বাজেটে উপেক্ষিত জীবন ও জীবিকা
অর্থমন্ত্রী হিসেবে তৃতীয় এবং বৈশ্বিক করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে নিজের দ্বিতীয় বাজেট প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ বাজেটের প্রতিপাদ্যে জীবন ও জীবিকা বাঁচানোর কথা বলা থাকলেও, সেই পথে আর যাননি তিনি।
অর্থমন্ত্রী শেষ পর্যন্ত ২০২১-২২ অর্থবছরের যে প্রস্তাবিত বাজেট উত্থাপন করেছেন, তা সময়োপযোগী হয়নি। এমন সময় এ বাজেট দেওয়া হয়েছে যখন দেশের জনস্বাস্থ্য সংকট তীব্র হয়ে ওঠেছে। এ সংকট গত ৫০ বছর ধরে হওয়া বেশ কিছু অগ্রগতিকে ধ্বংস করে দিচ্ছে।
উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটি বিস্ময়ে পরিণত হয়েছে। দেরিতে হলেও সারা বিশ্বের বিশ্লেষকরা এ সাফল্যের স্বীকৃতি দিচ্ছে। দারিদ্র্য বিমোচনে অগ্রযাত্রা এবং সামাজিক ও মানব উন্নয়ন সূচকগুলোতে উন্নয়নের গতি এ সাফল্যের মূল ভিত্তি।
কিন্তু, বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো গত বছরের মার্চ থেকে করোনা মহামারি বাংলাদেশেও জেঁকে বসেছে এবং বিশাল সংখ্যক নতুন দরিদ্র তৈরি করেছে। তবে, নিজেকে জনগণের লোক হিসেবে পরিচয় দেওয়া কামালের বাজেট দেখে মনে হচ্ছে, আসন্ন অর্থবছরের রূপরেখা প্রণয়ন করতে গিয়ে তিনি বিষয়টি উপেক্ষা করে গেছেন।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের ২০ দশমিক পাঁচ শতাংশ মানুষ আগে থেকেই দরিদ্র। মহামারির কারণে এ অনুপাত বেড়ে ৩০ শতাংশে পৌঁছে গেছে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গত এপ্রিলের হিসাব অনুযায়ী, মহামারির কারণে দেশে এক দশমিক ৬০ কোটি নতুন দরিদ্র তৈরি হয়েছে। একই সময়ে পরিচালিত পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার এবং ব্র্যাক ইন্সটিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের আরেকটি সমীক্ষার ফলাফল বলছে, মহামারির দ্বিতীয় ঢেউয়ের আগেই ২ কোটি ৪৫ লাখ মানুষকে দরিদ্র হতে হয়েছে।
সব হিসাবেই সংখ্যাটি বেশ বড়। কিন্তু, গত বৃহস্পতিবার সংসদে বাজেট বক্তৃতা দেওয়ার সময় অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘মহামারিতে বাংলাদেশে দারিদ্র্য পরিস্থিতি বিপর্যয়ের পর্যায়ে যাওয়ার মতো খারাপ হয়নি।’
তিনি বলেছেন, দেশের দারিদ্র্য পরিস্থিতির ওপর করোনাভাইরাসের সাম্প্রতিক দ্বিতীয় ঢেউয়ের সম্ভাব্য প্রভাব মোকাবিলায় সরকার কার্যকর ও সচেতনভাবে ব্যবস্থা নিচ্ছে। তবে, এ ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য দেননি তিনি।
নতুন বাজেটে সামাজিক সুরক্ষায় আগের চেয়ে খুব বেশি বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। নতুন দরিদ্রদের জন্য আলাদা কোনো তহবিলও গঠন করা হয়নি। যদিও, সরকারের আরও বেশি কিছু করার ছিল।
আসন্ন বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে ১ লাখ ৭ হাজার ৬১০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। এটি বার্ষিক হিসেবে ১২ শতাংশ বেশি হলেও, ২০০৯-১০ ও ২০২০-২১ অর্থবছরের বরাদ্দের গড় বৃদ্ধি ১৭ দশমিক ৭ শতাংশের চেয়ে কম।
২০২১-২২ অর্থবছরের সুরক্ষা কর্মসূচিতে বরাদ্দের পরিমাণ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৩ দশমিক ১ শতাংশ, যা চলতি অর্থবছরের ৩ শতাংশের চেয়ে বেশি। সব হিসেবেই, এ বরাদ্দ অকিঞ্চিৎকর।
এ ছাড়া, গত বছর করোনার প্রথম ঢেউয়ে ৩৫ লাখ নিম্ন আয়ের পরিবারকে ২ হাজার ৫০০ টাকা করে এককালীন অর্থ সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। এ বছরের ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে এ সহায়তা পায় পরিবারগুলো।
জীবিকা ও সঞ্চয় হারিয়ে সংকটে থাকা একটি পরিবারেকে এ সময়ে এসে ২ হাজার ৫০০ টাকা কতোটা সাহায্য করতে পারে? খুব বেশি না।
এরপরও, ২০২৩-২০২৪ সালের মধ্যে দেশে দারিদ্র্যের হার ১২ দশমিক ৩ শতাংশে এবং অতি দারিদ্র্যের হার ৪ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে আসবে বলে প্রত্যাশা করছে সরকার। অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় এমনটাই উল্লেখ করেছেন।
