বাজেট ২০২১-২২

শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়েনি, কমেছে

এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম, অধ্যাপক কাবেরী গায়েন ও অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন। ছবি: সংগৃহীত

২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত শিক্ষা বাজেটে টাকার অঙ্কে বরাদ্দ কিছুটা বাড়লেও জিডিপিসহ সার্বিক হিসাবে তা কমেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, কোভিড জর্জরিত শিক্ষা খাতের জন্য যে বরাদ্দ রাখা হয়েছে তা মহামারির মধ্যে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য যথেষ্ট না। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে যা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য হতে পারে না।

করোনাভাইরাস মহামারির কারণে গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে দেশের বিদ্যায়তনিক পরিসরে শ্রেণিকক্ষে প্রথাগত পাঠদানের বিষয়টি পুরোপুরি বন্ধ আছে। এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে নতুন বাজেটে বাড়তি বরাদ্দের পাশাপাশি সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে প্রযুক্তিগত সুবিধার আওতায় নিয়ে আসা ও প্রত্যেক শিক্ষার্থীর হাতে ডিজিটাল যন্ত্র তুলে দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করার জোর দাবি ছিল।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রস্তাবিত বাজেটে এসব দাবি উপেক্ষিতই থেকে গেছে।

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল শিক্ষা খাতের জন্য নতুন অর্থবছরে মোট ৭১ হাজার ৯৫১ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছেন। যা মোট বাজেটের ১১ দশমিক ৯১ শতাংশ এবং জিডিপির ২ দশমিক ০৮ ভাগ।

বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে উত্থাপিত বাজেটের নথি অনুসারে, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে শিক্ষা খাতের জন্য বরাদ্দ আছে ৬৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। যা মোট বাজেটের ১১ দশমিক ৬৯ শতাংশ ও জিডিপির ২ দশমিক ০৯ ভাগ।

অর্থাৎ চলতি অর্থবছরের তুলনায় টাকার অঙ্কে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ৫ হাজার ৫৫১ কোটি টাকা বাড়লেও জিডিপির হিসাবে তা কমেছে।

এ বিষয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন এবং গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সদ্য বিদায়ী চেয়ারম্যান অধ্যাপক কাবেরী গায়েনের সঙ্গে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘বরাদ্দ তো কমেছেই। খালি অ্যাবসোলিউট অ্যামাউন্ট দেখলেই তো হবে না। রিলেটেডলি তা জিডিপির কোথায় যাচ্ছে সেটাও দেখতে হবে।’

আজিজুল ইসলামের অভিমত, ‘আমাদের দেশে শিক্ষা, স্বাস্থ্য এ সমস্ত খাতে আনুপাতিক হিসাবে বরাদ্দ এমনিতেই কম। আর বর্তমান পরিস্থিতিতে তো শিক্ষা খাতে ব্যয় বাড়ানোর প্রয়োজন আছে। তাই এটা ঠিক সমর্থনযোগ্য না।’

অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন বলেন, ‘বাজেটে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ পরিমাণগতভাবে কিছুটা বেড়েছে। এটাও দেখার বিষয় যে, বাজেটের একটা বড় অংশ চলে যায় শিক্ষকদের বেতনের পেছনে। দেশের নতুন নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকের সংখ্যাও বেড়েছে। সুতরাং অতিরিক্ত যে বরাদ্দটা দেওয়া হলো তা গুণগত কোনো কাজে আসবে না। এর ওপরে মুদ্রাস্ফীতির মতো বিষয় আছে। এভাবে দেখলে নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে বরাদ্দ কমেছে।’

জিডিপির হিসাবেও বরাদ্দ কমার কথা জানিয়ে অধ্যাপক মামুন বলেন, ‘সাধারণত ইউনেস্কো প্রেসক্রাইব করে যে, সুন্দর-শিক্ষিত একটা দেশ গড়ার জন্য বাজেটে জিডিপির ন্যূনতম ৬ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া উচিত। কিন্তু বাংলাদেশ হওয়ার পর সেটা সর্বোচ্চ ২ দশমিক ৫ বা ৬ শতাংশের বেশি তেমন রাখা হয়নি। এমনকি জিডিপির হিসাবে এবারও প্রস্তাবিত বাজেটে চলতি অর্থবছরের তুলনায় কম বরাদ্দ রাখা হয়েছে।’

করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত খাতগুলোর মধ্যে শিক্ষা খাতের অবস্থা ‘সবচেয়ে শোচনীয়’ উল্লেখ করে অধ্যাপক মামুন আরও বলেন, ‘মাথাপিছু আয়ের ক্ষেত্রে আমরা নাকি ভারতের থেকে উন্নত। তাহলে অন্তত ভারতে শিক্ষাখাতে যে বরাদ্দটা দেওয়া হয়, সেটাই আমাদের দেওয়া হোক। যদিও ভারতেও বরাদ্দ অপ্রতুল।’

