পেরুতে বামপন্থী কাস্তিলিওর বিজয়
পেরুর রাষ্ট্রপতি হলেন একজন প্রাথমিক স্কুল শিক্ষক। দেশটির রাষ্ট্রপতি নির্বাচন গত ৬ জুন হলেও এর ফলাফল ঘোষণা হয়েছে গত ২৮ জুলাই। অর্থাৎ, নির্বাচনের ছয় সপ্তাহ পরে।
তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা পূর্ণ দ্বিতীয় দফার এই নির্বাচন নিয়ে ডানপন্থী প্রার্থী ফুজিমোরি কিকো কারচুপির অভিযোগ এনেছিলেন। এ কারণে ভোট গণনা ও ফলাফল ঘোষণায় কমিশন এই সময় নিয়েছে।
এই নির্বাচনে পেরুর বামপন্থী দলের প্রার্থী স্কুল শিক্ষক পেদ্রো কাস্তিলিও নির্বাচিত হয়েছেন। দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের কবল থেকে ২০০ বছর আগে দেশটি মুক্ত হয়। কাকতালীয়ভাবে নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তির ২০০ বছর উদযাপনের সময়ই নির্বাচিত হয়েছেন।
নির্বাচনী শপথে কাস্তিলিও তার প্রথম বক্তব্যে বলেন, পেরুর ঔপনিবেশিক শাসনের যে গভীর ক্ষত রয়েছে তাকে তিনি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে সারিয়ে তুলতে চান। পেরুর গ্রামের ও গরীব মানুষের ভোটেই তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন। এই প্রথম পেরু একজন কৃষক দ্বারা পরিচালিত হবে।
কাস্তিলিওই পেরুর ইতিহাসে প্রথম রাষ্ট্রপতি যার সঙ্গে জাতীয় পর্যায়ের উচ্চস্তরের কোনো আমলা, ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক ও সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না। তার এ বিজয় দেশের এলিটদের জন্য এক বড় ধাক্কা।
পেদ্রো কাস্তিলিও কে?
পেদ্রো কাস্তিলিও উত্তর পেরুর একটি গরীব কৃষক পরিবারের সন্তান। যেখানে উন্নতমানের সোনার খনি রয়েছে। নয় ভাই-বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। তার বাবা ছিলেন একজন কৃষক। লেখাপড়ার পাশাপাশি কাস্তিলিও তার বাবাকে কৃষি কাজে সাহায্য করতেন। ১৯৬৯ সালে জন্ম নেওয়া কাস্তিলিও ১৯৯৫ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন।
তার রাজনৈতিক জীবনের শুরু ২০০২ সালে। রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকে দীর্ঘসময় কাস্তিলিও ডানপন্থী দলের সদস্য ছিলেন। দুর্নীতির কারণে সেই দলের বিলুপ্তি হলে তিনি মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী সংগঠন 'পেরু লিবারে' যোগদান করেন। এ সময় তিনি ট্রেড ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং আন্দোলন গড়ে তোলেন।
কাস্তিলিও একবার মেয়র নির্বাচন করে পরাজিত হয়েছেন।
সার্বক্ষণিক ঐতিহ্যবাহী তালপাতার হ্যাট মাথায়, পায়ে স্যান্ডেল ও দলের নির্বাচনী প্রতীক পেনসিল নিয়ে নির্বাচনী প্রচার চালিয়েছেন তিনি।
কী ছিল তার নির্বাচনী স্লোগান ও কর্মসূচী?
কাস্তিলিও ও বামপন্থীদের প্রধান স্লোগান ছিল, 'সম্পদশালী দেশ পেরুতে কোনো গরীব থাকবে না'।
পেরু একটি প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর দেশ। তামা, রূপা, স্বর্ণ, পেট্রোলিয়াম, কাঠ, কয়লা, লোহা আকরিক, ফসফেট, পটাশ, প্রাকৃতিক গ্যাস, মাছ প্রভৃতি সম্পদ রয়েছে দেশটিতে।
করোনায় বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর একটি পেরু। এই বৈরী সময়ে দেশটির মানুষের দারিদ্রতা দূর করতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, শিল্পে উন্নতি ঘটাতে ও বৈষম্য কমাতে চায় নতুন সরকার। পেরুর খনি ও হাইড্রোকার্বন খাতকে জাতীয়করণ করা এবং একই সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগকেও উৎসাহিত করতে চান কাস্তিলিও।
প্রতি বছর এক লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। কারাগারে সাবেক স্বৈরশাসক ফুজিমোরি রচিত সংবিধানের সংশোধন ও অপরাধ রোধে পুনরায় মৃত্যুদণ্ডের প্রথা চালু করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন কাস্তিলিও। তিনি সমকামিতা, সমকামী বিয়ে ও গর্ভপাতের বিরোধী। তার নির্বাচনী কর্মসূচীতে বাম, উদার ও রক্ষণশীল ভাবনার সংমিশ্রণ লক্ষণীয়।
জয় সহজ ছিল না