নতুন দরিদ্র হওয়া বেশিরভাগ মানুষই অনানুষ্ঠানিক খাত থেকে জীবিকা নির্বাহ করতেন। করোনা শনাক্তের হার বেড়ে যাওয়ায় বিভিন্ন সময় যেসব বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে, তাতে যে এই খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আর কোনো লকডাউন যেন না দিতে হয়, তা নিশ্চিত করার একমাত্র উপায় হলো টিকাদান কর্মসূচি জোরদার করা। কিন্তু, এ বিষয়টি নিয়েও আশ্বস্ত হওয়ার মতো কোনো পদক্ষেপের কথা বলতে পারেননি কামাল।
বাজেট বক্তৃতায় তিনি বলেছেন, ‘গণটিকাদান কর্মসূচির মাধ্যমে আমরা করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে চলমান সংকট কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হব।’
পর্যায়ক্রমে দেশের ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকা দেওয়ার একটি পরিকল্পনা সরকারের আছে বলে জানান তিনি। কিন্তু, কখন? এ ব্যাপারে একমাত্র যে ইঙ্গিতটি তিনি দিয়েছেন তা হলো, প্রতি মাসে ২৫ লাখ করে টিকা দেওয়া হবে। এর অর্থ হচ্ছে, ভবিষ্যতেও বাংলাদেশকে করোনাকে সঙ্গে নিয়েই চলতে হবে।
অন্যভাবে বলতে গেলে, অদূর ভবিষ্যতেও জনগণের জীবিকার সুরক্ষা দিতে পারছেন না অর্থমন্ত্রী। পাশাপাশি, বাজেটে এমন কিছুই নেই, যা দেখে বোঝা যায় যে তিনি বর্তমানে মানুষের চাকরি বাঁচানোর বা কর্মসংস্থান তৈরির ব্যাপারে খুব বেশি চিন্তাভাবনা করেছেন।
তার ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ পণ্যে করছাড়ের প্রস্তাব এবং স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত নির্দিষ্ট কিছু হোম অ্যান্ড কিচেন অ্যাপ্লায়েন্স পণ্য ও হালকা প্রকৌশল পণ্যে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) অব্যাহতির প্রস্তাব বেশ প্রশংসিত হয়েছে। কিন্তু, বর্তমানে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি খুব বেশি প্রয়োজন এবং এগুলোর একটিও এখন এ সুযোগ তৈরি করবে না।
এ ছাড়া, মানুষের চাকরি ধরে রাখার জন্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে কোনো প্রণোদনা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি বাজেটে। যদিও, বেশিরভাগ পশ্চিমা দেশেই এ উদ্যোগ দেখা গেছে।
সব মিলিয়ে বলা যায়, একজন নিওকনজারেভেটিভ উৎসাহীর মতো কামাল সবকিছু স্রষ্টার উপর ছেড়ে দিয়েছেন এবং আশা করছেন, তার ঘোষিত কর ছাড়ের বিনিময়ে বেসরকারি খাত নিজেই এ সমস্যার সমাধান করে নিবে।
তবে, ইতিহাস ও কেইনেসিয়ান অর্থনীতি বলছে, কোনো মন্দা থেকে বের হতে হলে, ব্যয়ের মাধ্যমেই বের হতে হয়। যুক্তি অনুসারে, ব্যয় কমে গেলে আয় কমে যায় এবং আয় কমে গেলে ব্যয় কমে যায়। এ দুষ্টচক্রটি ভাঙা দরকার।
এর একটি উপায় হতে পারে কর ছাড়ের মাধ্যমে ব্যবসা ও ব্যয় বাড়ানো। আরেকটি উপায় হতে পারে সরকারি ব্যয় বাড়ানো।
অতি সম্প্রতি জাপান তাদের দীর্ঘ ২০ বছরের মন্দা থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে। বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়ে ২০১১ সালের সুনামিতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার উপকূলীয় শহরগুলোকে পুননির্মাণের কারণে এটি সম্ভব হয়েছে।
আর্থিক দায়িত্বকে এক পাশে রেখে ‘ব্যয়, ব্যয় এবং ব্যয়ের’ পরিকল্পনা গ্রহণের যদি কোনো উপযুক্ত সময় থেকে থাকে, তবে এবার সেই সময় ছিল।
বাংলাদেশের জিডিপি অনুপাত এবং তহবিল দেওয়ার ক্ষেত্রে উন্নয়ন অংশীদারদের আগ্রহকে কাজে লাগানোর রাস্তাও সরকারের জন্য নিশ্চিতভাবেই খোলা ছিল। কিন্তু এ ব্যাপারে কামালের কোনো আগ্রহ দেখা যায়নি এবং তিনি এমন একটি বাজেট প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন, যার সঙ্গে এর কোনো সংযোগই নেই।
প্রায় ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপির এ বাজেট দক্ষিণ এশীয় প্রতিবেশী দেশগুলোর চেয়েও কম। যদিও, আর্থিক দৃষ্টিকোণ থেকে এসব দেশ বাংলাদেশের মতো স্বস্তিকর অবস্থানে নেই।
অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘দেশীয় চাহিদাকে উৎসাহিত করতে আমরা ব্যয় ও বিনিয়োগ বাড়ানোর ব্যাপারে মনোযোগ দেবো।’
আসন্ন অর্থবছরে আয়কর কাঠামো অপরিবর্তিত রেখে তিনি কীভাবে ব্যয় বাড়াবেন?
