কলকারখানা খোলার সিদ্ধান্ত

সরকার ও কারখানা মালিকদের দায়িত্বশীলতা নিয়ে প্রশ্ন

স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক ইকবাল আর্সনাল, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিকিৎসাবিজ্ঞানী অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। ছবি: সংগৃহীত

করোনাভাইরাস মহামারির দেড় বছরে সবচেয়ে ভয়াল সময় পার করছে বাংলাদেশ। অতি সংক্রামক ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বিস্তারে আক্রান্ত ও মৃত্যুর নতুন নতুন রেকর্ড হচ্ছে। চলমান কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যেও এই সংক্রমণ কমার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

ঈদুল আযহার পর পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে আরও বেশি। শয্যা পেতে রোগীকে নিয়ে এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতাল, এক জেলা থেকে অন্য জেলায় ছুটছেন স্বজনরা। কারণ ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত হাসপাতালগুলোতে এখন শয্যার চেয়ে রোগীর সংখ্যা বেশি।

এমন ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যেই ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে রোববার থেকে তৈরি পোশাকসহ সব রপ্তানিমুখী শিল্পকারখানা খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এই ঘোষণার পর থেকেই শনিবার চাকরি বাঁচাতে হন্যে হয়ে ঢাকার দিকে ছুটতে শুরু করেন শ্রমিকরা। গণপরিবহন বন্ধ থাকায় অতিরিক্ত ভাড়া গুণে আর দিনভর বিপুল ভোগান্তি মাথায় নিয়ে বিভিন্ন উপায়ে রাজধানী ও এর আশপাশের শিল্পাঞ্চলগুলোতে পৌঁছানোর চেষ্টা করেন তারা। স্বাস্থ্যবিধি বা সামাজিক দূরত্ব উপেক্ষা করেই বাধ্য হয়ে ফেরিতে গাদাগাদি করে পাড়ি দেন উত্তাল পদ্মা ও যমুনা।

এর আগেও, গত বছরের এপ্রিলে বিধিনিষেধ চলার মধ্যে শ্রমিকদের আনার ব্যবস্থা না করে কারখানা খুলে দেওয়ার হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। সেবারও তীব্র ভোগান্তি সঙ্গী হয়েছিল শ্রমিকদের। আর এবার সংক্রমণ ও মৃত্যুর গন্ধ মাখা আরও নাজুক সময়ের ভেতরেও সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল।

এ অবস্থায় সরকারের এই সিদ্ধান্ত এবং এর ফলে পথে পথে বিপুল সংখ্যক মানুষের এই সমাগম ঠিক কী ফলাফল বয়ে আনতে পারে, তা নিয়ে নতুন শঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিষয়টা নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে সরকার-সমর্থক স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সভাপতি অধ্যাপক ইকবাল আর্সনাল, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিকিৎসাবিজ্ঞানী অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদের সঙ্গে।

ব্যবসায়ীদের 'স্বার্থ রক্ষায়' সরকারের নেওয়া এই সিদ্ধান্তকে 'অবিবেচনাপ্রসূত' ও 'কাণ্ডজ্ঞানহীন' হিসেবে অভিহিত করেছেন এই বিশেষজ্ঞ ও বুদ্ধিজীবীরা। তারা বলেছেন, এর ফলে সংক্রমণ ও মৃত্যু আরও বেড়ে যাওয়ার বহুল সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। তাদের ভাষ্য, এই সিদ্ধান্তের ভেতর দিয়ে সরকারের ওপর গার্মেন্টস মালিকদের একচ্ছত্র প্রভাবের বিষয়টি যেমন প্রতিফলিত হয়েছে, তেমনি প্রত্যক্ষভাবেই ঝুঁকির মুখে ফেলা দেওয়া হয়েছে লাখ লাখ শ্রমিকের জীবন।

এ বিষয়ে স্বাচিপ সভাপতি অধ্যাপক ইকবাল আর্সনাল বলেন, 'এরা এই সমস্ত সিদ্ধান্ত কীভাবে নিচ্ছে, তা আমাদের কাছে বোধগম্য হচ্ছে না। ছুটিতে বেশিরভাগ শ্রমিক দেশে (গ্রামে) চলে গিয়েছিল। এখন কারখানা খোলার সিদ্ধান্তে তারা আবার একযোগে ঢাকায় ফিরতে শুরু করেছে। তারা যেভাবে চাকরি বাঁচানোর স্বার্থে পায়ে হেঁটে, নদী পার হয়ে জীবন বাজি রেখে ঢাকায় ফিরতে শুরু করেছে, তা আমাদের ক্রীতদাস প্রথাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে।'