নির্বাচনে কাস্তিলিওর প্রতিপক্ষ ছিলের দেশটির সাবেক রাষ্ট্রপতি জাপানি বংশোদ্ভূত ফুজিমোরর কন্যা কিকো। তাদের পরিবারের রয়েছে দীর্ঘ রাজনৈতিক ঐতিহ্য। দেশের শহুরে ধনিক শ্রেণী, দেশ-বিদেশের কর্পোরেট স্বার্থবাদী ও শাসকরা ছিল কাস্তিলিওর বিপক্ষে।
পেদ্রো কাস্তিলিও খুব অপরিচিত ও গ্রাম থেকে উঠে আসা একজন প্রার্থী ছিলেন। নির্বাচনের আগেও শহরের মানুষ তাকে চিনতেন না। তার ছিল না কোনো গ্ল্যামার, বাড়তি খ্যাতিও।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর এবং শপথ নেওয়ার আগে তিনি রাজধানী লিমাতে পরিবার নিয়ে আসেন। এ থেকে সহজেই বোধগম্য তিনি কতটা প্রান্তিক পর্যায় থেকে কেন্দ্রের শীর্ষ পর্যায়ের মূল মানুষে পরিণত হয়েছেন।
সরকার পরিচালনায় চ্যালেঞ্জ
খুব বেশি ভোটের ব্যবধানে তিনি নির্বাচিত হননি। দ্বিতীয় দফায় তিনি মাত্র ৫১ ভাগ ভোট বা ৪৪ হাজার ভোটের ব্যবধানে জিতেছেন। উচ্চকক্ষে তার দলের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। সেখানে প্রতিপক্ষ হিসেবে আছে জটিল, বিতর্কিত রাজনৈতিক শক্তি ও নেতৃত্ব।
নিজের রাজনীতিতে তিনি বাম ঘরনার সঙ্গে কিছুটা রক্ষণশীল নীতিও গ্রহণ করেছেন। পেরুর বাম রাজনীতিতে কিউবার বিপ্লবীদের প্রভাব রয়েছে। সে বিষয়ে মার্কিন, তার সহযোগী ও প্রতিপক্ষের তরফ থেকে থাকবে বাড়তি চাপ।
তামাসহ খনিজ উৎপাদনের বিভিন্ন খাতে উচ্চহারে করারোপের ভাবনাকে বিনিয়োগকারীরা সহজ ভাবে নেবেন না। এখানে দেশের অর্থনীতি সংকটের একটি বড় চ্যালেঞ্জ তার সামনে আছে। বিরোধী ও ব্যবসায়ীরা এই ইস্যুগুলো নিয়ে তার বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারণা চালাতে পারেন, অর্থনীতিকে অস্থিতিশীল করতে পারেন। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই তাকে শাসনকার্য পরিচালনা করতে হবে।
পেরুর বিজয়ে বাংলাদেশের বামপন্থীদের কী বার্তা?
যেকোনো দেশের নির্বাচনে বামপন্থীদের বিজয় আমাদের দেশের বামদের মধ্যে এক ধরণের উৎসাহের সৃষ্টি করে। সামাজিক মাধ্যমে তা দৃশ্যমান হয়। শুধু উদ্দীপনার বিষয় নয়, সেখান থেকে বামদের শেখারও আছে অনেক কিছু।
প্রথমত, যিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন তিনি প্রান্তিক পর্যায় থেকে উঠে আসা একজন অখ্যাত রাজনীতিবিদ।
দ্বিতীয়ত, ১৮ বছরের রাজনৈতিক জীবনের মাথায় ৫১ বছর বয়সে তিনি দেশটির রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন এবং দলকে ক্ষমতায় এনেছেন।
তৃতীয়ত, কৃষিকর্মের ঐতিহ্যবাহী হ্যাট মাথায় দিয়েই ও দলের প্রতীক পেনসিল নিয়ে তিনি সার্বক্ষণিক নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়েছেন।
চতুর্থত, 'সম্পদের দেশে কোনো গরীব থাকবে না' এই স্লোগানকে তিনি জনপ্রিয় করেছেন। গরীব ও গ্রামের মানুষের ভোট আদায় করেছেন।
পঞ্চমত, তিনিই পেরুর প্রথম নেতা যার সঙ্গে নির্বাচিত হওয়ার আগে দেশটির সামরিক-বেসামরিক আমলা, ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক এলিটদের কোনো সম্পর্ক ছিল না।
বাংলাদেশের বামপন্থী দলের অনেক নেতার শারীরিক নয়, শুধু রাজনীতির বয়সই ৫০ থেকে ৬০ বছর। এই সুদীর্ঘ সময়ে তাদের অর্জন কী? নেতৃত্বের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা ছাড়া তাদের কোনো অর্জন নেই। কোনো একটি দলের মূল নেতৃত্বও পাঁচ থেকে ছয় দশকে নিজ সামর্থ্যে জাতীয় সংসদের যাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি, দলকে ক্ষমতায় নেওয়া তো দূরে থাক। এ সময়ে দলগুলো হয় ভেঙেছে, না হয় ছোট হয়েছে। যদিও তারা ধারাবাহিকভাবে সমাজ-রাজনীতির নানা ইস্যুতে রুটিন কর্মসূচী পালন করেছে।
অবশ্যই প্রত্যেকেই তার নিজ নিজ দেশের অবস্থা-বাস্তবতা অনুযায়ী রাজনীতি করবেন। কাউকে অনুকরণ বা অনুসরণ করবেন না। কিন্তু অন্যদের সাফল্য ও অর্জন থেকে শিক্ষা নিতে কোনো বাধা নেই।
বাংলাদেশের বামপন্থীদের ক্ষমতা দখলের মডেল কী? নির্বাচন বা বিপ্লব? তার নকশা-পরিকল্পনা, রোডম্যাপ কোথায়? তার ফলোআপ কী?
