মুক্তিযুদ্ধ

১২ জুন ১৯৭১: বাংলাদেশ হবে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র: বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ১২ জুন গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ দূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী লন্ডনে সাংবাদিকদের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, 'যারা আমাদের শিশু ও মহিলাদের খুন করছে তাদের আমরা কোনোদিন ক্ষমা করতে অথবা তাদের অপরাধ ভুলে যেতে পারবো বলে কি মনে করেন? নিশ্চয় না। এই গণহত্যার পর দেশের দুই অংশের একসাথে থাকার আর কোনো প্রশ্নই উঠে না।

বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বলেন, পূর্ব বাংলার জনগণ এখন একটি মাত্র সমাধান মেনে নিতে পারে, তা হলো, পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য নির্বাচিত প্রতিনিধিকে মুক্তিদান এবং স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠনের জন্য তাদের একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করতে দেয়া। তিনি বলেন, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে নিশ্চয়ই টিকবে এবং বাংলাদেশ হবে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, পাকিস্তানের মতো এক ধর্মীয় রাষ্ট্র নয়। আমার বিশ্বাস, ধর্ম ব্যক্তিগত বিষয় হিসেবে গণ্য হবে এবং সরকার হবে ধর্মনিরপেক্ষ।'

আন্তর্জাতিক মহলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিবৃতি

১২ জুন মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী জোসেফ সিসকো বলেন, 'পূর্ব বাংলা থেকে দেশত্যাগকারী শরণার্থীদের প্রবেশ বন্ধ করতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন রাজনৈতিক সমঝোতা ও তাদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা।'

ফ্রান্সের প্যারিসে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং ও ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শুমার মধ্যে বাংলাদেশের উদ্বাস্তু পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। প্রায় ৫০ মিনিটের এই বৈঠকে শরণার্থীদের নানা সমস্যা, স্বদেশে প্রত্যাবর্তনে করণীয়সহ নানা বিষয়ে আলোচনা হয়।

১২ জুন পাকিস্তান সফররত ব্রিটিশ পার্লামেন্টারি প্রতিনিধি দলের সদস্য জেম কি ইর্ডার বলেন, 'এটা এখন পরিষ্কার যে উদ্বাস্তুদের ফেরার পথ সুগম করার জন্য পূর্ব পাকিস্তানে অবশ্যই স্বাভাবিক অবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতেই হবে। এখন ব্রিটিশ জনগণ ও সরকার পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতিতে ভীষণ উদ্বিগ্ন।'

১২ জুন পাকিস্তান সফররত ব্রিটেনের সংসদীয় প্রতিনিধিদলের সদস্য ও ব্রিটিশ এমপি জে কিসপেডার ইসলামাবাদে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পথ সুগম করতে অবশ্য পূর্ব পাকিস্তানে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে।

১২  জুন বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে জনমত গঠনের লক্ষ্যে ভারতের সর্বোদয় পার্টির নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ নিউইয়র্কে জাতিসংঘ ভবনের সামনে এক জনসমাবেশে বলেন, 'এখনো সময় আছে, বাংলাদেশের সমস্যা সমাধানে বিশ্বের নেতারা এগিয়ে না এলে উপমহাদেশজুড়ে সৃষ্ট অশান্তি সারা বিশ্বকে অস্থির করে তুলবে। এদিন সমাবেশের আগে ‘বাংলাদেশ বাঁচাও’কমিটির উদ্যোগে বহু মানুষ নিউইয়র্ক শহর থেকে মিছিল করে এসে এ সমাবেশে যোগ দেন। অন্যদিকে তারা এদিন পাকিস্তানি মিশনের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন।

১২ জুন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন মুখপাত্র সাংবাদিকদের বলেন, 'ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার পরিস্থিতি এখন প্রচণ্ড বিপজ্জনক হয়ে ঝুলছে। দুদিক থেকেই ক্রমাগত উত্তেজনা ছড়ানো হচ্ছে।'

ভারতে এদিন

১২ জুন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আসামের কাছাড় সফর শেষে সাংবাদিকদের বলেন, 'বাংলাদেশে যা হচ্ছে এবং ঘটে চলেছে এটিকে কোনোভাবেই পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলা যানা। বাংলাদেশের ঘটনার ব্যাপারে পুরো বিশ্ব আজ সজাগ হয়েছে। এটি এখন আর রাজনৈতিক সমাধানের মধ্যে নেই।'

