‘উচ্ছেদের ভয় তাদের আর নেই’

সরকারি খাস জমিতে কয়েক যুগ ধরে অবৈধভাবে বসবাস করে আসা দিনমজুর মো. আনিসকে সবসময়ই উচ্ছেদের ভয় তাড়া করে বেড়াত। একসময় এই জমির মালিক ছিলেন মানিকগঞ্জের জমিদার।
মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার তেওতা এলাকার সত্তরোর্ধ বিধবা নারী পারুল আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় পাওয়া ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। ছবি: শেখ এনামুল হক

সরকারি খাস জমিতে কয়েক যুগ ধরে অবৈধভাবে বসবাস করে আসা দিনমজুর মো. আনিসকে সবসময়ই উচ্ছেদের ভয় তাড়া করে বেড়াত। একসময় এই জমির মালিক ছিলেন মানিকগঞ্জের জমিদার।

তিনি বলেন, ‘আমাদের পূর্বপুরুষরা জমিদারদের কৃষি কাজ দেখাশুনা করত। তারাই (জমিদার) আমাদের এখানে থাকতে দেয়।’

‘তাগো নুন খাইছি, তাগো কেমনে কই জমি লেইখ্যা দিতে,’ সত্তরোর্ধ আনিস বলেন।

তারা চলে যাওয়ার পর সম্পত্তির মালিকানা সরকার নিয়ে নেয় এবং আমাদের হই অবৈধ।

‘আইনে যা আছে তাই, আইনের উপরে ত আমাগো আর কথা নাই,’ তিনি বলেন।

মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার তেওতা ইউনিয়নে নতুন নির্মিত ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আনিস বলেন, ‘তবে উচ্ছেদের ভয়টা আর নাই। সরকারকে ধন্যবাদ।’

আনিস ছাড়াও সরকারের আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় তেওতাতে আরও ২৩টি গৃহহীন পরিবারকে ঘর দেওয়া হয়েছে।

আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের পরিচালক অতিরিক্ত সচিব মাহবুব হোসেন জানান, প্রকল্পটির আওতায় দেশের ৪৫৯টি উপজেলার গৃহহীন ও ভূমিহীন পরিবারকে মোট ৫৩ হাজার ৩৪০টি ঘর দেওয়া হচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ২০ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে ঘরগুলো হস্তান্তর করবেন।

এদিকে, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস গতকাল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে (পিএমও) এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, মুজিববর্ষে দেশের গৃহহীনদের পুনর্বাসনে সরকারের উদ্যোগের অংশ হিসেবে ডিসেম্বরের মধ্যে আরও এক লাখ ঘর দেওয়া হবে।

এ বছরের জানুয়ারিতে সরকার গৃহহীনদের ৬৯ হাজার ৯০৪টি ঘর দিয়েছে। গত ৯ জুন মানিকগঞ্জ পরিদর্শনে গিয়ে এই সংবাদদাতা দেখতে পান ঘরগুলো বসবাসের জন্য প্রস্তুত।

জমিদারদের পরিত্যক্ত প্রাচীন ভবনগুলো থেকে কয়েক গজ দূরে তেওতা ইউনিয়ন পরিষদ অফিসের পেছনে আধা-পাকা হলুদাভ সাদা বাড়িগুলো দাঁড়িয়ে আছে।

প্রতিটি বাড়িতে আছে দুটি ঘর, টয়লেট, রান্নাঘর ও বারান্দা। ছাদ হিসেবে দেওয়া হয়েছে লাল রংয়ের টিন।

যারা বাড়ি পেয়েছেন তাদের চোখে মুখে ছিল খুশির ঝিলিক।

তাদেরই একজন সত্তরোর্ধ পারুল উৎসাহ নিয়ে সাংবাদিকদের তার নতুন ঘর দেখাচ্ছিলেন।

আগে তিনি সরকারি জমিতে একটি ভাঙ্গা ঘরে বাস করতেন। ‘আমার স্বামী অনেক আগে মারা গেছে…. এহন মাইনষের বাসায় কাম করি’

‘আমি খুব খুশি মাথা গুঁজার ঠাঁই পাইছি…. শান্তিতে মরতে পারমু,’ তিনি বলেন।

আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের পরিচালক অতিরিক্ত সচিব মাহবুব হোসেন জানান, প্রতিটি বাড়ি তৈরি করতে সরকার প্রায় দুই লাখ টাকা ব্যয় করেছে।