তারা আজও ইতিহাস ও ঐতিহ্য নির্ভরতা ছাড়তে পারেনি। প্রত্যেকটি দল বয়োবৃদ্ধ গতিহীন নেতৃত্বে আটকে আছে। তারা কর্মীদের এবং জনগণকে স্বপ্ন দেখাতে ব্যর্থ। তারপরও তারা নেতৃত্বে আছেন, আমৃত্যু থাকবেন। তারা নিজেদের কোনো ব্যর্থতা দেখেন না, নতুনদের সামনে আনছেন না। নেতৃত্ব, কাঠামো ও কর্মসূচীতে কোনো পরিবর্তন নেই, পরীক্ষা-নিরীক্ষা নেই। এতে বামপন্থার অবস্থা, ভাবমূর্তি ও সম্ভাবনা যতটুকু ছিল সেটুকুও নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
লাতিন আমেরিকা ও মার্কিন রাজনীতিতে পরিবর্তনের হওয়া
লাতিন আমেরিকার রাজনীতি ও ক্ষমতা কাঠামোয় পরিবর্তনের ধারা অনেক আগের। কিন্তু সেই ঢেউ শুধু লাতিনের দেশগুলোতে আটকে থাকেনি। তা এসে খোদ আমেরিকাতেও পড়েছে। কমিউনিজম ও সমাজতন্ত্রের কথা উচ্চারিত হলে ভর্ৎসনা করার জমানা আর নেই। মার্কিন কংগ্রেসের বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী সদস্য কয়েক বছর ধরেই মার্কিন শাসকের সাম্রাজ্যবাদী নীতি, ধনীদের তোষণ, তাদের সম্পদের পাহাড়, শোষণ-বৈষম্য, কর্মসংস্থান, আয়-উপার্জন নিয়ে কথা বলছেন।
সর্বশেষ মার্কিন নির্বাচনের মনোনয়ন দৌড়ে বামপন্থী বার্নি স্যান্ডার্স অন্যদের ঘাম ছুটিয়েছেন। তিনি এক কোটির ওপরে ভোট পেয়েছেন। সে সময়ের এক জরিপে দেখা গেছে মার্কিন জনগণের মধ্যে বামপন্থার ঝোঁক বাড়ছে। এক্ষেত্রে বার্নিই প্রথম রাজনৈতিক নয়, তার কৃতিত্ব হলো তিনি এই রাজনৈতিক ভাবনাকে আলোচনার কেন্দ্রে আনতে পেরেছেন। তিনি কর্মক্ষেত্রের গণতান্ত্রিক পরিবেশের কথা বলছেন। প্রতিষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গ্রহণে কর্মকর্তা-কর্মচারীর অংশগ্রহণ চেয়েছেন। ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতারা এক শতাংশের বিরুদ্ধে কথা বলছেন। এক শতাংশ মানুষের হাতে এখন দেশের ৪০ শতাংশ সম্পদ। তারাই রাজনীতি-অর্থনীতির সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ করছেন। কংগ্রেস সদস্য আলেকজান্দ্রিয়া ও তার বামপন্থী বন্ধুরা এই অবস্থার পরিবর্তন চান। তবে তারা সমাজতন্ত্রের পুরনো ধারণা ও কাঠামো নয়, নতুন ধারনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছেন।
লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে হয় বামপন্থী ও তাদের জোট ক্ষমতায়, না হলে এ দেশগুলোতে তারা প্রধান বিরোধী দল বা প্রভাবশালী রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে আছেন। কিউবা, ভেনিজুয়েলা, বলিভিয়া, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, মেক্সিকো— সর্বত্রই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও কর্পোরেট বেনিয়াদের নানা ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে তারা টিকে আছেন এবং অগ্রসর হচ্ছেন। লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে মার্কিন আগ্রাসন নীতির কারণে বামপন্থীদের প্রভাব দিন দিন আরও বাড়ছে ও অপ্রতিরোধ্য হচ্ছে।
ড. মঞ্জুরে খোদা: শিক্ষা গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)
Comments