এ পর্যায়ে বৈশ্বিক জ্ঞান সূচকে (নলেজ ইনডেক্স) বাংলাদেশের তলানির দিকের অবস্থানের বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের এই শিক্ষক। বলেন, ‘বছরের পর বছর শিক্ষা খাতে সবচেয়ে কম বরাদ্দ রাখার ফলাফলও আমরা দেখছি। জ্ঞান সূচকে ১৩৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১২তম। আমাদের ওপরে নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভূটান, ভারত, পাকিস্তান—সবাই। উচ্চ শিক্ষা খাত কিংবা প্রাথমিক শিক্ষার দিক থেকেও আমাদের অবস্থান আরও নিচে। বছরের পর বছর এই খাতে বরাদ্দ কম রেখে একটা বোকা জাতি বানানো হচ্ছে আমাদের।’

অধ্যাপক মামুন আরও বলেন, ‘পৃথিবীতে এমন একটা দেশের উদাহরণ পাওয়া যাবে না, যারা জিডিপির ৪ শতাংশের নিচে বরাদ্দ রেখে শিক্ষায় উন্নত হয়েছে। সারা বিশ্বে গবেষণা ও উন্নয়ন নামে আলাদা একটা খাত আছে। যা শিক্ষা খাতের বাইরে। বিশ্বে ১২৫টার মতো দেশ আছে যারা এই খাতে প্রতি বছর অন্তত এক বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে। দেখা গেছে যারা এই খাতে যারা যত বেশি ব্যয় করে, তারা তত বেশি উন্নত। সেই তালিকায় নেপাল আছে। কিন্তু বাংলাদেশ নাই। কারণ এই খাতে আমাদের কোনো বরাদ্দই রাখা হয় না।’

এদিকে অধ্যাপক কাবেরী গায়েনের সঙ্গে আলাপচারিতায় করোনা মহামারির ভেতর ডিজিটাল যন্ত্রের অভাব ও দুর্বল ইন্টারনেট সংযোগের জন্য দূরশিক্ষণ কার্যক্রমের দৈন্যদশার বিষয়টি উঠে আসে। তিনি বলেন, ‘আমরা ক্লাসগুলো অনলাইনে নিচ্ছি। পরীক্ষা নেওয়ার কথা বলছি। কিন্তু আমাদের এই অবকাঠামোটাই তৈরি হয়নি। আমার অনেক ছেলে-মেয়েকে (শিক্ষার্থীদের) আমি যখন জুমে লিঙ্ক করি, এমনকি আমার গবেষণার শিক্ষার্থীদের, দেখা যায় কেউ মাঠে যাচ্ছে, কেউ বাড়ির ছাদে উঠছে। তারপরেও আমরা তাদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারি না।’

কাবেরী গায়েন বলেন, ‘আমার কষ্ট লাগছে যে, গত বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের পক্ষ থেকে শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে একটা মিটিং হয়েছিল। সেখানে আমি আমার বিভাগের উদাহরণ দিয়ে বলেছিলাম, যে কত সংখ্যক শিক্ষার্থী ক্লাস করতে পারছে না। তাদের অনটনের বিষয়টি জানিয়েছিলাম।’

অধ্যাপক গায়েন আরও বলেন, ‘আমি আমার অনলাইন ক্লাসগুলো নিয়েছি প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থীদের বাইরে রেখে। এই কোভিড পরিস্থিতি কবে ঠিক হবে কেউ জানে না। কাজেই এই ‍মুহূর্তে দরকার ছিল এই ধরনের অবকাঠামোগুলো তৈরি করা। শিক্ষার্থীদের ইক্যুইপড করার জন্য বিশেষ বরাদ্দের ব্যবস্থা করা।’

কাবেরী গায়েনের পর্যবেক্ষণ হলো, প্রস্তাবিত বাজেটে এর কোনো কিছুরই প্রতিফলন ঘটেনি। তার বক্তব্য, ‘আমরা ভেবেছিলাম এবাবের বাজেটে শিক্ষা খাতের জন্য অনেক বেশি বরাদ্দ রাখা হবে। গবেষণা কিংবা অন্য কিছুর জন্য না। কেবল শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফিরিয়ে আনার জন্য। স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম চালু করার জন্য।’

কাবেরী গায়েন বলেন, ‘অথচ এর কোনোকিছুই হলো না। বরং বরাদ্দ এক অর্থে কমে গেল। আমি এটা কোনোভাবেই সমর্থন করতে পারছি না।

Comments

The Daily Star  | English
High Court

HC to deliver verdict over quick rental law Nov 14

Sections 9 and 6(2) of the Quick Enhancement of Electricity and Energy Supply (Special Provisions) Act 2010 protect rental and quick rental power plants from legal challenges

33m ago