গার্ড অব অনারে নারী ইউএনওর বিকল্প ‘সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক’ প্রস্তাবনা

সংবিধান অনুযায়ী সবাই দায়িত্ব পালন করবে, নারী না পুরুষ তা বিবেচ্য না: মুক্তিযুদ্ধমন্ত্রী
সংসদীয় কমিটির প্রস্তাবটির প্রতিবাদে গতকাল সকালে শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরের সামনে সামাজিক প্রতিরোধ কমিটির ব্যানারে মানববন্ধন করা হয়েছে। ছবি: প্রবীর দাশ/স্টার

বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মৃত্যুর পর গার্ড অব অনার দেওয়ার ক্ষেত্রে নারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) বিকল্প চেয়ে গত রোববার সুপারিশ করেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি।

সুপারিশে ধর্মীয় অনুভূতির যুক্তি দিয়ে, যেখানে নারী ইউএনও আছেন, সেখানে বিকল্প একজন পুরুষ কর্মকর্তা নির্ধারণ করার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয়েছে।

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, অধ্যাপক কাবেরী গায়েন ও নিনা গোস্বামী। (বাম দিক থেকে)

দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে এমন সুপারিশ বা সিদ্ধান্তকে নারী ক্ষমতায়নের পথে অন্তরায় বলে অভিহিত করেছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক কাবেরী গায়েন এবং আইন ও শালিস কেন্দ্রের (আসক) সিনিয়র উপপরিচালক নিনা গোস্বামী

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘এটা সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক একটি প্রস্তাবনা। যেখানে নারীকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার জন্য ডিসক্রিমিনেশন ল করার অনুমতি দিয়েছেন আদালত, সেখানে গার্ড অব অনার দেওয়ার ক্ষেত্রে নারীকে না রাখার সুপারিশে সামাজে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।’

তিনি আরও বলেন, ‘সমাজকে বদলানোর কথা নেতার। সমাজের নেতিবাচক বিষয়গুলো নেতা তার নেতৃত্ব দিয়ে পরিবর্তন করবেন। সেখানে তাদের এমন সুপারিশ তো কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য না। এগুলো মেরিটলেস প্রস্তাবনা।’

‘দেশে নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে সত্যিকারের অঙ্গীকারের পরিবর্তে কেবল প্রতিশ্রুতি আছে’উল্লেখ করে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘অঙ্গীকার যদি থাকত, তাহলে কি এই জাতীয় সিদ্ধান্ত আসতে পারত? সত্যিই যদি আইনপ্রণেতা, নীতিনির্ধারকরা নারীর সমান অধিকারের কথা ভাবেন, তাহলে কি এই প্রস্তাব আসতে পারে? আমি তো মনে করি না।’

কমিটির এই সুপারিশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে গত সোমবার হাইকোর্টে রিট করেছে ফাউন্ডেশন ফর ল’ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এফএলএডি)। আবেদনকারীর আইনজীবী ফওজিয়া করিম ফিরোজ ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘সংসদীয় কমিটির এই সুপারিশ সংবিধানের ২৭ ও ২৮ অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন। সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।

এই সুপারিশকে হতবাক করে দেওয়ার মতো উল্লেখ করে অধ্যাপক কাবেরী গায়েন বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে নারীরা অংশ নিয়েছেন। তাদের বিপুল ত্যাগের ওপর এই দেশটা দাঁড়িয়ে। আজকে সব সূচকে নারীরা এগিয়ে যাচ্ছেন, সবক্ষেত্রে নারীরা দাপটের সঙ্গে কাজ করছেন। কেন নারীদের গার্ড অব অনার দিতে দেওয়া হবে না, এর কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা তারা দেননি, দিতেও পারবেন না। এমন সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়ার কোনো কারণ নেই।’

এমন সুপারিশ যেন কোনোভাবেই বাস্তবায়ন হতে না পারে, সেজন্য সবাইকেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে এগিয়ে আসার অনুরোধ জানান তিনি।

প্রশ্ন রেখে অধ্যাপক কাবেরী গায়েন বলেন, ‘তিনি যদি ওই পদে থাকতে পারেন, তাহলে গার্ড অব অনার কেন দিতে পারবেন না?’

