অক্সিজেনের অভাবে মানুষ মারা যাচ্ছে আর স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলছেন ‘চিন্তা করবেন না’
* আমাদের নিয়মই হচ্ছে, যেখানে বেশি সংক্রমণ, সেটা নিয়ে হইচই করা, আর অন্যসব পিছিয়ে যাওয়া।
* স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে বায়বীয় কথা না বলে সুনির্দিষ্ট করে তথ্য দিতে হবে।
* পরামর্শক কমিটি শুধু পরামর্শ দিতে পারে, না মানলে কৈফিয়ত নিতে পারে না।
* অধিক ও স্বল্প সংক্রমিত— দুই এলাকাতেই মনোযোগী হতে হবে।
* পরিকল্পনায় চরম উদাসীনতা দেখা যাচ্ছে।
* আগামী ১৪-২৮ দিন পর দেশের অন্যান্য জায়গাতেও ডেলটা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ দেখা যাবে।
দেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে করোনার সংক্রমণ দ্রুত গতিতে বাড়ছে। দেরিতে হলেও সেখানকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু, সেসব এলাকার বাইরে অন্য অঞ্চলগুলো নিয়ে তেমন কোনো ভাবনা বা পরিকল্পনা পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
অন্য অঞ্চলগুলো কি তাহলে আড়ালে চলে যাচ্ছে? এতে কি পুরো করোনা মোকাবিলার কাজটা সমন্বিত হচ্ছে? অন্য এলাকাগুলোতে কি সংক্রমণ বাড়ার পর সেটা নিয়ে ভাবা হবে? কারিগরি কমিটি পরিস্থিতি বিবেচনায় নানা ধরনের পরামর্শ দিচ্ছে। সেগুলো তারা মূলত কাকে দিচ্ছে? পরামর্শগুলো কি মানা হচ্ছে? মানা না হলে সেটা নিয়ে জানতে চাওয়া হয় কি না?
দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম, কমিটির আরেক সদস্য ও বাংলাদেশ ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. একে আজাদ খান এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (রোগনিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক বে-নজির আহমেদের সঙ্গে।
অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের একটা নিয়মই হচ্ছে, যেখানে বেশি সংক্রমণ হচ্ছে, সেটা নিয়ে হইচই করা, আর অন্যসব পিছিয়ে যাওয়া। সীমান্তবর্তী এলাকা নিয়ে আমাদের উদ্যোগের যথেষ্ট ঘাটতি ছিল। যদিও সরকার বলেছে যে আমরা সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছি। তবে, এটা ছিল কথার কথা, কাগজে-কলমে। সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়া মানে কি প্রাচীর বা কাঁটাতার দিয়ে দেওয়া? এই বন্ধ মানে যারা পাসপোর্ট নিয়ে আসবে তাদের কোয়ারেন্টিন করা। সেই ব্যবস্থাও যে খুব ভালো ছিল, তা নয়। কোয়ারেন্টিন থেকে পালিয়ে গেছে, সেটা আমরা দেখেছি। কিন্তু, বিনা পাসপোর্টে যে সীমান্ত দিয়ে মানুষ যাওয়া-আসা করে, সেটা বন্ধ হয়নি। সুতরাং ভারতীয় ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট আমাদের দেশে এসেছে।’
সীমান্তবর্তীসহ অন্যান্য জেলাগুলোতে এখনো কেন আইসিইউ হলো না? প্রশ্ন রেখে তিনি আরও বলেন, ‘রাজশাহীতে হাসপাতালে শয্যা নেই। সাতক্ষীরাতেও একই অবস্থা। রাজশাহী, সাতক্ষীরায় তাও আইসিইউ ব্যবস্থা আছে। কিন্তু, অন্য জেলাগুলো সেটাও নেই। যেটা করা উচিত ছিল। গত বছরের জুনে প্রধানমন্ত্রী জেলা পর্যায়ে আইসিইউর ব্যবস্থা করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেই ব্যবস্থাটা স্বাস্থ্য বিভাগ এখনো করতে পারেনি। তারা মনোযোগী হলে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর অবস্থা এতটা খারাপ হতো না। তারা বলে একদিনেই আইসিইউ করা সম্ভব না। কিন্তু, এটা তো একদিন নয়, এক বছর। কাজ তো করতে হবে। কী কাজ চলছে? অগ্রগতি কতটুকু? তারা বলে, কাজ শুরু করেছে। কিন্তু, তারা তো কাজে হাতই দেয়নি। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা গায়েই না মাখলে দেশটা চলবে?’
