হুমকির মুখে টাঙ্গাইলের শালবনের অস্তিত্ব
নির্বিচারে গাছ কাটা এবং অব্যাহত বনভূমি দখলের কারণে দ্রুত সংকুচিত হয়ে আসছে টাঙ্গাইলের শালবন। হুমকির মুখে পড়েছে এই প্রাকৃতিক সম্পদ, বিলুপ্তির পথে এখানকার উদ্ভিদ ও প্রাণীজগৎ।
বন কর্মকর্তা ও স্থানীয় বাসিন্দারা যখন দেশের অন্যতম এই বন ধ্বংসের জন্য একে অপরকে দায়ী করে যাচ্ছেন, ততক্ষণে উজাড় হয়ে গেছে বনের দুই-তৃতীয়াংশ বা ৮০ হাজার একর ভূমির প্রাকৃতিক বন। আর এই তথ্য খোদ বন বিভাগের।
টাঙ্গাইলের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. জহিরুল হক দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, একসময় বাঘ, ময়ূর ও ল্যাঙ্গুরসহ বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল এই শালবন বিস্তৃত ছিল এক লাখ ২২ হাজার ৮৭৬ একর ভূমিতে (১৯২৫ সাল থেকে ফরেস্ট সেটেলমেন্ট কর্মকর্তাদের ঘোষণা অনুযায়ী)।
মধুপুর উপজেলায় ৪৫ হাজার ৫৬৫ একর, সখীপুরে ৪৭ হাজার ২২০ একর, ঘাটাইলে ২১ হাজার ৮৫৫ একর, মির্জাপুরে সাত হাজার ৫৭৬ একর এবং কালিহাতীতে ৬৬৯ একর জুড়ে ছিল এই বন। এর মধ্যে ৫৮ হাজার ২০৬ একর সংরক্ষিত বনাঞ্চল হিসেবে ঘোষিত।
বর্তমানে প্রায় ৪০ হাজার একরে প্রাকৃতিক বন রয়েছে। বেদখলে আছে প্রায় ৩৮ হাজার একর। সামাজিক বনায়ন করা হয়েছে প্রায় ২৮ হাজার একরে। এছাড়াও, রাবার বাগান করা হয়েছে ১০ হাজার একরে।
বাকি পাঁচ হাজার একরে শহীদ সালাহউদ্দিন সেনানিবাস, বিমান বাহিনীর ফায়ারিং রেঞ্জ এবং বন গবেষণা ইন্সটিটিউটসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
বন বিভাগ সূত্র জানায়, স্থানীয় ও প্রভাবশালী বহিরাগতদের নির্বিচার গাছ কাটা এবং বনভূমি দখলের কারণে এই বনাঞ্চলের আয়তন দিন দিন কমে যাচ্ছে। তারা বনের জমি দখল করে সেখানে পাকা ঘর-বাড়িসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করেছেন।
প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে দখলদাররা এখানে আনারস, কলা, কুল, পেয়ারা, আম, লেবু, পেঁপে, কচু, হলুদসহ বিভিন্ন ফল ও সবজি বাগান করেছেন। এসব বাগানে ব্যবহৃত মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক ও কীটনাশক পরিবেশের ভারসাম্য ও জীববৈচিত্র ধ্বংস করছে।
বনবিভাগের স্থানীয় কর্মকর্তারা জানান, তারা যখনই এসব জবরদখলকৃত বনভূমি উদ্ধার করতে উদ্যোগী হন, তখনই উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন ক্ষমতাসীন মহল থেকে তাদের কাছে ফোনকল আসে।
যা বলছেন বন কর্মকর্তারা
গত ৬ মে স্থানীয় বন কর্মকর্তারা মধুপুর উপজেলার দোখালা রেঞ্জের হরিণধরা এলাকার গভীর জঙ্গল থেকে পুরাতন শাল (গজারি) গাছের ৪৫টি বড় গুঁড়ি উদ্ধার করেন। এর আগে, ২৬ এপ্রিল সখীপুর উপজেলার বহেরাতৈল রেঞ্জের গড়গোবিন্দপুর থেকে উদ্ধার করা হয় ২০০টি শাল গাছের গুঁড়ি।
মধুপুরের দোখালা রেঞ্জ অফিসার আব্দুল আহাদ দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, স্থানীয় ও বহিরাগতরা বনটি ধ্বংস করে যাচ্ছেন এবং বনের বিপুল পরিমাণ জমি জবরদখলে রেখেছেন। স্থানীয় ক্ষুদ্র ণৃ-গোষ্ঠীর মানুষ অধিকাংশ দখলকৃত বনভূমি স্থানীয় মুসলমানসহ বহিরাগতদের কাছে লিজ দিয়ে রেখেছেন।
তিনি বলেন, ‘একজন স্থানীয় বাসিন্দা একাই মধুপুরে ২৫০ একরের মতো বনভূমি দখলে রেখেছেন এবং সেখানে একটি রাবার বাগান প্রতিষ্ঠা করেছেন।’
