছয় হাজার টাকা সিলেটের হবিগঞ্জে এ এইচ রুবেলের নামে থাকা একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন তদন্তকারীরা।

তেজগাঁও পুলিশ বিভাগের অতিরিক্ত উপ পুলিশ কমিশনার (এডিসি) হাফিজ আল ফারুক দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, তারা ঘটনার সঙ্গে জড়িত রনি ও শাহনাজকে গ্রেপ্তার করেছেন এবং নিপা ও মুরাদকে খুঁজছেন।

তিনি বলেন, 'গ্রেপ্তারকৃতরা আমাদেরকে মানব পাচারকারী দলটি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। তারা আগেও একই ধরণের অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আমরা এখন তথ্য যাচাই করছি এবং ঘটনার সঙ্গে জড়িত সবাইকে গ্রেপ্তার করবো।'

 

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English

$14b a year lost to capital flight during AL years

Bangladesh has lost around $14 billion a year on average to capital flight during the Awami League’s 15-year tenure, according to the draft report of the committee preparing a white paper on the economy.

14h ago