কম দামে মানসম্মত ইন্টারনেট সেবা নিশ্চিত করা অসম্ভব
ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের দাম নির্ধারণে রোববার বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) তৎপরতা প্রখ্যাত ফরাসি সাহিত্যিক আঁতোয়ান দ্য সঁতেক্সুপেরির একটি উক্তির কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। সেটা হচ্ছে- পরিকল্পনাহীন কোনো লক্ষ্য কেবল ইচ্ছা ছাড়া কিছুই না।
কাগজে-কলমে বিটিআরসির এই উদ্যোগে এমন সব উপাদানই আছে, যা এখন থেকেই ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ এজেন্ডা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে পট পরিবর্তনের ভূমিকা নিতে পারে।
বিটিআরসি সারা দেশের জন্য গ্রাহক পর্যায়ে ৫ এমবিপিএস (মেগাবিট পার সেকেন্ড) গতির ইন্টারনেটের মূল্য নির্ধারণ করেছে ৫০০ টাকা। এ ছাড়া ১০ এমবিপিএসের মূল্য ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা এবং ২০ এমবিপিএসের মূল্য ১১১০ টাকা থেকে ১২০০ টাকার মধ্যে বেঁধে দেওয়া হয়েছে। ঢাকার বাইরের ব্যবহারকারীরা ব্রডব্যান্ড সংযোগের জন্য এখন এর চেয়ে বহুগুণ খরচ করেন। সেদিক বিবেচনায় নতুন নির্ধারিত মূল্য তাদের জন্য সাশ্রয়ী।
একই সঙ্গে এটা তথ্য-প্রযুক্তি খাতে কর্মরত গ্রাফিকস ডিজাইনার, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, মোবাইল অ্যাপ ডেভেলপার ও আউটসোর্সিং প্রফেশনালদের পাশাপাশি ঢাকার বাইরের ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলোর জন্যও দারুণ একটা খবর। এমন উদ্যোগের ফলে তাদের ইন্টারনেট সংযোগের খরচ স্বাভাবিকভাবেই কমে আসবে।
স্বল্প খরচের এই ইন্টারনেট সুবিধা প্রযুক্তিভিত্তিক দূরশিক্ষণ কার্যক্রমে গতি আনবে। পাশাপাশি এমন উদ্যোগ রাজধানীর বাইরে দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় সারির শহরগুলোতে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার ও আইটি পেশাজীবীদের জন্য একটা শক্ত ভিত তৈরির সম্ভাবনা তৈরি করেছে।
তাই নিঃসন্দেহে বলা যায়, এর উদ্দেশ্য মহৎ। কিন্তু সমস্যা হলো, এটাকে কার্যকর করার জন্য আনুষঙ্গিক উপাদানগুলোর কথা বিটিআরসি ভাবেনি।
ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর (আইএসপি) জন্য সেবা মূল্যের আওতায় ব্যান্ডউইথের দাম এবং ট্রান্সমিশন ও রক্ষণাবেক্ষণের খরচও অন্তর্ভূক্ত।
এই তিনটি বিষয়ের মধ্যে সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব তৃতীয় পক্ষের হাতে ছেড়ে দিয়ে খরচ কম-বেশি সমন্বয় করতে পারলেও দুটি গুরুত্বপূর্ণ দিক বাদ থেকে যায়।
যেখানে নেশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক (এনটিটিএন) ও ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ের (আইআইজি) জন্য ইন্টারনেটের দামের নির্ধারিত কোনো গাইডলাইন নেই, সেখানে বিটিআরসি কীভাবে আশা করে যে, আইএসপি প্রতিষ্ঠানগুলো কম মূল্যে ইন্টারনেট সেবা দিতে পারবে?