সংসদীয় কমিটির কাছ থেকে এ ধরনের সুপারিশ নারী ক্ষমতায়নের সার্বিক অগ্রগতিতেও প্রভাব ফেলতে পারে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এ ধরনের কথা বলাটাই একজন নারীর জন্য অপমানজনক। এটা আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও সংবিধান পরিপন্থি। নারী ক্ষমতায়নের যত দালিলিক ও প্রায়োগিক জায়গা আছে, তার ওপর এটা একটা মারাত্মক চপেটাঘাত।’

এ ধরনের সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে নারী কর্মকর্তাদের গণহারে পদত্যাগের মাধ্যমে প্রতিবাদ করা উচিত হবে বলেও মনে করেন তিনি।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির এই প্রস্তাবের নিন্দা জানিয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক), বাংলাদেশ মহিলা পরিষদসহ বিভিন্ন সংগঠন।

এই সুপারিশের প্রতিবাদে গতকাল সকালে শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরের সামনে সামাজিক প্রতিরোধ কমিটির ব্যানারে মানববন্ধন করা হয়েছে। এতে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেমের সভাপতিত্বে নারী অধিকার কর্মীরা বক্তব্য রাখেন।

আইন ও সালিশ কেন্দ্র থেকে এই সুপারিশের বিষয়ে তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়েছে উল্লেখ করে নিনা গোস্বামী বলেন, ‘সরকার যেখানে নারী উন্নয়নে বিশেষ জোর দিচ্ছে, সেখানে এমন চিন্তা আসে কী করে? সংসদীয় কমিটি যদি এমন চিন্তা করে, এখনো সেই পুরাতন ধ্যান-ধারণার বশবর্তী হয়ে থাকে, তাহলে সামনে আমাদের কী হবে?’

তিনি আরও বলেন, ‘সংসদীয় কমিটি মানে তো একজন সংসদ সদস্যের মতামত নয়। এটা তো কয়েকজন সংসদ সদস্যের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত। যদি এটা সবার সিদ্ধান্ত হয়ে থাকে, তাহলে তারা সবাই এই ধরনের চিন্তাধারার মানুষ। তাহলে তাদের কাছে আগামীতে আমরা কী আশা করতে পারি! তারা কি সরকারের এসডিজি লক্ষ্য সম্পর্কে জানেন না? এর কোনো কিছুই তাদের চিন্তায় এলো না? নারীর প্রতি কত বড় অমর্যাদাকর একটা সিদ্ধান্ত আনতে চাইছেন তারা। এটা চিন্তা করতেও খারাপ লাগে।’

এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে পরবর্তীতে অন্যান্য সংসদীয় কমিটিও এ ধরনের সুপারিশ করতে পারে এবং তা বাস্তবায়ন হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন নিনা গোস্বামী।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি শাজাহান খানের সভাপতিত্বে বৈঠকে কমিটির সদস্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, রাজি উদ্দিন আহমেদ, রফিকুল ইসলাম, কাজী ফিরোজ রশীদ, ওয়ারেসাত হোসেন ও মোছলেম উদ্দিন আহমদ অংশ নেন।

এই সুপারিশের বিষয়ে জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘এটা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।’

তার উপস্থিতিতেই বৈঠকে এমন একটি সিদ্ধান্ত হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রস্তাবনা তো যে কেউ করতেই পারেন। তাকে তো প্রস্তাব করা থেকে বিরত রাখতে পারব না।’

কমিটির কতজন সদস্য এই প্রস্তাবের পক্ষে ছিলেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কেউই এর পক্ষে বলেনি। আমি সেখানে বলেছি, সংবিধান অনুযায়ী সবাই নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করবে। তিনি নারী না পুরুষ তা বিবেচ্য বিষয় না।’

Comments

The Daily Star  | English

S Alam threatens int'l legal action against govt over asset freezing: FT

Alam says his family's bank accounts were frozen, they were subjected to travel bans, and they lost control of their companies, all while facing investigations for alleged money laundering without formal notification.

1h ago