প্রবাসে

বলকানের বিস্ময় নিশের পথে-প্রান্তরে

সুবোটিচা থেকে নিশ যাওয়ার পথে রাস্তার দুই ধারে এমন দৃশ্য চোখে পড়বে। ছবি: রাকিব হাসান রাফি

তুরস্কের পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত ইস্টার্ন থ্রেস থেকে শুরু করে সার্বিয়া পর্যন্ত বিস্তীর্ণ দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের এক সুবিশাল অঞ্চলকে সামগ্ৰিকভাবে বলকান অঞ্চল হিসেবে অভিহিত করা হয়। তুরস্কের ইস্টার্ন থ্রেস ও সার্বিয়া ছাড়াও বুলগেরিয়া, মেসিডোনিয়া, গ্রিস, বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা, মন্টিনিগ্রো, আলবেনিয়া, ক্রোয়েশিয়া ও কসোভোসহ হাঙ্গেরি ও রোমানিয়ার অংশবিশেষ নিয়ে গঠিত হয়েছে এ বলকান অঞ্চল। স্থানীয় বলকান পর্বতমালার নাম অনুসারে এ অঞ্চলটিকে "বলকান" নামে ডাকা হয়। যদিও স্থানীয় ভাষায় স্লাভরা এ পর্বতমালাকে "স্টারা প্ল্যানিনা" নামে ডেকে থাকে।

আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের চোখে ইউরোপ মহাদেশের সীমানা কেবলমাত্র জার্মানি, ফ্রান্স, ব্রিটেন, সুইডেন, নরওয়ে, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডস, ফিনল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, ইতালি, স্পেন কিংবা অস্ট্রিয়ার মতো কয়েকটি উন্নত দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তাই হঠাৎ করে যদি বলকান উপদ্বীপের কোনো দেশে বেড়াতে আসেন রীতিমতো তার চোখ কপালে উঠবে। বলকান অঞ্চলটিকে ইউরোপের সবচেয়ে দরিদ্র অঞ্চলগুলোর একটি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অনুন্নত অবকাঠামো, দুর্নীতি ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, জীর্ণশীর্ণ রাস্তাঘাঁট এ সব কিছু যেন এ অঞ্চলের মানুষের নিত্যদিনের সঙ্গী।

তারপরেও একটি কারণে বলকান উপদ্বীপের এ দেশগুলো আমাকে বারবার আকর্ষণ করে। সেটি হচ্ছে এ অঞ্চলের ভূ-প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। তাই হাঙ্গেরি ও সার্বিয়ার সীমান্তবর্তী শহর সুবোটিচা থেকে যখন সার্বিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম শহর নিশের দিকে যাত্রা শুরু করি রাস্তার দু ধারের দৃশ্য থেকে চোখ সরাতে পারিনি এক সেকেন্ডের জন্যও। এ সৌন্দর্য ইউরোপ তো বটেই পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, যেন আপনার মনে হবে কোনো এক শিল্পী তার সুনিপুণ তুলির আঁচড়ে পুরো বলকান পেনিনসুলাকে সাজিয়েছেন।

ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত যে কোনও দেশের বৈধ ভিসা কিংবা রেসিডেন্ট পারমিট থাকলে কোনো ধরনের ভিসা ছাড়া সার্বিয়া ভ্রমণ করা যায়। সার্বিয়াতে প্রবেশের সময় সেখানকার ইমিগ্রেশনের পক্ষ থেকে কেবলমাত্র পাসপোর্টে একটি অ্যারাইভাল সিল দেওয়া হয়। বিপরীতে সার্বিয়া থেকে যখন অন্য কোনো দেশে প্রবেশ করা হয় তখন পাসপোর্টে একটি ডিপার্চার সিল দেন।

এয়ারবিএনবির সাহায্যে আগের থেকে থাকার জায়গা ঠিক করে রেখেছিলাম। নিশের সিটি সেন্টারের কাছে সেডমগ ইউলা নামক এক জায়গায় এক রাত থাকার জন্য একটি রুম ভাড়া করেছিলাম। যার থেকে এ রুমটি ভাড়া নিয়েছিলাম তার নাম মিলান গোলুবোভিচ। মিলান নিশের স্থানীয় অধিবাসী। এক রাত থাকার জন্য আমাকে ১৫ ইউরো গুনতে হয়েছিল।

