শ্রদ্ধাঞ্জলি

আবার যদি দেখা হতো

(মিডিয়া ব্যক্তিত্ব মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর ২০১৯ সালের ১০ জুলাই রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন।)

আপনাকে নিয়ে কিছু লেখার কথা আমার, আপনাকে নিয়ে যে বইটি প্রকাশিত হবে তার জন্যে। কী লিখব? এতদিন আমাদের সব লেখার বিষয়তো আপনিই ঠিক করে দিতেন। সেই আপনাকে নিয়েই কিছু লিখতে হবে? পারছি না, তাই চিঠি লিখছি।

আপনাকে কখনো চিঠি লেখা হয়নি। কোনো প্রয়োজনও পড়েনি। আজ লিখছি, নৃত্যাঞ্চলের সেই চেয়ার টেবিলে বসে, যেখানে আপনি বসতেন। বার বার মনে হচ্ছে, এই বুঝি আপনি রুমে ঢুকে বলবেন, ‘হাই, এনিথিং নিউ?’ কিছু বলার আগেই থামিয়ে দিয়ে বলতেন, ‘একটু বসো, আমার হাতের কাজটি সেরে নেই’। এরপর কাগজ-কলম নিয়ে লিখতে বসে যেতেন।

আপন মনে লিখতেন, আপনাকে লিখতে লিখতে কখনো ভাবতে দেখিনি, সব ভাবনা তো আপনার মাথায় সবসময় ঘুরপাক খেত। তাই নতুন করে আপনাকে কিছু ভাবতে হতো না। লেখা শেষ করে হাদিসকে কম্পোজ করার জন্যে রানার কাছে পাঠিয়েই বলতেন, ‘এবার বলো কী খবর’। কত খবর, কত গল্প, কত বিষয়, কতই না কথা আমরা নৃত্যাঞ্চলের এই ছোট্ট অফিসটিতে বসে করেছি, তাই না? আমাদের তিন জনের গড়া নৃত্যাঞ্চলের এই বিশেষ আকর্ষণটিই ছিল এই আড্ডা। শিবলী যেদিন আসত, সেদিন ছোট ছোট গল্পগুলো টেনে টেনে উপন্যাস হয়ে যেত।

কী নির্মল! কী অটুট বন্ধন আমাদের। কেমন করে ছেড়ে চলে গেলেন?

আমাদের তিন জনের এত সুন্দর একটি সম্পর্ক, কী অদ্ভুত একটি শক্তি, যা নিয়ে আমরা এত লম্বা একটি পথ চলেছি। ১৯ বছরের পথ। কখনো হোঁচট খাইনি, কেউ পথ হারাইনি, একজন আরেকজনকে শক্ত হাতে ধরে ছিলাম। তিন জনেরই পথের শেষ ঠিকানা নৃত্যাঞ্চল। আমাদের কথা ছিল আমরা একসঙ্গে চলব, সেই পথ থেকে আমাদের দুই জনকে ফেলে কোথায় হারিয়ে গেলেন? কীভাবে পাড়ি দেবো আমাদের সামনের দীর্ঘ পথ?

খুব অসহায় লাগে জানেন? ভীষণ ফাঁকা, শূন্য মনে হয় চারপাশ। আমাদের তিন জনের মাঝখানে ছিলাম আমি। আপনি বেশি সিরিয়াস, শিবলী একটু অলস। মাঝখানে খুব কঠিন একটি জায়গা ছিল আমার, সেটা হলো দুজনকেই এক ছন্দে বাঁধা। হয়তো বেঁধে ছিলাম, তাই আমাদের চলার পথে কখনো ছন্দপতন হয়নি।

ছন্দপতন ঘটল ২০১৯ সালের ১০ই জুলাই, যেদিন আপনি চলে গেলেন।

সেদিন মনে হয়েছিল, আর হয়তো কোনো ছন্দ বাজবে না আমাদের নৃত্যাঞ্চল পরিবারে। ঈশ্বরের ওপর ভীষণ অভিমান হয়, আর কটাদিন আপনাকে আমাদের মাঝে থাকতে দিতে পারত না? এতই তাড়া? আপনার স্বপ্নগুলো, আপনার চিন্তা, আপনার ইচ্ছেগুলো আমরা কি পারব সফল করতে? আমরা কি পারব নৃত্যাঞ্চলের প্রতিটি সদস্যকে আপনার মতো ভালোবাসায় জড়িয়ে রাখতে? সবার প্রতি সমান দায়িত্ব পালন করতে? জানি না।

তবে, নৃত্যাঞ্চল এখন আগের চেয়েও অনেক দৃঢ়, কষ্টটাকে ধারণ করে শক্তিতে পরিণত করতে চায়। আপনি জানেন শিবলীর কত পরিবর্তন? ও এখন সব কাজে ভীষণ সিরিয়াস। দুপুরে ঘুমানোর বায়না করে না, হয়তো আপনাকে ভুলে থাকতে চায় কাজের মাধ্যমে। আপনার ভালোবাসার মানুষগুলো আপনাকে কত ভালোবাসে, সেটা কি আপনি দেখতে পান? আপনার পরিবার, নৃত্যাঞ্চল, বন্ধুদের নীরব কান্না আপনি কি অনুভব করতে পারেন? আপনি তো ভীষণ নরম মনের মানুষ, কোনো কষ্ট দেখলেই চোখ মুছতেন। তাহলে আপনার জন্য এত কান্না, এত কষ্ট, আপনাকেও কি কষ্ট দেয়?

কত প্রশ্ন, কত গল্প, কত ঘটনা ঘটে যাচ্ছে এতদিনে, কীভাবে আপনাকে বলব? কোন ঠিকানায় পাঠাব এই চিঠি? কুলসুম টাওয়ার? নৃত্যাঞ্চল অফিস? না বুদ্ধিজীবী কবরস্থান?

ভেবে পাই না, ভাবতে চাইও না। আমি উপলব্ধি করি, আপনি আমাদের মধ্যেই বাস করেন। আমাদের জীবনে, সৃজনে, হাসি-কান্নায়। আপনার ঠিকানা যেখানেই হোক, যতদূরেই থাকুন আপনি, আমাদের হৃদয়ের ঠিকানায় আপনি আজীবন বসবাস করবেন। সেখান থেকে কেড়ে নেওয়ার ক্ষমতা কারোর নেই। ঈশ্বরও হয়তো এতটা নিষ্ঠুর হবে না, আমাদের মনের ঠিকানা থেকে আপনাকে সরিয়ে দিবে।

জীবনের ওই প্রান্তে কী আছে আমি জানি না। জানি না আমরা কোথায় যাব। তবে, ভীষণ লোভ হয়, মনে হয় আবার যদি দেখা হতো? আর নৃত্যাঞ্চল, হাসি, আনন্দ, কর্মময় পথ চলা… সেই অপেক্ষায়।

 

শামীম আরা নীপা: প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী ও নৃত্যাঞ্চলের পরিচালক

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Onion prices climb back to Tk 150 per kg

Prices of local varieties of onions again reached Tk 150 per kilogramme (kg) in different kitchen markets in Dhaka while hitting as much as Tk 165 per kg in certain cities outside the capital, deepening the woes of low and fixed-income people..In November 2023, local varieties of the popul

1h ago