সংকটকালীন পরিস্থিতিতে পোশাক কারখানার মালিকদের দায়িত্বশীলতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে স্বাচিপ সভাপতি বলেন, 'গার্মেন্টস মালিকদের বরাবরের বক্তব্য তাদের লাভ হয় না। অথচ তারা সরকারের কাছ থেকে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে বসে আছে। এমন খারাপ পরিস্থিতির ভেতরেও কারখানা খুলে দেওয়ার বিষয়ে তাদের এই অবস্থান আবারো তাদের সামন্তবাদী ও ঔপনিবেশিক চরিত্রকে তুলে ধরেছে।'

কারখানা খুলে দেওয়ার ঘোষণায় স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে মানুষ যেভাবে ঢাকার দিকে ছুটে আসছে, তাতে সংক্রমণ বাড়ার সুযোগ আরও বেশি উন্মুক্ত হয়ে পড়ছে বলে মন্তব্য করেন ইকবাল আর্সনাল।

তিনি বলেন, 'আক্রান্ত মানুষ হাসপাতালে জায়গা পাচ্ছে না। আইসিইউ'র জন্য এক জেলা থেকে অন্য জেলায় ছুটে বেড়াচ্ছে। অথচ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে বলা হচ্ছে শয্যার কোনো সংকট নেই। মিথ্যাচারে ভরে গেছে দেশটা। এতে জনগণ আরও বেশি আস্থা হারিয়ে ফেলছে। পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে।'

স্বাচিপ সভাপতি আরও বলেন, 'কারখানা খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত এমন একটা সময়ে নেওয়া হলো, যখন দেশের প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতেও সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে। সেসব জায়গা থেকেই এখন মানুষগুলো ছুটে আসছে। যাতে করে কেবল ঢাকা না, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জের মতো শহরগুলোতেও সংক্রমণের উর্বর ভূমি তৈরি করবে। এভাবে সংক্রমণের যত বাড়তে থাকবে, ক্রিটিকাল রোগীর সংখ্যাও বাড়বে। সেই সঙ্গে বাড়বে মৃত্যুর সংখ্যা। ওই ভয়াবহতার কথা কল্পনা করে আতঙ্কিত হচ্ছি।'

এ বিষয়ে অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী বলেন, 'কঠোর বিধিনিষেধ চলার একটা ফল হচ্ছে, করোনার ডেল্টা ধরণটা অত্যধিক রকমের সংক্রামক হওয়ার পরেও আমাদের রেট অব পজিটিভিটি মোটামুটি ৩০ শতাংশ বা তার আশপাশে ছিল। যদিও ঈদের আগে বিধিনিষেধ শিথিল না করলে এটা নিম্নমুখী হওয়াও সম্ভব ছিল। তারপরও সার্বিক বিচারে এটাকে একটা অর্জনই বলব। কারণ সংক্রমণের হার ৪০ এমনকি ৫০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারতো। তাতে দেশের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যেতো। যেমনটা ভারতে ঘটেছিল।'

এই জৈব-চিকিৎসা বিজ্ঞানীর (বায়োমেডিকেল সায়েন্টিস্ট) পর্যবেক্ষণ হলো, 'লকডাউনের মধ্যে গড় সংক্রমণের হার ৩০ শতাংশ থাকলেও মৃত্যুর হার বেড়েছে। অর্থাৎ এই দুটি বিষয় যা নির্দেশ করছে, সেটা হলো- আমাদের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সামর্থ্য ৩০ শতাংশ পর্যন্ত। এতেই হাসপাতালগুলো উপচে পড়ছে। বিশেষ করে হাই-ফ্লো ন্যাসাল ক্যানুলা, অক্সিজেন ডেলিভারি ও আইসিইউ সংকট প্রকট হয়ে উঠছে।'

অধ্যাপক লিয়াকতের অভিমত, 'এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার একমাত্র পথ ছিল রেট অব পজিটিভিটি আরও কমানো। এটা কমাতে পারলেই একমাত্র স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর চাপ কিছুটা কম পড়তো। এখন যদি ওরা দেখায়ও যে, বিধিনিষেধ শিথিল করার পর, কারখানা খুলে দেওয়ার পর রেট অব পজিটিভিটি একই আছে, তাহলেও মৃত্যুহারের দিক থেকে আমি আশঙ্কা করছি, এটা খুব খারাপ একটা ফলাফল আনবে। এটা অবশ্যই আশঙ্কার বিষয়।'