২ দশমিক ৫ শতাংশ করপোরেট কর ছাড় দিয়ে প্রয়োজনীয় কর্মসংসংস্থানের সুযোগ তৈরি সম্ভব না। ব্যবসাকে সহজ করার লক্ষ্যে বিদ্যমান অবস্থার কোনো উন্নয়ন না ঘটিয়ে বিনিয়োগ বাড়ার যে প্রত্যাশা কামাল করছেন, তা পূরণ হবে না।
শুধু জীবিকা রক্ষার ক্ষেত্রেই নয়, জীবন রক্ষার ক্ষেত্রেও হতাশ করেছেন তিনি।
এবারের বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে ১২ শতাংশ বার্ষিক বরাদ্দ বেড়েছে, যা ২০১০-১১ এবং ২০২০-২১ অর্থবছরের মধ্যবর্তী বরাদ্দের প্রবৃদ্ধি ১৪ শতাংশের তুলনায় কম।
অন্যভাবে বলা যায়, মহামারির মধ্যেও সরকার এ অতি গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু অবহেলিত খাতটিতে ব্যয় বাড়ানোর প্রয়োজন বোধ করেনি।
অথচ, বাংলাদেশে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি পাওয়া যাচ্ছে এবং এ ভ্যারিয়েন্টের মাধ্যমে সংক্রমণ ব্যাপকভাবে ছড়ানো ও হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
বাংলাদেশের চেয়ে চিকিৎসা কাঠামো অনেক ভালো হওয়ার পরও ভারতকে এ ভ্যারিয়েন্টের কারণে সংকটে পড়তে হয়েছে। ফলে বাংলাদেশকে যে এ ভ্যারিয়েন্ট কাবু করে দিতে পারে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
বাজেট বক্তৃতায় কামাল শিক্ষা খাতকেও অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলেছেন। কিন্তু, এখানেও উচ্চাভিলাষী ঘোষণার সঙ্গে কাজের যোগসূত্র স্থাপনে ব্যর্থ হয়েছেন তিনি।
প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থীর যে শিগগিরই ক্লাসরুমে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই, তা বিবেচনা করে আগামী অর্থবছরে শিক্ষা খাতে ৮ দশমিক ৭ শতাংশেরও বেশি বরাদ্দ বাড়ানো উচিত ছিল।
অনেক শিক্ষার্থীই প্রয়োজনীয় উপকরণের অভাবে ভার্চুয়াল ক্লাস করতে পারছে না এবং ঝরে পড়ছে। আর যদি সরাসরি ক্লাস করা শুরু করা সম্ভবও হয়, সামাজিক দূরত্ব মানতে হলে একই পড়ার জন্য আরও বেশি সেশনের দরকার হবে।
মোদ্দা কথা, বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ দরকার এ খাতে। কিন্তু, জিডিপির শতাংশ হিসেবে শিক্ষা খাতে সরকারের ব্যয় এক দশকেরও বেশি সময় ধরে জিডিপির প্রায় ২ শতাংশেই আটকে আছে।
জনসংখ্যার ৪৫ শতাংশের বয়স ২৪ বছরের কম, এমন একটি দেশের জন্য বিষয়টি হতাশাজনক।
বিশেষ করে, বর্তমানের চাহিদাকে উপেক্ষা করে ভবিষ্যতের চাহিদাকে গুরুত্ব দেবে-এমন বাজেট প্রত্যাশিত ছিল না।
অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমাদের অর্থনৈতিক কার্যক্রমের মূল চালিকাশক্তি আমাদের জনগণ।’
কিন্তু হায়, বাজেট প্রস্তাবের ক্ষেত্রে তিনি তাদের এক কোণে ফেলে রেখেছেন।
প্রতিবেদনটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন জারীন তাসনিম।
Comments