আব্দুল আহাদ আরও বলেন, ‘কয়েকমাস আগে স্থানীয় এক গারো নারীর দখলে থাকা বনের একটি জমি উদ্ধারে অভিযান চালানোর প্রতিক্রিয়ায় স্থানীয়রা আমার অফিস ভাঙচুর করে এবং স্থানীয় সহকারী বন সংরক্ষককে তার কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করে রাখে।’
টাঙ্গাইলের সহকারী বন সংরক্ষক (উত্তর) জামাল হোসেন তালুকদার দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, প্রয়োজনীয় জনবল ও লজিস্টিকের অভাব এবং প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপসহ বিভিন্ন কারণে তারা বনটি রক্ষা করতে ব্যর্থ হচ্ছেন।
তিনি বলেন, ‘স্থানীয় ও বহিরাগতদের সিন্ডিকেটগুলো বিভিন্ন জায়গায় বনভূমি দখল করে আনারস, কলা, পেয়ারা, পেঁপেসহ বিভিন্ন ফল ও সবজির চাষ করছেন। স্থানীয়রা এখানে আদৌ বন বিভাগের কর্মকর্তাদের উপস্থিতি চান না।’
জামাল হোসেন তালুকদার আরও বলেন, ‘যখনই আমরা কোনো জবরদখলকৃত বনভূমি উদ্ধার করতে যাই, তখনই সেটা বন্ধ করতে স্থানীয় কায়েমি স্বার্থান্বেষী মহল স্থানীয় ক্ষুদ্র ণৃ-গোষ্ঠীর অধিকারের কথা তোলাসহ বিভিন্ন কুট-কৌশল অবলম্বন করে। এরপরই প্রভাবশালী মহল থেকে ফোনকল আসা শুরু হয়।’
বিভাগীয় বন কর্মকর্তা জহিরুল হক বলেন, ‘বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি আমাদের কাছে বন দখলকারীদের তালিকা চেয়েছিলে এবং আমরা ইতোমধ্যে সেই তালিকা পাঠিয়েছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘মন্ত্রণালয় থেকে ইতোমধ্যে আমাদের এসব দখলকৃত বনভূমি উদ্ধারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে, কোভিড-১৯ পরিস্থিতির কারণে উদ্ধার অভিযান বিলম্বিত হচ্ছে।’
‘তবে বন রক্ষায় এবং জবরদখলকৃত বনভূমি উদ্ধারে সংশ্লিষ্ট সব মহলের সহযোগিতা প্রয়োজন হবে,’ যোগ করেন জহিরুল হক।
স্থানীয়রা কী বলেন
স্থানীয় গারো এবং বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আলীক মৃ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘স্থানীয়রা বনের গাছ কাটেন না। কারণ, বন তাদের কাছে মা তুল্য। তারপরও তাদের বিরুদ্ধে শত শত মিথ্যা বন মামলা দায়ের করা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘স্থানীয়রা বংশ পরম্পরায় তাদের পৈতৃক জমিতে বিভিন্ন চাষবাস করে আসছেন। তবে, নৃ-গোষ্ঠীর অনেকে দারিদ্র্যতার কারণে তাদের জমি অন্যের কাছে লিজ দিয়ে থাকেন।’
‘সম্প্রতি বনবিভাগ মধুপুরের টেলকী গ্রামে নৃ-গোষ্ঠীদের প্রাচীন একটি শ্মশানের জায়গায় প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে আরবোরেটাম বাগান, গেস্ট হাউজ এবং সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করছে। স্থানীয়রা এ ব্যাপারে আপত্তি তুললেও তারা তাতে কর্ণপাত করছেন না,’ বলে অভিযোগ করেন আলীক।
মধুপুরের প্রবীণ গারো নেতা এবং ইউনাইটেড কাউন্সিল অব ইনডিজিনাস অর্গানাইজেশন অব গ্রেটার ময়মনসিংহ অজয়-এ-মৃ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আশির দশকে যখন বন বিভাগ মধুপুরে রাবার বাগান তৈরি শুরু করে, ঠিক তখন থেকেই ব্যাপক বন ধ্বংস শুরু হয়ে যায়।’
তিনি বলেন, ‘এই অঞ্চলের বিস্তৃত এলাকায় প্রাকৃতিক বন উজাড়ের অন্যতম প্রধান কারণ সামাজিক বনায়ন কর্মসূচী। এই সামাজিক বনায়ন কর্মসূচীর আওতায় অনেক প্রভাবশালী মানুষ ও বহিরাগতরা প্লট পেয়েছেন। এটা বহিরাগতদের বন দখল এবং প্রাকৃতিক বন উজাড়ের সুযোগ করে দিয়েছে।’
স্থানীয় গারো নেতা এবং জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি ইউজিন নকরেক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘স্থানীয় নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায় বনভূমি দখলকারী নয়। ১৯২৭ সালে বন আইন প্রবর্তনের অনেক আগে থেকেই তাদের পূর্ব পুরুষরা এই এলাকায় বসবাস শুরু করেন।’