লিয়াকত আলী বলেন, 'সরকার যদি কোনো কারণে নিতান্তই প্রয়োজন মনে করে যে, কোনো কোনো জায়গায় তারা বিধিনিষেধ শিথিল করবে, তাহলে সেটা খুব দক্ষতার সঙ্গে, সমন্বিত উপায়ে ও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার ভিত্তিতেই করা উচিত।'

এই চিকিৎসাবিজ্ঞানী আরও বলেন, 'সারা দুনিয়ায় বিভিন্ন গবেষণার ফলাফল বলছে লকডাউন বলি, কঠোর বিধিনিষেধ বলি সেটা হতে হবে ইমপ্লিমেন্টেবল, কো-অর্ডিনেটেড, ইটস মাস্ট হ্যাভ এ কমিউনিটি এনগেজমেন্ট। আর লকডাউনই একমাত্র সমাধান না। এর মাধ্যমে সংক্রমণ কমিয়ে এনে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর চাপ কমানো হয়। সেই ফাঁকে স্বাস্থ্য সুবিধা সম্প্রসারণের পাশাপাশি নানা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়।'

অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ মনে করেন, ভীষণ রকমের আপৎকালীন পরিস্থিতির মধ্যেও তৈরি পোশাকসহ রপ্তানিমুখী কলকারখানা ‍খুলে দেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্তে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ সরকার এর আগেও এ সংক্রান্ত যে সিদ্ধান্তগুলো নিয়েছে, সেগুলো নিয়ে কোনো ধরনের আগাম প্রস্তুতি, পরিকল্পনা কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনা ছিল না।

তিনি বলেন, 'আমরা সব সময়ই দেখি, সরকারের ওপর কাদের প্রভাব বেশি সেটার একটা প্রতিফলন ঘটে সরকারের সিদ্ধান্তে। এর সঙ্গে পরিস্থিতি পর্যালোচনা, পরিকল্পনা, সমন্বয়, জনস্বার্থ এগুলোর কোনো সম্পর্ক আমরা দেখি না কখনো।'

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের এই শিক্ষকের অভিমত, 'আমরা বরাবরই দেখে আসছি সরকারের ওপর গার্মেন্টস মালিকদের যে প্রভাব, সেটা একচ্ছত্র। মহামারির প্রায় পুরো সময় গার্মেন্টস খোলা ছিল। বলা হয়েছিল, শ্রমিকদের জন্য পরিবহনের ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু বেশিরভাগ কারখানা সেই ব্যবস্থা করেনি। সরকারও কিছু বলেনি। এই যে অব্যবস্থাপনা, আর তার কারণে যে নেতিবাচক প্রভাব, সেগুলো তো আমরা আগের তথাকথিত লকডাউন কিংবা শাটডাউনগুলোতে দেখেছি।'

আনু মুহাম্মদ বলেন, 'ঈদের পর থেকেই কিন্তু পোশাক শ্রমিকদের ঢাকার দিকে আসা অব্যাহত ছিল। কারখানাগুলো থেকে ফোন করে তাদের আসতে বলা হচ্ছিল। চাকরি হারানোর ভয়ে, মজুরি হারানোর ভয়ে শ্রমিকরা আসছিলেনও। কিন্তু এবার আনুষ্ঠানিক ঘোষণার পর তা আরও তীব্র হয়েছে।'

এই অর্থনীতিবিদ মনে করেন, যৌক্তিকতা, বিচার-বিশ্লেষণ কিংবা সব কিছু পর্যালোচনা সাপেক্ষে জীবন-জীবিকার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে কোনো সিদ্ধান্ত না নেওয়ার ফলে সরকারের কোনো সিদ্ধান্তের প্রতিই জনগণের কোনো আস্থা তৈরি হচ্ছে না।

তিনি বলেন, 'মানুষ অনেক কিছু মানছে না। যা আসলে মানা উচিত। এর কারণ হচ্ছে, সরকারের কথাবার্তার ওপর মানুষের কোনো ভরসা নেই। এটা আরও একটা বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি করেছে।'

Comments

The Daily Star  | English

Khaleda acquitted in Zia Charitable Trust graft case

The HC scraped the trial court verdict that sentenced Khaleda and two others in the same case.

31m ago