কমছে তহবিল, বাড়ছে চ্যালেঞ্জ
রোহিঙ্গাদের জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা তহবিল কমে আসায় এবং শিগগির তাদের নিজ দেশে প্রত্যাবর্তনের তেমন কোনো সম্ভাবনা তৈরি না হওয়ায় এই বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠীর দেখভাল করতে বড় আকারের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি বাংলাদেশ।
২০১৭ সালের পরের তিন বছরে প্রয়োজনীয় তহবিলের ৭২ থেকে ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত মানবিক সহায়তা থেকে এসেছে। কিন্তু ২০২০ সালে এসে এর পরিমাণ কমে ৬৫ শতাংশে নেমেছে।
এ বছরের জুলাই মাস পর্যন্ত ৩৬৬ মিলিয়ন ডলার সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে কিংবা বিতরণ করা হয়েছে। যা মোট চাহিদা এক বিলিয়ন ডলারের মাত্র ৩৪ শতাংশ।
বৈশ্বিক মহামারির পরে তালেবানদের আফগানিস্তান দখলের কারণে আরেকটি সংকটের উদ্ভব হয়েছে। ইতোমধ্যে লাখো আফগান দেশের ভেতরে ও বাইরে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) অভিবাসন ও মানবিক নীতিমালা সংক্রান্ত সিনিয়র উপদেষ্টা মো. শহীদুল হক বলেন, 'আগামী দিনগুলোতে আফগানিস্তান ও অন্যান্য সংকটের কারণে রোহিঙ্গাদের জন্য তহবিলের পরিমাণ নিশ্চিতভাবেই কমে যাবে।'
তহবিল স্বল্পতার আশংকায় বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘের প্রতি বেশ কিছুদিন ধরে আহ্বান জানাচ্ছে ভাসানচরে তাদের কার্যক্রম শুরু করতে। ভাসানচরে সরকার গত ডিসেম্বরে ১৮ হাজার রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে। এই উদ্যোগের মাধ্যমে কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলো থেকে এক লাখ রোহিঙ্গা সেখানে স্থানান্তর করার পরিকল্পনার রয়েছে।
মূলত স্থানীয় এনজিওগুলো তাদের নিজস্ব তহবিল ব্যবহার করে ভাসানচরে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা দিচ্ছে। এনজিও কর্মকর্তারা জানান, মূল আন্তর্জাতিক দাতারা তহবিল না দিলে তাদের কার্যক্রম খুব বেশি দিন চালু রাখা সম্ভব হবে না।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোহসীন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ রাখার নীতিমালাটি প্রায় চূড়ান্ত করে ফেলেছি এবং খুব সম্ভবত সেপ্টেম্বর থেকে জাতিসংঘ সেখানে তাদের কার্যক্রম শুরু করবে।'
কক্সবাজারে মানবিক ত্রাণ কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করা কর্মকর্তারা জানান, টেকনাফ ও উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এখন প্রায় ১০ লাখ শরণার্থী বসবাস করছেন। মিয়ানমার সেনাদের নির্মম অত্যাচার থেকে বাঁচতে ২০১৭ সালে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা এখন আগের তুলনায় অনেক উন্নতমানের রেশন, আবাসন, রাস্তাঘাট, পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন সুবিধা পাচ্ছেন।
তবে নতুন কিছু চ্যালেঞ্জের আবির্ভাব ঘটেছে। এর মধ্যে রয়েছে ক্যাম্পের ভেতরে রোহিঙ্গা অপরাধী দলের চাঁদাবাজি, বিভিন্ন রোহিঙ্গা দলের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই এবং শিক্ষা ও চাকরির অভাব।
ক্যাম্প থেকে বের পালিয়ে মালয়েশিয়া বা ইন্দোনেশিয়া অভিমুখে রোহিঙ্গাদের ঝুঁকিপূর্ণ নৌযাত্রার প্রবণতাও সম্প্রতি বেড়েছে।
পুলিশ জানিয়েছে, গত দুবছরে ১১টি জেলা থেকে পাচার হতে যাওয়া প্রায় এক হাজার ৩০০ রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করা হয়েছে।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত বছর অন্তত দুই হাজার ৪১৩ জন রোহিঙ্গা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দুটি দেশে নৌপথে যাত্রা করার চেষ্টা চালায়। তাদের মধ্যে ২১৮ জন মারা গেছেন বা নিখোঁজ রয়েছেন। এই পরিসংখ্যানের কারণে ২০১৫ সালের পর চলতি বছর বঙ্গোপসাগর ও আন্দামান সাগরে শরণার্থীদের যাত্রার প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে মারাত্মক বছর হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
কোস্ট ট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, 'সব কিছু দেখে মনে হচ্ছে, রোহিঙ্গা সংকটটি দীর্ঘায়িত হতে যাচ্ছে। এতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে বড় আকারের হতাশা দেখা দিয়েছে। তাদের অনেকেই অপরাধমূলক কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়ছেন এবং ক্যাম্প ছেড়ে চলে যাচ্ছেন।'
কোস্ট ট্রাস্ট বহু বছর ধরে বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
মহামারি আঘাত হানার পর থেকে ক্যাম্পগুলোতে মানবিক সেবার কলেবর উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমিয়ে আনা হয়েছে। বেশিরভাগ রোহিঙ্গা তরুণ-তরুণীর ক্যাম্পে কিছুই করার নেই এবং মহামারির কারণে আগে যেসব শিশু স্কুলে যেত, তারাও এখন আর যেতে পারছে না বলে জানান তিনি।