তিনি বলেন, ‘প্রায় ২৫ হাজার নৃ-গোষ্ঠী সদস্যসহ বিপুল সংখ্যক মানুষ মধুপুর বনাঞ্চলের ৪৪টি গ্রামে বসবাস করছে। কর্তৃপক্ষ বনভূমি নিয়ে যে পরিকল্পনাই করুন না কেন, তা স্থানীয়দের স্বার্থ রক্ষা করেই করতে হবে।’
স্থানীয় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নেতারা আরও বলেন, স্মরণাতীতকাল থেকে গারো, কোচ এবং বর্মণরা মধুপুরে বসবাস করে আসছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হয়ে গেলেও এখনো তাদের ভূমি সমস্যার স্থায়ী সমাধান করা হয়নি।
তারা অভিযোগ করেন, উপরন্তু ন্যাশনাল পার্ক, ইকো পার্ক, ইকো ট্যুরিজম, ফায়ারিং রেঞ্জ এবং রিজার্ভ ফরেস্টের নামে বিভিন্ন সরকারের আমলে স্থানীয় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সদস্যদের তাদের ভূমি থেকে উচ্ছেদের ষড়যন্ত্র করা হয়েছে।
তারা চান সমতলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর অধিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠন করা হোক এবং বনে কোনো প্রকল্প বাস্তবায়নের পূর্বে স্থানীয়দের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনা করে নেওয়া হোক।
পরিবেশবিদরা যা বলেন
দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির ফিল্ড ফ্যাসিলিটেটর গৌতম চন্দ্র চন্দ টাঙ্গাইলের শালবন ধ্বংসের জন্য সামাজিক বনায়ন কর্মসূচিকে অন্যতম প্রধান কারণ বলে আখ্যায়িত করেন।
সরকারের সামাজিক বনায়ন কর্মসূচি বন বিভাগ কর্তৃক বরাদ্দকৃত জমিতে যারা বৃক্ষরোপণ, সংরক্ষণ এবং বিকাশে অবদান রাখেন, তাদের জন্য আর্থিক সুবিধা নিয়ে আসে। এসব সুবিধাভোগীরা বনায়ন পরিকল্পনা গ্রহণ এবং প্রয়োগ, বৃক্ষরোপণ ও রক্ষণাবেক্ষণ, বনজ সম্পদ নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা, লভ্যাংশ বিতরণ ও বন কাটতে সক্রিয়ভাবে জড়িত থাকেন।
দ্য ডেইলি স্টার ২০০৭ সালে এক রিপোর্টে উল্লেখ করে যে, সামাজিক বনায়ন কর্মসূচির আওতায় বন বিভাগ বিগত সাত বছরে জেলার হাজার হাজার একর বনভূমি লিজ দিয়েছে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, এই কর্মসূচির আওতায় বনভূমির প্লটগুলো স্থানীয় ভূমিহীন ও দরিদ্র মানুষকে লিজ দেওয়ার কথা থাকলেও, এর বেশির ভাগই প্রভাবশালী এবং বহিরাগতরা মোটা অংকের ঘুষের বিনিময়ে ইজারা পেয়েছেন। কিছু অসৎ বন কর্মকর্তা এসব ইজারা থেকে মোটা টাকা আয় করেছেন।
গৌতম চন্দ্র অধিক হারে গাছ কাটা ও বনভূমি দখলের জন্য বন কর্মকর্তাদের একাংশের অবহেলাকে দায়ী করে বলেন, ‘বিগত ১৪ বছরে পরিস্থিতি খুব কমই বদলেছে।’
এই অঞ্চলের অবশিষ্ট বন রক্ষায় এবং প্রাকৃতিক বন ফিরিয়ে আনতে ভারত এবং নেপালের আদলে স্থানীয়দের অংশগ্রহণে ‘বন গ্রাম’ প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেন এই পরিবেশবিদ।
তিনি প্রাকৃতিক শালবন সংরক্ষণ এবং বনের ওপর নির্ভরশীল মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য ২০১০ সালে বেলার দায়ের করা রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৯ সালের ২৮ আগস্ট উচ্চ আদালতের দেওয়া রায় কার্যকর করারও আহ্বান জানান।
গৌতম চন্দ্র আরও উল্লেখ করেন, ‘রায়ের নয় দফা নির্দেশে মধুপুর শালবন ১৯৫৬ এবং ১৯৮৪ সালের গেজেট নোটিফিকেশন অনুসারে রিজার্ভ ফরেস্টের সীমানা নির্ধারণ অন্তর্ভুক্ত ছিল।’
Comments