আর এখানেই, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় কম মূল্যের ইন্টারনেট সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে বিটিআরসির উদ্দেশ্য শুরুতেই মুখ থুবড়ে পড়তে যাচ্ছে। সোজা কথায় বলা যায়, কীভাবে এই উদ্দেশ্য হাসিল করা হবে, সে ব্যাপারে বিটিআরসির কোনো পরিকল্পনা ছিল না।
আইএসপি প্রতিষ্ঠানগুলোর অভিমত, গ্রাহক পর্যায়ে বিটিআরসি নির্ধারিত নতুন এই মূল্য তালিকা অকার্যকর। যা টেকসই কোনো উদ্যোগ না। একই সঙ্গে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এসব প্রতিষ্ঠানের অনেকে বিটিআরসির এই সিদ্ধান্তকে হঠকারী হিসেবে অভিহিত করেছেন।
সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর ভাষ্য, ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্কের ঘনত্ব অনুসারে ঢাকা ও চট্টগ্রামে নতুন নির্ধারিত মূল্যে ইন্টারনেট সেবা দেওয়া সম্ভব। তবে এই দুটি শহরের বাইরে নতুন দাম কোনোভাবেই কার্যকর করা সম্ভব হবে না।
ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি এম এ হাকিম বলেন, ‘বিশেষ করে ছোট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করার বিষয়টি বেশি চ্যালেঞ্জের।’
এ কারণে পরিষেবা চুক্তির মাধ্যমে এনটিটিএন ও আইআইজির জন্য ইন্টারনেটের সেবামূল্য নির্ধারণ করে দিতে বিটিআরসির প্রতি দাবি জানন হাকিম।
কলম্বোভিত্তিক টেলিযোগাযোগ গবেষণা প্রতিষ্ঠান লার্ন এশিয়ার সিনিয়র পলিসি ফেলো আবু সাইদ খানের মতে, টেলিকমিউনিকেশন সেবা কার্যকর করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে ট্রান্সমিশন (সঞ্চালন ব্যবস্থা)। তার ভাষ্য, ‘অথচ আমাদের ট্রান্সমিশন ব্যবস্থা ত্রুটিযুক্ত।’
অপটিক্যাল ফাইবারের মাধ্যমে ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক স্থাপনের কাজ করার দায়িত্ব দুটি কোম্পানির হাতে। এর একটি ফাইবার@হোম ও অন্যটি সামিট কমিউনিকেশন। আবু সাইদ খান বলেন, ‘দুটি কোম্পানিই কাজটি শেষ করার মতো অবস্থায় নেই।’
মোবাইল অপারেটর ও ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ট্রান্সমিশনের জন্য এই দুটি কোম্পানির ওপর নির্ভরশীল। তবে আবু সাইদ খান বলছেন, ‘এই দুটি কোম্পানির মাধ্যমে দেশব্যাপী ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক স্থাপনের সরকারি পরিকল্পনা বিফল হয়েছে। অপটিক্যাল ফাইবারের মাধ্যমে মোবাইল অপারেটরদের মাত্র ৩৫ শতাংশ ট্রান্সমিশন সম্ভব হচ্ছে। যা আমাদের ট্রান্সমিশন ব্যবস্থার করুণ অবস্থাকে তুলে ধরছে।’
অদূর ভবিষ্যতেও এই পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না আবু সাইদ খান। আর সরকারের এই নীতি মোবাইল অপারেটরগুলোকেও তাদের নিজস্ব অপটিক্যাল ফাইবার স্থাপনে বিরত রেখেছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
আবু সাইদ খান বলেন, ‘সরকারের বিনিয়োগ বিরোধী এই নীতি টেলিকমিউনিকেশন খাতকে পঙ্গু করে ফেলেছে। অথচ টেলিকম খাতে মোবাইল অপারেটরগুলোই সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী।’
ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের অগ্রগতি ছাড়াই বিটিআরসির নতুন মূল্য নির্ধারণের এই সিদ্ধান্ত এই খাতের জন্য আসলে খারাপ পূর্বাভাস দিচ্ছে বলে মন্তব্য করেন সাইদ।
ভুল না করলে, ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো বিটিআরসির নির্দেশনা অনুসরণ করতে পারবে। তবে তা কাগজে-কলমে। তুলনামূলক ধীরগতির ইন্টারনেট সরবরাহের মাধ্যমে।
এখন একটি ব্রডব্যান্ড সংযোগ তিন থেকে চার জন ব্যবহার করতে পারে। নতুন মূল্যতালিকা বাস্তবায়ন করতে গেলে তা ২০ জনের মধ্যে ভাগ হয়ে যাবে। মানে ইন্টারনেটের গতি কমে যাবে।
কাগজে-কলমে, পাঁচ এমবিপিএস গতির ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্য এখন এক জনকে দিতে হবে ৫০০ টাকা। এই টাকায় যদি কেউ এখন ইন্টারনেটের আগের গতি পেতে চান, তাহলে সে ব্যাপারে সংশয় থেকেই যাবে।
এখন প্রশ্ন হলো, কোনো ধরনের পর্যালোচনা ছাড়াই এমন আড়ম্বরপূর্ণ ঘোষণা কেন দেওয়া হলো?
এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোয়াইট ডি আইজেনহাওয়ারের একটি উক্তির অবতারণা করা যেতে পারে। তিনি এক সময় বলেছিলেন, ‘পরিকল্পনা কিছু না; পরিকল্পনা করাই সবকিছু।
প্রতিবেদনটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মামুনুর রশীদ
Comments