অনার্সে দ্বিতীয় শ্রেণি ও এক বিষয়ে ফেল করেও রাবির শিক্ষক

নিয়োগ বন্ধ রাখতে সরকারি নির্দেশনা এবং শিক্ষক চেয়ে বিভাগের পরিকল্পনা কমিটির সুপারিশের তোয়াক্কা না করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আবদুস সোবহান গত ৬ মে ‘অবৈধভাবে’ নয় জন শিক্ষকসহ মোট ১৩৭ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আবদুস সোবহান এবং ইন্দ্রনীল মিশ্র। ছবি: সংগৃহীত

নিয়োগ বন্ধ রাখতে সরকারি নির্দেশনা এবং শিক্ষক চেয়ে বিভাগের পরিকল্পনা কমিটির সুপারিশের তোয়াক্কা না করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আবদুস সোবহান গত ৬ মে ‘অবৈধভাবে’ নয় জন শিক্ষকসহ মোট ১৩৭ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছেন।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, এত সব অনিয়মের মধ্য দিয়ে যে নয় জন শিক্ষককে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তাদের একজনের বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ নীতিমালা অনুযায়ী আবেদন করার যোগ্যতাই নেই।

ইন্দ্রনীল মিশ্রকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল অনুষদভুক্ত ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ইন্দ্রনীল ২০১০ সালে ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ থেকে স্নাতক পাস করেছিলেন।

এ সংক্রান্ত একটি নথি দ্য ডেইলি স্টার’র হাতে এসেছে। তাতে দেখা যায়, এই প্রার্থীর বিএসসি (সন্মান) চূড়ান্ত পরীক্ষা ২০১০ সালের সেপ্টেম্বর-নভেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত হয়। পরীক্ষায় তিনি প্রথম শ্রেণি অর্জন করতে ব্যর্থ হন। দ্বিতীয় শ্রেণির ফলাফল নিয়ে তিনি উত্তীর্ণ হন। যে ১৪ জন শিক্ষার্থী দ্বিতীয় শ্রেণি পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন তাদের মধ্যে ইন্দ্রনীলের মেধাক্রম ছিল দশম।

ফলাফলের নথি ঘেঁটে আরও দেখা যায়, তিনিই একমাত্র শিক্ষার্থী যিনি স্নাতকের একটি বিষয়ে অকৃতকার্য হয়েছিলেন। যে কারণে তিনি থিসিস গ্রুপে ভর্তি হতে পারেননি। পরবর্তীতে জেনারেল গ্রুপ থেকে প্রথম শ্রেণি পেয়ে তিনি মাস্টার্স পাস করেন। মাস্টার্সের ফলাফলে দেখা যায়, প্রথম শ্রেণি পাওয়া নয় শিক্ষার্থীর মধ্যে মেধাক্রমে তার অবস্থান পঞ্চমে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৭ সালের শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা অনুযায়ী— বিজ্ঞান, জীব ও ভূবিজ্ঞান, কৃষি, প্রকৌশল অনুষদগুলোর অধীনে থাকা বিভাগে শিক্ষক হিসেবে আবেদন করতে প্রার্থীর স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় ন্যূনতম সিজিপিএ তিন দশমিক ৫০ থাকতে হবে।

এ নীতিমালা অনুযায়ী, প্রকৌশল অনুষদভুক্ত ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ইন্দ্রনীল মিশ্র কোনোভাবেই আবেদনের যোগ্য নন। তবুও তাকে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ দিয়ে গেছেন সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আবদুস সোবহান।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানিয়েছে, ইন্দ্রনীলের বাবা চিত্ত রঞ্জন মিশ্র রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। বর্তমানে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন।

কোন যোগ্যতা বিবেচনায় নিয়ে এমন প্রার্থীকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে— সে বিষয়ে জানতে সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আবদুস সোবহানের মোবাইলে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি তা ধরেননি।

তবে নিয়োগের পরে গত ৮ মে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি সব নিয়োগকে ‘মানবিক কারণে নিয়োগ’ বলে অভিহিত করেছিলেন। তিনি আরও বলেছিলেন, তার কাছে নিয়োগ দেওয়াটা যৌক্তিক মনে হয়েছে, তাই তিনি নিজ দায়িত্বে এই নিয়োগ দিয়েছেন।

ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক এমদাদুল হক বলেন, একজন শিক্ষার্থী যাকে কি না নিজের ডিগ্রি অর্জনে বেগ পেতে হয়েছে, তাকে বিভাগের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। প্লানিং কমিটির সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে একজন স্থায়ী শিক্ষক নিয়োগের জন্য বেশ কয়েক বছর আগে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছিল। তবে বারবার সেই নিয়োগ প্রক্রিয়া পেছানো হয়েছে। কী উদ্দেশ্যে পেছানো হয়েছে তা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষই জানে। সেই বিজ্ঞপ্তির ভিত্তিতে কোনো শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়নি। অথচ অস্থায়ীভাবে এই প্রার্থীকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হলো।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচলিত নিয়োগ নীতিমালা অনুযায়ী শিক্ষক চেয়ে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিলাম। আমরা চাই সেই শর্ত অনুযায়ী বিভাগে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হোক। এর চেয়ে কম যোগ্যতাসম্পন্ন কেউ শিক্ষক হবেন সেটা কাম্য নয়।’

অধ্যাপক এমদাদুল বলেন, ‘দেশের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এ বিষয়টি তদারকি করছে। তারা যা সিদ্ধান্ত দেয়, আমরা তা পালন করবো। তবে এমন অযোগ্য প্রার্থীর নিয়োগ যদি বহাল রাখা হয়, সেটা হবে অপ্রত্যাশিত।’

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য অধ্যাপক আনন্দ কুমার সাহা বলেন, ‘সামগ্রিক এই নিয়োগের বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় দেখভাল করছে। তাদের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা পরবর্তীতে নিয়োগপ্রাপ্তদের যোগদান করতে দেবো কি না সে ব্যাপারে জানাতে পারবো।’

গত ৬ মে বিদায়ী উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুস সোবহান তার মেয়াদের শেষ কার্যদিবসে ১৩৭ জনকে অস্থায়ীভিত্তিতে নিয়োগ দেন। সেদিন সন্ধ্যায় ওই নিয়োগকে অবৈধ ঘোষণা করে তদন্ত কমিটি গঠন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তদন্তোত্তর সিদ্ধান্ত না আসা পর্যন্ত ওই নিয়োগে সংশ্লিষ্ট সবার যোগদান প্রক্রিয়া স্থগিত করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উপাচার্য ওই নিয়োগের মাধ্যমে ‘শাস্তিযোগ্য অপরাধের’ সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। তার বিরুদ্ধে ঠিক কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত তা তদন্ত কমিটি নির্দিষ্ট করেনি। তবে সুষ্ঠু বিচার প্রক্রিয়ার জন্য তার বিদেশযাত্রার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞার সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

ইতোমধ্যে অধ্যাপক আব্দুস সোবহান ও তার পরিবারের চার সদস্যের ব্যাংক হিসাবের বিস্তারিত তথ্য সরবরাহ করতে বিভিন্ন ব্যাংককে চিঠি দিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড।

Comments

The Daily Star  | English
What constitutes hurting religious sentiments

Column by Mahfuz Anam: What constitutes hurting religious sentiments?

The issue of religious tolerance have become a matter of great concern as we see a global rise in narrow-mindedness, prejudice and hatred.

9h ago