রেজাউল করিম আরও জানান, অনেক শিশু ধর্মীয় শিক্ষাকেন্দ্রগুলোতে যায় এবং কারা এগুলোর তহবিল দিচ্ছে এবং তাদেরকে প্রকৃতপক্ষে সেখানে কী শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে, সে বিষয়ে কোনো ধরণের তদারকি নেই।
তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'চাঁদাবাজি, পারিবারিক সহিংসতা, অসামাজিক কার্যক্রম, অবৈধ মাদক ব্যবসা ও বিভিন্ন অপরাধী দলের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনাগুলো অনেকাংশে বেড়ে গেছে।'
উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিত করিম জানান, রোহিঙ্গাদের দুর্বলতার সুযোগ নেওয়া জঙ্গি সংগঠনগুলোর জন্য খুবই সহজ হবে। তিনি বলেন, 'ক্যাম্পগুলোতে রাতের অন্ধকারে কী হয়, সে ব্যাপারে আমরা প্রকৃতপক্ষে কিছুই জানি না।'
নীতিনির্ধারকদের উচিৎ প্রত্যাবাসন কার্যক্রম শেষ না হওয়া পর্যন্ত এ ধরণের ঝুঁকিগুলো দূর করার জন্য উদ্যোগ নেওয়া। ঝুঁকির উৎসগুলোকে অবজ্ঞা করলে বাস্তুচ্যুত মানুষগুলোর প্রতি এতটা মানবিক আচরণ করার পরেও তা বাংলাদেশের জন্য বুমেরাং হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে আশংকা প্রকাশ করেন তিনি।
হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির প্রধান উপদেষ্টা নুর খান লিটনও একই ধরণের মতামত প্রকাশ করেছেন।
তারা দুজনেই জানান, রোহিঙ্গাদের যথাযথ শিক্ষার ব্যবস্থা করা ও তাদের আয়ের ব্যবস্থা করা অত্যন্ত জরুরি। সেই সঙ্গে জঙ্গি দলগুলোকে প্রতিহত করার জন্য কর্তৃপক্ষকে কঠোরভাবে দিনে ও রাতে ক্যাম্পগুলোর ওপর নজর রাখতে হবে।
'এই মুহূর্তে এনজিও ও জাতিসংঘের প্রকল্পগুলোতে অল্প সংখ্যক রোহিঙ্গা নারী ও পুরুষ কর্মরত আছেন। কিন্তু এই জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগ সদস্যই কর্মহীন', বলেন লিটন।
তিনি পরামর্শ দেন, সরকারের উচিৎ রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পের ভেতরে উপার্জন করার ব্যবস্থা করে দেওয়া। যাতে তারা অপরাধমূলক কার্যক্রম ও জঙ্গি কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকে এবং বিদেশি ত্রাণের ওপর নির্ভরতা কমে আসে।
করিম মন্তব্য করেন, সরকারের উচিৎ সব ক্যাম্পে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং এনজিও কর্মীদের রাতে ক্যাম্পে অবস্থান করার অনুমতি দেওয়া। যাতে সুবিধাবাদী মহলগুলো কোনো অবাঞ্ছিত ঘটনা না ঘটাতে পারে।
তিনি জানান, যেহেতু রোহিঙ্গাদের জন্য তহবিলের পরিমাণ কমে আসছে, জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার উচিৎ বিভিন্ন বাড়তি খরচ কমিয়ে এনে তহবিলের উপযুক্ত ব্যবহারের দিকে মনোযোগ দেওয়া। এক্ষেত্রে বিদেশি কর্মী কমিয়ে স্থানীয় এনজিওগুলোকে পরিচালনার কাজে নিয়োগ দিলে বিষয়টি কার্যকারিতা পাবে।
উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানবাধিকার কর্মীরা জানান, রোহিঙ্গাদের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট ও বড় আকারের তহবিলের প্রয়োজন। যা নিজ বাজেট থেকে প্রতি বছর জোগান দেওয়া সরকারের জন্য খুবই ঝামেলার একটি কাজ হবে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের অর্থনীতি রোহিঙ্গাদের সহায়তা দেওয়ার জন্য প্রতি বছর এক দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলার খরচের বোঝা টানছে।
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়ান ইন্সটিটিউট অব পলিসি অ্যান্ড গভর্নেন্সের (এসআইপিজি) সিনিয়র ফেলো মো. শহীদুল হক জানান, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ বড় আকারের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছে।
তিনি বলেন, 'বিশ্বের উচিৎ হবে না এই বোঝা একক ভাবে বাংলাদেশের ওপর ছেড়ে দেওয়া। বাংলাদেশকে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য চাপ তৈরি করার পাশাপাশি তহবিলের জন্য অন্যান্য দেশের সঙ্গে যৌথ প্রচারণায় অংশ নিতে হবে।'
ইমেইলের মাধ্যমে ইউএনএইচসিআরকে প্রশ্ন করা হলে তারা জানান, করোনাভাইরাস মহামারি শরণার্থী ও তাদের আশ্রয়দাতা উভয়ের জন্য দুর্বলতা বাড়িয়েছে।
সংস্থাটি জানায়, 'বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম হয়েও বাংলাদেশ মহানুভবতার সঙ্গে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কয়েক দশক ধরে আশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের এখন প্রয়োজন বলিষ্ঠ ও টেকসই আন্তর্জাতিক সহায়তা।'
প্রতিবেদনটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান।
Comments