তিনি জানান, দ্বিতীয় ধাপে অর্থায়ন করছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবং আশ্রয়ণ-২ প্রকল্প। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সবকিছু সমন্বয় করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘সরকার দুটি পর্যায়ে গৃহহীন মানুষকে এক লাখ ২৩ হাজার ২৪৪টি ঘর দিয়েছে এবং এই প্রকল্পের জন্য ব্যয় হয়েছে প্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকা।’

সরকার খুলনার ডুমুরিয়ার কাঠালতলা বাজারে ৬৪টি ঘর বরাদ্দ দিয়েছে, যেখানে লোকজন ইতোমধ্যে বসবাস শুরু করেছে।

দ্বিতীয় ধাপে আরও ৪৫টি নতুন ঘর নির্মিত হয়েছে।

সরেজমিনে সংবাদদাতা দেখতে পান যে, পুরোদমে নির্মাণ কাজ চলছে।

ইতোমধ্যেই বসবাস শুরু করা বাসিন্দারা প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

তাদের একজন ভ্যানচালক কাজী শহিদুল ইসলাম জানান, বরাদ্দ পাওয়ার আগে তিনি তার স্ত্রীসহ ডুমুরিয়া মহাসড়কের পাশে থাকতেন।

তিনি বলেন, ‘আমি এখানে আমার স্ত্রী ও ছেলেদের নিয়ে শান্তিতে আছি।’

প্রকল্প এলাকার ১০৯টি পরিবারের জন্য মাত্র চারটি নলকূপ স্থাপন করায় স্থানীয়রা খাবার পানি নিয়ে উদ্বেগের কথা জানান।

ডুমুরিয়ার ইউএনও আবদুল ওয়াদুদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, তারা ইতোমধ্যে বাসিন্দাদের জন্য চারটি গভীর নলকূপ স্থাপন করেছেন।

‘আমরা আরও নলকূপের জন্য চাহিদা দিয়েছি। আমাদের লক্ষ্য প্রতি দশটি পরিবারের জন্য একটি নলকূপ সরবরাহ করা,’ তিনি বলেন।

ব্যাপক উন্নয়ন

প্রধানমন্ত্রী কোভিড-১৯ মহামারির মধ্যেও গৃহহীন ও ভূমিহীনদের পুনর্বাসন অব্যাহত রেখেছেন উল্লেখ করে ড. কায়কাউস বলেন, ‘এটি শেখ হাসিনার ব্যাপক উন্নয়নের একটি মডেল।’

মুখ্য সচিব বলেন, দুই ডেসিমেল জমির মূল্য গড়ে ৫০ হাজার টাকা হলে প্রতিটি পরিবার প্রায় দুই লাখ ৬০ হাজার টাকার সম্পদ পাচ্ছে। প্রতিটি বাড়ির নির্মাণ ব্যয় প্রায় দুই লাখ টাকা, ইউটিলিটি কানেক্টিভিটির (বিদ্যুৎ ও গ্যাস) ব্যয় প্রায় ১০ হাজার টাকা।

১৯৯৭ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আশ্রয়ণ প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন উল্লেখ করে ড. কায়কাউস বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় পরিচালিত আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় এখন পর্যন্ত মোট তিন লাখ ৭৩ হাজার ৫৬২টি গৃহহীন ও ভূমিহীন পরিবারকে ঘর দেওয়া হয়েছে।

আগামী রোববার সবচেয়ে বেশি রংপুর বিভাগে ১২ হাজার ৪৩৬টি ঘর দেওয়া হবে। চট্টগ্রাম বিভাগে ১০ হাজার ৫৪৭টি, ঢাকা বিভাগে সাত হাজার ৬৩০টি, রাজশাহী বিভাগে সাত হাজার ১৭২টি বরিশাল বিভাগে সাত হাজার ১৫৩টি, খুলনা বিভাগে ৯১১টি, ময়মনসিংহ বিভাগে দুই হাজার ৫১২টি এবং সিলেট বিভাগে এক হাজার ৯৭৯টি ঘর দেওয়া হবে।

আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় তৈরি করা তালিকা অনুযায়ী, দেশে গৃহহীন ও ভূমিহীন পরিবারের সংখ্যা (শ্রেণী-ক) দুই লাখ ৯৩ হাজার ৩৬১ এবং শুধু গৃহহীন পরিবারের সংখ্যা (শ্রেণির-খ-এর অধীনে) পাঁচ লাখ ৯২ হাজার ২৬১।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন সুমন আলী।

Comments

The Daily Star  | English
battery-run rickshaws in Dhaka

Banning rickshaws may not be the big traffic solution

Dhaka’s traffic is a complicated problem that needs multifaceted efforts to combat it.

1h ago