মিলান আমাকে আগের থেকেই জানিয়ে রেখেছিল আমাকে রিসিভ করার জন্য তিনি নিশের বাস স্টেশনে অপেক্ষা করবেন। তাই সুবোটিচা থেকে যখন নিশের উদ্দেশ্যে আমাদের বাসটি ছেড়ে গেল কিছুক্ষণ পর পর মিলান মেসেজের মাধ্যমে আমার সর্বশেষ অবস্থান সম্পর্কে জানার চেষ্টা করছিলেন। বাসের ভেতর ফ্রি ওয়াইফাই থাকায় মিলানের সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে আমার তেমন একটা বেগ পেতে হয়নি। সুবোটিচা থেকে বাসে নিশ পর্যন্ত পৌঁছাতে প্রায় সাত ঘণ্টা সময় লেগেছিল, এতো লম্বা সময় জার্নি করার পর শরীর ক্লান্ত থাকবে স্বাভাবিক। তাই হালকা ফ্রেশ হয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। মিলান আমার জন্য অবশ্য হালকা জলখাবারের ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। 

পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠতে না উঠতে দেখি মিলান আমার জন্য সকালের নাস্তা নিয়ে অপেক্ষা করছেন। আমার জন্য তিনি বুরেক নিয়ে এসেছিলেন। বলকান দেশগুলোর মানুষের কাছে একটি জনপ্রিয় খাবারের আইটেম হচ্ছে বুরেক। বুরেককে পাই কিংবা আমাদের দেশের জনপ্রিয় ফাস্টফুড আইটেম পেটিসের সাথে তুলনা করা যেতে পারে।

বলকান অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী খাবার বুরেক, তবে অন্যান্য অঞ্চলের বুরেকের তুলনায় নিশের বুরেক একেবারে আলাদা ছবি:-মার্কো ইয়াভানোভিচ

বিভিন্ন ধরনের বুরেক রয়েছে, যেমন- চিজ বা পনিরের বুরেক, স্পিনাচ বা পালং শাকের বুরেক, মাংসের কিমার বুরেক ইত্যাদি। বুরেকের জন্য নিশ গোটা বলকান অঞ্চলে বেশ প্রসিদ্ধ এবং বেশিরভাগ সার্বিয়ানদের মতে সমগ্র বলকান অঞ্চলে সবচেয়ে ভালোমানের বুরেক তৈরি হয় নিশে। স্থানীয়ভাবে যাকে “নিস বুরেক” হিসেবে অভিহিত করা হয়। সকালের নাশতা শেষ করে মিলানের সাথে বেরিয়ে পড়লাম শহর ঘুরে দেখার জন্য।

মিলান অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ, তাই তিনি শুরুটা করলেন নিশের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ অর্থোডক্স চার্চ হলি ট্রিনিটি ক্যাথেড্রাল দিয়ে।

সার্বিয়ার বেশিরভাগ মানুষ খ্রিস্ট ধর্মে বিশ্বাসী। বাইজেনটাইন সাম্রাজ্যের আধিপত্যের কারণে সার্বিয়াতে ক্যাথলিক চার্চের তুলনায় অর্থোডক্স চার্চের বিস্তৃতি ঘটেছে অনেক বেশি। ঢাকা শহরে যেমন কয়েক গজ ব্যবধানে মসজিদের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় ঠিক তেমনি সার্বিয়াতে কয়েক গজ পার হতে না হতেই চোখের সামনে ভেসে উঠে ছোটো বড় বিভিন্ন আয়তনের চার্চ। দেশটির রাজনীতিতে অর্থোডক্স চার্চের প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি প্রতিবেশি দেশ মন্টিনিগ্রোসহ অর্থোডক্স ভাবাদর্শের দেশগুলোতে সার্বিয়ান অর্থোডক্স চার্চের শক্তিশালী প্রভাব রয়েছে। 

