ছুটি বাড়ানো ছাড়া শিক্ষা নিয়ে কোনো পরিকল্পনা কেন দৃশ্যমান নয়
করোনাভাইরাস মহামারির শুরুর দিকে গত বছরের ১৭ মার্চ দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে যায়। থমকে যায় শ্রেণিকক্ষে প্রথাগত পাঠদানের বিষয়টি। বিশেষ করে স্কুল পর্যায়ের শিক্ষা তার চিরায়ত ছন্দ হারিয়ে হয়ে পড়ে গৃহবন্দি।
এরপর থেকে নিয়মিত বিরতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের খবর আসছে। চলতি বছর একাধিকবার প্রতিষ্ঠানগুলো খোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও তা বাস্তবায়ন করা যায়নি। সর্বশেষ গত মাসে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি করোনা পরিস্থিতি অনুকূলে থাকার সাপেক্ষে চলতি মাসের ১৩ জুন থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু, বিভিন্ন জেলায় করোনাভাইরাসের ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণের মুখে মন্ত্রণালয় চলমান ছুটি আবার ৩০ জুন পর্যন্ত বাড়িয়েছে।
কিন্তু, বাস্তবতা হচ্ছে, এর মধ্যে শিক্ষার্থীদের জীবন থেকে হারিয়ে গেছে একটা শিক্ষাবর্ষের পুরোটাই। আরেকটি শিক্ষাবর্ষের অর্ধেকটা চলে যাওয়ার পথে। এর মধ্য দিয়ে স্কুল নামের যে বিদ্যায়তনের কাঠামো শিশুদের মনোজগতে ছিল, তা চলে এসেছে অনেকটা বিলীয়মান অবস্থায়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় চার কোটি। দীর্ঘদিন ধরে প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকার কারণে এর বহুমাত্রিক প্রভাব পড়ছে শিক্ষার্থীদের ওপর।
এ সংক্রান্ত বিভিন্ন গবেষণার তথ্যও যার সাক্ষ্য দিচ্ছে। পড়াশোনার ক্ষতির পাশাপাশি ঘরবন্দি শিক্ষার্থীদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে মারাত্মকভাবে।
আপৎকালীন ব্যবস্থা হিসেবে অনলাইনসহ বিভিন্ন মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়ার কিছু উদ্যোগ নেওয়া হলেও তার সুবিধাভোগীদের বেশিরভাগ শহর এলাকার শিক্ষার্থীরা। গ্রাম কিংবা প্রান্তিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা এসব সুবিধা থেকে বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে।
এমন অবস্থায়, করোনা পরিস্থিতি আরও দীর্ঘায়িত হলে দেশের সব পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের সংযুক্ত করে বিকল্প কোন পদ্ধতিতে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়া যেতে পারে? কিংবা এ বিষয়ক পরিকল্পনাই বা কেমন হতে পারে?
এসব কিছু নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যাপক এবং জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য সিদ্দিকুর রহমান এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব এডুকেশনাল ডেভেলপমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক অধ্যাপক মানজুর আহমেদের সঙ্গে।
এ বিষয়ে রাশেদা কে চৌধুরীর অভিমত, শিক্ষার ক্ষতিটা আসলে দৃশ্যমান হচ্ছে না। তিনি বলেন, ‘জীবন-জীবিকা-কর্মসংস্থানের যে ক্ষতি হচ্ছে তা আমরা দেখতে পাচ্ছি চোখের সামনে। তথ্য-উপাত্ত্বেও এটা উঠে আসছে। কিন্তু, শিক্ষা যে কী পরিমাণ ঝুঁকির মুখে পড়েছে, এটা বোধহয় আমরা কেউ অনুধাবন করতে পারছি না। এটা অনুধাবন করতে হবে। বিকল্প ভাবতে হবে।’
রাশেদা কে চৌধুরী আরও বলেন, ‘এর একটি বিকল্প সরকার শুরুতেই শুরু করেছিল। সেটা হচ্ছে সংসদ, টেলিভিশন, অনলাইন, মোবাইল নেটওয়ার্ক ও কমিউনিটি রেডিওর মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা। এটাকে আরও জোরদার করে সবার কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ আমরা সবাই জানি, এটা সবার কাছে পৌঁছাতে পারছে না। বেশিরভাগই বাদ পড়ছে। সেখানে এখন মাধ্যমিকে অ্যাসাইনমেন্টের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সংযুক্ত করার চিন্তা করা হচ্ছে।’