অক্সিজেন বিষয়ে অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আইসিইউ করতে গেলে সেখানে অক্সিজেনের সার্বক্ষণিক সরবরাহ থাকতে হবে। এখন কি আমাদের এই ব্যবস্থা আছে? সীমান্তবর্তী জেলা-উপজেলায় কয়টা হাসপাতালে এই ব্যবস্থা আছে? স্বাস্থ্য অধিদপ্তর যদি এটা না করে, তাহলে উন্নতি হবে কী করে? স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, “অক্সিজেন নিয়ে আপনারা চিন্তা করবেন না।” ভ্যাকসিন নিয়েও এটা বলা হয়েছিল। এখন পরিস্থিতি কী হয়েছে? ভারত থেকে আমরা ২০ শতাংশ অক্সিজেন আমদানি করতাম। ভারত সেটা বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ২০ শতাংশ ঘাটতি হয়ে গেল। সেটার জন্যে কী ব্যবস্থা নেওয়া হলো? “আপনারা চিন্তা করবেন না” মানে কী বোঝাতে চাচ্ছে? এভাবে বায়বীয় কথা না বলে সুনির্দিষ্ট করে তথ্য দিতে হবে। কী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, কারা কতটুকু উৎপাদন করছে, সেটা কীভাবে সারাদেশে সরবরাহ করা হবে, সেটা জানাতে হবে। কথা পেটের মধ্যে রেখে দিলে তো হবে না। আমরা অক্সিজেন নিয়ে চিন্তা করব না, পরে দেখব এটার অভাবে লোক মারা যাচ্ছে। এখনই তো সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে অক্সিজেনের অভাবে লোক মারা যাচ্ছে। অথচ মন্ত্রী বলছেন চিন্তা না করতে। তাহলে কেন মানুষ মারা যাচ্ছে? এর উত্তর তো মন্ত্রীকে দিতে হবে।’
সীমান্তবর্তী জেলার বাইরের পরিস্থিতি নিয়ে তিনি বলেন, ‘সীমান্তবর্তী জেলাগুলো নিয়ে এখন তারা ভাবছে। কিন্তু, অন্য জেলাগুলো নিয়ে ভাবছে কি না, এই প্রশ্নটা সংশ্লিষ্টদের করতে হবে। যদি তাদের সক্ষমতার অভাব হয়, তাহলে ক্রাশ প্রোগ্রাম নিতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর একা না পারলে অন্যদের কাছে সহায়তা চাইতে হবে, তাহলে তো তারা সেটা করতে পারবে। প্রয়োজনে অবসরে যাওয়া বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটা প্যানেল করতে হবে। তাদেরকে জেলা অনুযায়ী দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া যায়। শুধু চেয়ারে বসে থাকলে তো হবে না। চেয়ারে বসে থাকার সুযোগ নেই। দেশে মহামারি চলছে। আমাদেরকে কাজ করতে হবে।’
পরামর্শক কমিটির দেওয়া পরামর্শ মানার বিষয়ে কমিটির এই সদস্য বলেন, ‘আমরা আমাদের পরামর্শগুলো মূলত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে দিয়ে থাকি। সেগুলো যথাযথভাবে মানা হচ্ছে বলে আমার মনে হচ্ছে না। মানলে তো সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে এই পরিস্থিতি তৈরি হতো না। অনেকে ভাবে আমরা পরামর্শ দিলে সেগুলো না শুনলে আমরা তাদের কাছে প্রশ্ন করতে পারি। কিন্তু, আমরা শুধু পরামর্শ দিতে পারি, কৈফিয়ত নিতে পারি না। আমাদের সেই ক্ষমতা নেই। অদ্ভুত একটা জিনিস। ওরা বলছে, আপনার কাজ পরামর্শ দেওয়ার, সেটা দিয়েছেন, ব্যাস। আপনি এখন চুপ করে বসে থাকেন। এখন আর কিছু বলতে পারবেন না। সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে যে, তাদের কৈফিয়ত কেউ নিতে পারবে না।’
অধ্যাপক ডা. একে আজাদ খান বলেন, ‘সীমান্তবর্তী এলাকায় সংক্রমণ বেশি হচ্ছে। বর্তমানে যে ভারতীয় ডেলটা ভ্যারিয়েন্টটা ছড়াচ্ছে, সেটা অত্যন্ত সংক্রামক ও মারাত্মক। করোনা নিয়ে যেমন চিন্তা থাকবে, তেমনি মানুষের জীবন-জীবিকা নিয়েও চিন্তা থাকতে হবে। যেসব এলাকাগুলোতে সংক্রমণ বেশি, সেখানে বেশি মনোযোগ দিতে হবে। কিন্তু, বাকি এলাকাগুলো এর আওতার বাইরে থাকবে না। সেগুলোতেও মনোযোগ দিতে হবে। মানে সব এলাকাতেই মনোযোগ দিতে হবে।’
‘যেখানে সংক্রমণ বাড়ছে, সেখানে কঠোর লকডাউন দিতে হবে। যাতে সেখান থেকে মানুষ অন্য জেলায় যেতে না পারে। ফলে অন্য জেলাতে তা ছড়াবে না। পাশাপাশি অন্য জেলার পরিস্থিতি নিয়েও মনোযোগী থাকতে হবে। সেখানকার পরিস্থিতিও পর্যবেক্ষণ করতে হবে। যাতে সেখানে সংক্রমণ বেড়ে না যায়’, বলেন তিনি।
পরামর্শক কমিটির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সরকারকে পরামর্শ দিচ্ছি। পরামর্শগুলো কিছু মানা হচ্ছে, সবটা হয়তো মানতে পারছে না। আমরা আমাদের দৃষ্টিকোণ থেকে পরামর্শ দিচ্ছি, সরকারের আরও অন্যান্য দৃষ্টিকোণ আছে। সেগুলো মানা না হলে আমরা পুনরায় আবার সেই পরামর্শ দেই।’
অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘যেখানে সংক্রমণ বেশি আর যেখানে কম— সবগুলো নিয়েই সমন্বিতভাবে যে ভাবনা বা পরিকল্পনা, সেখানে চরম উদাসীনতা দেখা যাচ্ছে। এই যে চাঁপাইনবাবগঞ্জে সংক্রমণ এত বেড়ে গেল, যদি আগেই ব্যবস্থা নিত, তাহলে পরিস্থিতি এমন হতো না। সেখানে না বাড়লে রাজশাহীতেও বাড়ত না। রাজশাহীতে আন্তঃজেলা পরিবহন দীর্ঘদিন খোলা রাখা হলো। ফলে সেখান থেকে নাটোর, বগুড়া, ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ল। আমাদের সমস্যাটা যেখানে অল্পের মধ্যে সমাধান করা যেত, সঠিক সময়ে কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়ার ফলে ধীরে ধীরে সেটা এখন বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের সংক্রমণ হার ও মৃত্যু কমে এসেছিল। এই উদাসীনতায় তা আবার বাড়ছে। ভবিষ্যতে এই হার আরও বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে।’
যখন সংক্রমণ বেড়ে যায়, তখনই কেবল ব্যবস্থা নেওয়া হয় বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘বরাবরই আমরা দেখে এসেছি যে যখন সংক্রমণ বেড়ে যায়, তখন ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কিন্তু, ততদিনে অনেক লোকের জীবন যায়, অনেক কিছু স্বাভাবিক করা যায় না। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা মারাত্মক হুমকিতে পড়েছে। দেড় বছর ধরে আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রয়েছে। ১৩ জুন খোলার কথা ছিল। সংক্রমণ বাড়ায় আবারও অনিশ্চয়তা দেখা দিলো। যদি আমরা দায়িত্ববান হতাম, তাহলে এগুলো পরিহার করা যেত।’
‘শুরুতে ভারত থেকে ভ্যারিয়েন্টটা খুব বেশি পরিমাণে আসেনি। সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়া হলো, যারা অবৈধভাবে আসা-যাওয়া করেছেন তারা ও গাড়িচালকরা হয়তো কিছু সংক্রমণ নিয়ে এসেছেন। কিন্তু, চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ অন্যান্য জেলাগুলোতে যে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হলো, সেটা তো আমরা আঁতুড়েই বিনষ্ট করতে পারতাম। অর্থাৎ, যারা এসেছে শুরুতেই যদি তাদের বিচ্ছিন্ন করতে পারতাম, কন্টাক্ট ট্রেসিং করতে পারতাম, তাহলে সংক্রমণ এই আকার ধারণ করত না। যখন সংক্রমণ চাঁপাইনবাবগঞ্জে ছড়িয়ে পড়ল, তখন আমরা ব্যবস্থা নেইনি। যখন এটা রাজশাহীতে ছড়িয়ে পড়ল, তখন আমরা ব্যবস্থা নিলাম। অথচ সংক্রমণটা শুরুতেই থামিয়ে দেওয়া যেত। এখন কী হলো? ঢাকাসহ বেশকিছু এলাকায় সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি দেখা যাচ্ছে। আগামী ১৪ বা ২৮ দিন পর আমরা ডেলটা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ দেশের অন্যান্য জায়গাতেও দেখব’, বলেন তিনি।
চলমান পরিস্থিতি করণীয় বিষয়ে এই স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘এই মুহূর্তে স্বাস্থ্য বিভাগকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। ডিজি, এডিজিসহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের উচিত হবে উচ্চ সংক্রমিত অঞ্চলগুলোতে যাওয়া, সেখানে গিয়ে নেতৃত্ব দেওয়া। স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের ক্ষমতায়ন করতে হবে, তাদের অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে। যাতে তারা যথাযথভাবে পরীক্ষা, আইসোলেশন, কোয়ারেন্টিন, ট্রেসিং এগুলো নিশ্চিত করতে পারে। প্রয়োজনে দেশের অন্যান্য স্থান থেকে চাহিদা অনুযায়ী বেশি সংক্রমিত এলাকায় চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী পাঠাতে হবে। এগুলো করতে পারলে বেশি সংক্রমিত এলাকায় মৃত্যুঝুঁকি যেমন কমানো যাবে, একইসঙ্গে দেশের অন্যান্য এলাকায় ছড়িয়ে পড়াটাও রোধ করা যাবে।’
আরও পড়ুন:
সীমান্ত জেলার করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিশেষজ্ঞ পরামর্শ
সংক্রমণ বাড়ছে, চাপ সামলাতে প্রস্তুত নয় সীমান্তবর্তী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলো
Comments