নিশাভা নদীর নাম অনুসারে শহরটির নাম রাখা হয়েছে "নিশ"। বাইজেনটাইন সম্রাট প্রথম কনস্টানটিন এ শহরটির গোড়াপত্তন করেন। রোমান সাম্রাজ্য বলতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমরা ইতালির রাজধানী রোমকে বুঝি অথচ শুনে অবাক হবেন যে রোমান সাম্রাজ্যের আঠারো জন শাসকের জন্ম হয়েছিল সার্বিয়াতে। বিখ্যাত রোমান সম্রাট কনস্টান্টিনের জন্ম হয়েছিল নিশে।

বিখ্যাত বাইজেনটাইন সম্রাট কন্সটান্টিনের জন্ম হয়েছিল নিশ শহরে।

পৃথিবীর প্রত্যেক শহরের একটি নিজস্ব ল্যান্ডমার্ক থাকে, এ ল্যান্ডমার্ক দিয়ে শহরটিকে পৃথিবীর অন্যান্য শহরের থেকে আলাদা করা হয় এবং বলাবাহুল্য এ ল্যান্ডমার্কটি মূলত শহরটির প্রতিনিধিত্ব করে। নিশ শহরের ল্যান্ডমার্ক হচ্ছে নিশ ফোরট্রেস। একেবারে নিশাভা নদীর পার ঘেঁষেই এ ফোরট্রেসটি নির্মাণ করা হয়েছে। অটোমান শাসনামলে নির্মিত এ ফোরট্রেসটি সত্যি অসাধারণ স্থাপত্য কলার এক অনন্য নিদর্শন।

অটোমান শাসনামলে নির্মিত বালি-বেগ মসজিদ, বর্তমানে যাদুঘর ও আর্ট গ্যালারিতে রূপ দেওয়া হয়েছে।

নিশ ফোরট্রেস থেকে ভেতরের দিকে একটু পা বাড়ালেই দেখা মিলবে অটোমান সাম্রাজ্যের শাসনামলে নির্মিত বালি বেগ মসজিদ। বর্তমানে অবশ্য মসজিদটি পরিত্যক্ত, সার্বিয়ার সরকার সংস্কারের মাধ্যমে মসজিদটিকে আর্ট গ্যালারির রূপ দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। বালি বেগ মসজিদের পাশাপাশি অটোমানদের সময়ে নির্মিত অনেক নিদর্শনও আপনি এখানে খুঁজে পাবেন। বর্তমানে অবশ্য সরকারিভাবে নিশে কেবলমাত্র একটি মসজিদ রয়েছে, ১৭২০ সালে নির্মিত এ মসজিদটির নাম ইসলাম আগা মস্ক। তবে ২০০৪ সালে এক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ফলে মসজিদটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, পরবর্তীতে ২০১৩ সালে সংস্কারের মাধ্যমে মসজিদটিকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হয়।

নিশ ফোরট্রেস থেকে আমরা স্কাল টাওয়ারের দিকে ছুটে গেলাম, মূলত এ স্কাল টাওয়ার দেখার উদ্দেশ্যে বেশিরভাগ দর্শনার্থী নিশে হাজির হন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নিশ ও এর আশেপাশের অঞ্চলে যারা নিহত হয়েছিলেন তাদের স্মরণে বুবানি ন্যাশনাল পার্কে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভ।

স্কাল টাওয়ার থেকে আমাদের গন্তব্য ছিল বুবানি ন্যাশনাল পার্ক। নিশের দক্ষিণ-পশ্চিমে নিশ ও স্কুপিয়ের সংযোগ সড়কে এর অবস্থান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের নাৎসি বাহিনী নিশ ও এর আশেপাশের অঞ্চলগুলোতে প্রায় দশ থেকে বারো হাজার মানুষের প্রাণহানী হয়েছিল। বুবানির এ স্থানটি ছিল মূলত একটি এক্সিকিউশন স্কোয়াড যেখানে তাদের হত্যা করা হয়েছিল ও তাদের মৃতদেহকে গণকবর দেওয়া হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নিহতদের স্মরণ করতে পরবর্তীতে ১৯৬৩ সালে এখানে একটি মেমোরিয়াল কমপ্লেক্স তৈরি করা হয়েছে।