এ ছাড়া যেসব এলাকায় সংক্রমণ ততটা ছড়ায়নি, সেসব এলাকার স্কুল-কলেজ পরীক্ষামূলকভাবে খুলে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই উপদেষ্টা বলেন, ‘সেসব এলাকায় শিক্ষকরা, বিশেষ করে প্রধান শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়ে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছেন, যেসব এলাকায় করোনা সংক্রমণের হার নগণ্য, যেমন: পার্বত্য চট্টগ্রাম, হাওর-বাওড়-চর-চা বাগান অঞ্চল, সেসব এলাকায় পরীক্ষামূলকভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু করা যেতে পারে। অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি মেনে। শিক্ষকরাই এ প্রস্তাব দিচ্ছেন।’
রাশেদা কে চৌধুরী জানান, এ বিষয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সার্ভিলেন্স টিম কাজ করছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে। তবে, তিনি বলেন, ‘দূর দূরান্ত থেকে আমরা খবর পাচ্ছি স্কুল ঘরের ভেতরে গুদামঘর বানানো হয়েছে, জঙ্গল হয়ে আছে। স্যানিটেশনের কোনো ব্যবস্থা নেই। এ বিষয়গুলো দেখতে হবে। খালি নগরে-বন্দরে দৃষ্টি দিলে হবে না।’
কিন্তু, পূর্ব শর্ত হিসেবে শিক্ষকদের টিকা দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করার দাবি জানান এই শিক্ষাবিদ। বলেন, ‘সারাদেশে শিক্ষকের সংখ্যা ১৩ লাখের কাছাকাছি। আমরা তাদের ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারি না। তাই ভ্যাকসিনেশনের ওপরে একটা ড্রাইভ দিতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার প্রস্তুতির ওপর জোর দিতে হবে। এগুলো করতে গেলে শিক্ষায় সরকারের যে বিনিয়োগ সেটা যথার্থ কি না, ভেবে দেখতে হবে। কারণ করোনা পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য শিক্ষায় বরাদ্দ নিয়ে সবাই প্রশ্ন তুলছেন।’
এ ছাড়া বিকল্প হিসেবে এলাকাভেদে বিদ্যালয়ের বর্ষপঞ্জি খানিকটা নমনীয় করা যেতে পারে বলে মত দেন রাশেদা কে চৌধুরী। বলেন, ‘ফ্লেক্সিবল স্কুল ক্যালেন্ডারের ধারণাটা অনেক আগে থেকেই আছে। পরিস্থিতি অনুসারে যেখানে যেমনভাবে প্রয়োজন স্কুল চলবে। কিন্তু, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা এত বেশি কেন্দ্রীভূত যে একজন উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না যে, তিনি স্কুল খুলতে পারবেন কি না। ব্রিটেনে যেমন কাউন্টিগুলো সিদ্ধান্ত নিয়েছে কোথায় স্কুল খোলা যাবে, আর কোথায় যাবে না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমানের পর্যবেক্ষণ, ‘এভাবে চলতে থাকলে দেশ ধ্বংস হয়ে যাবে। বিকল্প কিছু অবশ্যই ভাবতে হবে। কারণ করোনা একেবারেই ছেড়ে গেলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার ভাবনা একটা দূরাশা মাত্র।’
জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান মনে করেন, পরিবেশ যদি উন্নত হয়, মহামারি যদি হ্রাস পায় তাহলে মুখোমুখি শিক্ষা অর্থাৎ ছাত্র-শিক্ষক উপস্থিত থেকে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। তবে, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে কিংবা ভবিষ্যতের কথা বিবেচনায় রেখে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমের পরিসর বাড়াতে হবে। গ্রাম-গঞ্জের কিংবা প্রান্তিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য স্বল্পমূল্যে ইন্টারনেট সংযোগ নিশ্চিত করতে হবে। প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য ডিভাইস সরবরাহ করার ব্যবস্থা করতে হবে।’
