‘বাঁধের ব্যবস্থা কুরো, নাহলি আমাগে গেরাম ছাড়ি যেতে হবেনে’
গত বুধবার সন্ধ্যা থেকে বৃষ্টি শুরু হওয়ায় আশাশুনির প্রতাপনগরে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কষ্ট কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। তিন সপ্তাহের বেশি সময়েও প্রতাপনগরের ভেঙে যাওয়া বাঁধ মেরামত না হওয়ায় তাদের এই দুরবস্থা। এখনো পানিবন্দি অবস্থায় আছেন এ ইউনিয়নে চার হাজার পরিবারের প্রায় ২০ হাজার মানুষ।
দিঘলারআইট গ্রামের রমেচ্ছা খাতুন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘পানির মদ্যি রয়ছি প্রায় মাস হয়ে গেল। কোন কাজনি। এক বিলা জোটে তা আর এক বিলা জোটে না। এভাবে কুনো রকমে ব্যাচি নইছি। আমাগো ত্রাণের ব্যবস্থা কুরো। বাঁধের ব্যবস্থা কুরো নাহলি আমাগে গেরাম ছাড়ি চলে যাতি হবেনে।’
ইয়াসের তিন সপ্তাহ পরেও মেরামত হয়নি প্রতাপনগরের কুড়িকাউনিয়া, হরিষখালি, দিঘলারআইট ও বন্যতলার বেড়িবাঁধ। সেখানকার মানুষের বাড়ির আঙিনায় চলছে জোয়ার-ভাটা। দু’বেলা দুই মুঠো খাবারসহ সুপেয় পানির জন্য তাদের কষ্টের সীমা নেই।
সরেজমিনে প্রতাপনগর ইউনিয়নের শ্রীপতিপুর, কুড়িকাউনিয়া, নাকনা, প্রতাপনগর, সোনাতনকাটি ঘুরে দেখা গেছে- ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের আজ ২৩ দিন অতিবাহিত হচ্ছে। তবে, এসব গ্রামের চারদিক এখনো ডুবে আছে পানিতে। ঘরবাড়ি জেগে থাকলেও বাড়ির চারপাশে পানি আর পানি। নৌকায় চলাফেরা করছে মানুষ। খাবার কষ্টের সঙ্গে আছে খাবার পানির অভাব। ঘূর্ণিঝড় আম্পানের পর ভাটায় পানি সরে যেত। কিন্তু, ইয়াসের পরে পানি সরছে না। ফলে, আম্পানের থেকেও ভোগান্তি বাড়ছে মানুষের। পানিবন্দি থাকায় অনেকের জ্বর, কাঁশি, সর্দি, ডায়রিয়াসহ দেখা দিচ্ছে নানা পানিবাহিত রোগ। রাস্তার পাশে যাদের বাড়ি তারা কেউ কেউ ত্রাণ পেলেও ভিতরের দুর্গম এলাকায় কেউ ত্রাণ দিতে আসছে না।
গত তিন সপ্তাহের ওপর পানিবন্দি জীবনযাপন করছেন উল্লেখ করে শ্রীপুর গ্রামের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ওহিদুল ইসলাম জানান, অনেকে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে। প্রতিবছর এভাবে নদী ভাঙনে সর্বস্বান্ত হলে এলাকায় কোনো লোক থাকতে পারবে না। তাদের ঠিকানা বিলীন হয়ে যাবে।
চিংড়ি ঘের ছিল ২০ বিঘার। আম্পানে ১০ মাস ডুবে থাকার পর আবার বেঁড়ি দিয়ে চিংড়ি চাষ শুরু করেছিলেন ঋণ করে। দুই মাস যেতে না যেতে ইয়াসের প্রভাবে নদী ভাঙনে সব শেষ হয়ে গেছে উল্লেখ করে প্রতাপনগর গ্রামের মৎস্য ব্যবসায়ী মাহমুদ হাসান জানান, স্থায়ী বেঁড়িবাধ না হলে এ এলাকায় মানুষ বসবাস করতে পারবে না।
প্রতাপনগর ইউপি চেয়ারম্যান জাকির হোসেন জানান, গত বছরের ২০ মে আম্পানে জোয়ারের পানিতে ভেসে গেছে কোটি কোটি টাকার সম্পদ। সেই ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা চালাচ্ছিল এই উপকূলের মানুষ। তার আগেই চলতি বছর ইয়াসের আঘাতে আবার লণ্ডভণ্ড হয়েছে তার ইউনিয়ন। বর্তমানে তার ইউনিয়নের প্রতাপনগর, শ্রীপুর, কুড়িকাউনিয়া, সোনাতনকাটি, কল্যাণপুর, লস্কারিখাজরা, নাকনা, বন্যতলা ও দিঘলারআইট গ্রামের চার হাজার পরিবারের ২০ হাজার মানুষ এখনো পানিবন্দি। কাজ নেই, খাবার নেই। কেউ মারা গেলে ওইসব গ্রামে কবর দেওয়ার পর্যন্ত জায়গা নেই। একটা ক্ষত কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই আবার আঘাত। মানুষ কীভাবে পারবে?
আশাশুনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজমুল ইসলাম খান জানান, ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে আশাশুনি সদর, প্রতাপনগর, বড়দল, আনুলিয়া, খাজরা ইউয়িনের ১৪টি পয়েন্টে বাঁধ ভেঙে এলাকা প্লাবিত হয়। অধিকাংশ স্থানে স্থানীয় মানুষ, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও প্রশাসনের সহায়তায় বাঁধা সম্ভব হলেও প্রতাপনগরের চারটি স্থানে বাঁধ সংস্কার এখনো সম্ভব হয়নি। এ জন্য কয়েকটি গ্রামের মানুষ এখনো পানিবন্দি জীবনযাপন করছে।
সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের বিভাগ-২-এর নির্বাহী প্রকৌশলী রাশেদুর ইসলাম বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে নদীতে পানি বৃদ্ধি পেয়ে সাতক্ষীরা এবং খুলনার কয়রার ২৫টি পয়েন্টে বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করছিল। ইতোমধ্যে ২০টি স্থানের বাঁধ সংস্কার করে লোকালয়ে পানি প্রবেশ আটকানো হয়েছে। খুলনার কয়রার দুইটি ও সাতক্ষীরার প্রতাপনগরের চারটি পয়েন্টে বাঁধ দিয়ে এলাকায় পানি ঢুকছে। বর্তমানে প্রতাপনগরের কুড়িকাউনিয়া ও হরিষখালী আমাদের কাজ চলছে। বন্যতলা পয়েন্টে জাইকার অর্থায়নে কাজ হবে। ২৬ জুন পূর্ণিমায় নদীতে পানি বৃদ্ধি পেতে পারে। আশা করছি তার আগে সব বাঁধের কাজ করা যাবে।’
Comments