নিশের সিটি সেন্টারটি আয়তনে খুব বড় না হলেও অত্যন্ত পরিপাটি। সার্বিয়াতে সিরিলিক এবং ল্যাটিন দুই ধরনের বর্ণমালা ব্যবহৃত হয়।

কিং মিলান’স স্কয়ার

নিশের সিটি সেন্টারের মূল চত্বরভূমিটি প্রাথমিকভাবে “কিং মিলান’স স্কয়ার” নামে পরিচিত। ১৮৬৮ সাল থেকে ১৮৮৯ সাল পর্যন্ত সার্বিয়ার শাসনভার তার অধীনে ন্যস্ত ছিল। তার হাত ধরে সার্বিয়া অটোমান সাম্রাজ্যের থেকে স্বাধীনতার স্বাদ পায়। নিশের সিটি সেন্টারে তার স্মরণে একটি ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে। কিং মিলান’স স্কয়ার থেকে সামান্য কয়েক গজ হাঁটলে “স্টেভান স্রেমাক অ্যান্ড কালচা মনুমেন্ট” নামে আরও একটি বিখ্যাত ভাস্কর্য দেখতে পাবেন। দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপে স্টেভান স্রেমাক একজন জনপ্রিয় লেখক হিসেবে পরিচিত। আর কালচা হচ্ছে স্টেভান স্রেমাক রচিত বিখ্যাত উপন্যাস “ইভকোভা স্লাভা” এর অন্যতম আলোচিত চরিত্র। দীর্ঘ প্রায় সাড়ে চারশো বছরের অটোমান শাসন সার্বিয়ার স্থানীয় হস্তশিল্প ও সিরামিক শিল্পকে করেছে অত্যন্ত সমৃদ্ধ। নিশের সিটি সেন্টারের উপকণ্ঠে অবস্থিত টিংকারস অ্যালে নামক সড়কটি অটোমান শাসনামলে দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপে কারুশিল্পের জন্য এক প্রসিদ্ধ স্থান হিসেবে গড়ে উঠেছিল।

বলকান উপদ্বীপের দেশগুলোতে পরিবার প্রথা এখনও জোরালোভাবে প্রচলিত। আরেকটি জিনিস, সার্বিয়া কিংবা বলকান রাষ্ট্রগুলোতে আপনি যদি জুতা পায়ে কারও ঘরে প্রবেশ করেন তাহলে এ বিষয়টিকে সেখানকার মানুষ স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করবেন না। আপনাকে জুতা খুলে বাইরে রাখতে হবে অথবা আপনার জুতা খুলে হাতে নিয়ে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করতে হবে।  

বলকান অঞ্চলের ভূ-প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যে কতোটা অনন্য সাধারণ সেটা নিশে না এলে কোনও দিনও বুঝতাম না। বলকান উপদ্বীপের সৌন্দর্য যিনি অবগাহন করতে পেরেছেন তিনি কোনও দিনও তা ভুলতে পারবেন না। এজন্য মিলান কয়েক বারের চেষ্টার পরও ডেনমার্কে গিয়ে থিতু হতে পারেনি, তাকে ফিরে আসতে হয়েছে নিশের ভূ-প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের টানে। সার্বিয়ার প্রতি আমার দৃষ্টিভঙ্গি বন্ধুর হলেও নিশের প্রতি আমি সব সময় দুর্বল। সত্যি আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর শহরগুলোর মধ্যে নিশ একটি।

লেখক: রাকিব হাসান রাফি, শিক্ষার্থী, ব্যাচেলর অব সায়েন্স ইন ফিজিক্স অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া।

Comments

The Daily Star  | English

Teknaf customs in limbo as 19 mt of rice, authorised by AA, reaches port

The consignment of rice weighing 19 metric tonnes arrived at Teknaf land port on Tuesday evening with the documents sealed and signed by the Arakan Army

4h ago