একইসঙ্গে মানসম্মত কনটেন্ট তৈরি ও অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ওপর জোর দেন এই শিক্ষাবিদ। পাশাপাশি প্রত্যেক শিক্ষার্থীর হাতে ডিভাইস তুলে দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য তার পরামর্শ হলো, যেসব পরিবারের সামর্থ্য আছে তারা নিজেরা ডিভাইস কিনে নেবে। কিন্তু, তাদের জন্য কম দামে ডিভাইস পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ডিভাইস কেনার জন্য শিক্ষার্থীদের ঋণ দেওয়ার ঘোষণা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের যে অর্থনৈতিক অবস্থা তাতে এই সুবিধা নিয়ে হয়তো অনেকে ডিভাইস কিনবে, আবার অনেকে টাকাটা অন্য কাজে লাগাবে। এ জন্য প্রতিটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ডিভাইসগুলো দিতে হবে। এমনভাবে যাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চাইলে আবার সেটা ফেরত নিতে পারে।’
এর বাইরে প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যায় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য ডিসট্যান্স এডুকেশনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে বলে মত দেন সিদ্দিকুর রহমান। বলেন, ‘সুন্দর উপমা, উদাহরণ দিয়ে মডিউলগুলো এমনভাবে লিখতে হবে যাতে তা শিক্ষার্থীদের জন্য সহজবোধ্য হয়। এক্ষেত্রে একসঙ্গে বেশি কনটেন্ট দেওয়া যাবে না। স্কুল শিক্ষকরা টেলিফোনে খোঁজ রাখবেন। এ জন্য শিক্ষকদের মোবাইল খরচের জন্য একটা মাসিক ভাতা দেওয়া যেতে পারে।’
সিদ্দিকুর রহমানের বক্তব্য, এভাবেই অনলাইনে কিংবা প্রো-মডিউল লেখাপড়ার মতো করেই প্রত্যেক শিক্ষার্থীর পরীক্ষা নিতে হবে। মূল্যায়ণ করতে হবে। কোনোভাবেই অটো প্রমোশন দেওয়া যাবে না।
সিদ্দিকুর রহমানের মতোই অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমের পরিসর বাড়ানো ও এ সংক্রান্ত অবকাঠামো তৈরি ওপর জোর দেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব এডুকেশনাল ডেভেলপমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক অধ্যাপক মানজুর আহমেদ। তিনি বলেন, ‘আমাদের ব্লেন্ডেড অ্যাপ্রোচের দিকে যাওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উদ্যোগ নিয়েছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখনো নেয়নি। এটা নিয়ে খুব তাড়াতাড়ি এগোনো দরকার। প্রতিটা বিভাগ, ইনস্টিটিউটের আলাদা পরিকল্পনা থাকা দরকার। তারা এখন কী করছে এবং সামনে কী করা যায় সে বিষয়ে।’
এ ছাড়া পরিস্থিতি অনুকূলে আসার সঙ্গে সঙ্গেই যাতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুলে দেওয়া যায়, তার জন্য আগাম প্রস্তুতি হিসেবে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের টিকাদানের বিষয়টি নিশ্চিত করার জোর তাগিদ দেন অধ্যাপক মানজুর। বলেন, ‘সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের টিকা দেওয়ার কথা ভাবছে। এটা খুব দ্রুততার সঙ্গে বিশেষ একটা উদ্যোগ নিয়েই করতে হবে।’
একইসঙ্গে পরিস্থিতি বুঝে এলাকাভেদে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের কিছু স্কুল খুলে দেওয়ার পরামর্শ দেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক। বলেন, ‘প্রথম পর্যায়ে এলাকাভিত্তিক র্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্টের মাধ্যমে যাচাই করে সুরক্ষাবিধি মেনে কিছু সংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের সঙ্গে স্কুল কর্তৃপক্ষের সমন্বয়ের ভিত্তিতে কাজটি করতে হবে। এরপর পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে ধাপে ধাপে ব্যবস্থা নিতে হবে। কারণ অনির্দিষ্টকাল তো সবকিছু বন্ধ করে রাখা যায় না।’
এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের ক্ষতি কিছুটা হলেও পুষিয়ে নেওয়ার জন্য শিক্ষাবর্ষ পরিবর্তনের পক্ষে মত দেন অধ্যাপক মানজুর। বলেন, ‘সবকিছুর সঙ্গে শিক্ষাবর্ষটা চেঞ্জ করা দরকার। সেপ্টেম্বর থেকে জুনের দিকে নিয়ে যাওয়া দরকার। বর্তমান শিক্ষাবর্ষ আগামী বছরের জুন পর্যন্ত এক্সটেন্ড করে দিলে ক্ষতি কিছুটা হলেও কাভার করা যাবে।’
Comments