১২ জুন এক বিজ্ঞপ্তিতে ভারত সরকার জানায় ভারতের বিভিন্ন আশ্রয় শিবিরে ঠাঁই নেয়া বাংলাদেশের শরণার্থী সংখ্যা ৫৮ লাখ ৬৭ হাজার ১৭২ এ পৌঁছেছে।

১২ জুন ভারতের নৌবাহিনীর প্রধান অ্যাডমিরাল এস এম নন্দ বেঙ্গালুরুতে এক কুচকাওয়াজে বলেন, 'পূর্ব বাংলার প্রসঙ্গে পাকিস্তানের দিক থেকে আমাদের উপর যে কোনো চ্যালেঞ্জ আসতে পারে। এ চ্যালেঞ্জের বিরুদ্ধে লড়তে নৌ ও বিমানসেনাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। আমাদের দেশ এখন খুব সংকটজনক অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দেশব্যাপী শান্তি শৃঙ্খলার জন্য দেশের মানুষ আমাদের প্রতিরক্ষা বাহিনীর দিকেই তাকিয়ে আছে প্রধানমন্ত্রী হুঁশিয়ারি করে দিয়ে বলেছেন, ভারত এখন যে কোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুত। আমাদের সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ

১২ জুন লন্ডনের "অবজারভার" পত্রিকা এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে জানায়, 'পূর্ব পাকিস্তান থেকে এক কোটি হিন্দুকে তাড়ানো হয়েছে। এখন ভারতীয় উপমহাদেশে যে কোন মুহূর্তে পুরোপুরি অঞ্চলভিত্তিক যুদ্ধ লেগে যেতে পারে। পাকিস্তান যদি এই অন্যায় আচরণ বন্ধ না করে তবে দেখা যাবে নয়াদিল্লির অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাকে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে হচ্ছে।'

১২ জুন টাইম সাময়িকীতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, 'পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্ব বাংলায় নির্বিচার গণহত্যা চালিয়েই যাচ্ছে। পূর্ব বাংলা থেকে একজন ব্রিটিশ নাগরিক আমাদের একটি চিঠি পাঠিয়েছেন। সেই চিঠিতে আমরা দেখতে পাচ্ছি, গণহত্যার প্রত্যক্ষ বিবরণ রয়েছে। পুরুষদের নির্মমভাবে হত্যা করে নারী ও শিশুদের ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে এখন।

১২  জুন ইউএনআই এক প্রতিবেদনে বলে, ‘সারা বাংলাদেশ জুড়ে শেখ মুজিবের মুক্তিফৌজ গেরিলা তৎপরতা বৃদ্ধি করেছে বলে সীমান্তের ওপারে মুক্তিবাহিনীর কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে খবর এসেছে। সীমান্তের ওপার থেকে জানা গেছে, মুক্তিফৌজ পাকিস্তান ন্যাশনাল ব্যাংক, হাবিব ব্যাংক লিমিটেড, মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংক, জজ কোর্ট এবং টাউন হল ভবনে গ্রেনেড আক্রমণ চালায়। গেরিলা বাহিনী কুমিল্লা শহরের দক্ষিণাঞ্চলে একটি রেল ইঞ্জিন উড়িয়ে দিয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’

আখতার সোলায়মানের বিবৃতি

১২ জুন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কন্যা বেগম আখতার সোলায়মান বাংলাদেশের সীমান্ত পার হয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়া সকল এমএনএ এবং এমপিএ-দের গভর্নর জেনারেল টিক্কা খানের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার সুযোগ গ্রহণ করে নিজ নিজ এলাকায় প্রত্যাবর্তন করার আহ্বান জানান।

দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ

১২ জুন টাঙ্গাইলে কালিহাতীর বল্লায় কাদেরিয়া বাহিনীর সাথে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর তুমুল সংঘর্ষ হয়। এতে ৪ জন হানাদার সেনা নিহত হয়। এই সময় হানাদার বাহিনী প্রচুর ক্ষতি স্বীকার করে পিছু হটে।

১২ জুন সিলেটের এনায়েতপুরে মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে হানাদার বাহিনীর ব্যাপক ক্ষতি হয়।

১২ জুন নওগাঁয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচন্ড সংঘর্ষ হয়।

তথ্যসূত্র-

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র অষ্টম, নবম, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড

দৈনিক পাকিস্তান, ১৩ জুন ১৯৭১

দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা, ১৩ জুন ১৯৭১

আহমাদ ইশতিয়াক [email protected]

 

Comments

The Daily Star  | English

US retailers lean on suppliers to absorb tariffs

Rather than absorbing the cost or immediately passing it on to consumers, many US apparel retailers and brands have turned to their suppliers in Bangladesh, demanding they share the pain

5h ago