৫ জুন ১৯৭১: বাংলাদেশকে স্বীকৃতির বিষয়ে ভাবছে ভারত: ইন্দিরা গান্ধী
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ৫ জুন গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক একটি দিন। এদিন ঢাকায় সামরিক প্রশাসন ২০ নং সামরিক আদেশ সংশোধন করে ২৩ নং সামরিক আদেশ জারি করে। এ আদেশে বলা হয়, “যদি কোনো সংস্থায় কর্মরত ব্যক্তির চাকরির শর্তে অন্তর্ভুক্ত নাও থাকে তথাপি এ আদেশ বলে সামরিক কর্তৃপক্ষ বা প্রাদেশিক সরকার দেশ কিংবা দেশের বাইরে যে কোনো স্থানে তাকে পাঠাতে পারবে। এ আদেশ গত ২৫ মার্চ থেকে সবার জন্য আবশ্যিকভাবে পালন করতে হবে।”
ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে মুক্তিসংগ্রাম সহায়ক সমিতির বৈঠক
৫ জুন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে কলকাতায় দেখা করেন বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রাম সহায়ক সমিতির একটি বিশেষ প্রতিনিধিদল। এই প্রতিনিধি দলে ছিলেন অমিয় দাশগুপ্ত, নির্মল বসু, জয়নাল আবেদিন।
এসময় প্রতিনিধি দলকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের বিষয়ে বলেন, 'ভারত সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের বিষয়টি নিয়ে ভাবছে। কেবল তো স্বীকৃতি দিয়ে দিলেই হবে না। এখানে অনেক কিছু বিবেচনা করতে হবে।'
এদিন তারা ইন্দিরা গান্ধীকে মন্ত্রিসভায় একটি উপকমিটি গঠনের অনুরোধ করেন। এছাড়া এদিন তিনি আলাদাভাবে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী, রাজ্যপাল, উপমুখ্যমন্ত্রী ও পশ্চিমবঙ্গের অর্থমন্ত্রী, ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্ব কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিংহের সঙ্গেও পৃথক বৈঠক করেন।
৫ জুন ইন্দিরা গান্ধী কলকাতায় পশ্চিমবঙ্গের মন্ত্রীদের নিয়েও বৈঠক করেন। এসময় তিনি শরণার্থীদের বিষয়ে বলেন, 'শরণার্থীদের বিষয়টি কেন্দ্র থেকে দেখভাল করা হচ্ছে। কিন্তু শরণার্থীদের বিষয়ে বৈশ্বিক দেশগুলোর নীরবতা বড়ই পীড়াদায়ক।'
ঢাকায় এদিন
৫ জুন পশ্চিম পাকিস্তান মুসলিম লীগের সেক্রেটারি জেনারেল খাজা মোহাম্মদ সফদর চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, যশোর ও খুলনা সফর শেষ করে ঢাকায় ফিরে শান্তিবাহিনী গঠনের বিষয়ে বলেন, 'শান্তি বাহিনী শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় আমাদের সেনাবাহিনীকে সাহায্য করবে। প্রতিটি জনপদ, থানায় থানায় শান্তিবাহিনীর কমিটিই প্রমাণ করবে পাকিস্তান অখণ্ড ও অটুট থাকবে। কেউ পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্র করে রেহাই পাবে না।'
পাকিস্তানে এদিন
৫ জুন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মেয়ে বেগম আখতার সোলায়মান পাকিস্তানের জাতীয় টেলিভিশনে এক সাক্ষাৎকার দেন। ওই সাক্ষাৎকারে বেগম আখতার সোলায়মান বলেন, ‘অধিকাংশ আওয়ামী লীগের সদস্যই আওয়ামী লীগের বিচ্ছিন্নতাবাদী পরিকল্পনার কথা জানতেন না। আমরা জানি জনগণ নির্বাচনের সময় অধিকতর শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ পাকিস্তান গড়ে তোলার লক্ষ্যেই আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছিল। ছয়-দফা ছিল অধিকতর স্বায়ত্তশাসনের দাবিমাত্র। এখনো আমি বিশ্বাস করি জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের অধিকাংশ সদস্য এক ও অখন্ড পাকিস্তানে বিশ্বাসী।’
৫ জুন পাকিস্তান মুসলিম লীগের চেয়ারম্যান খান আবদুল কাইয়ুম খান এক বিবৃতিতে বলেন, 'পূর্ব পাকিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নিশ্চিহ্ন করে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী আবারও প্রমাণ করেছে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সৈন্যদল তারা। আওয়ামী লীগ ও ভারতের চরদের কোনরূপ উন্মত্ততা সহ্য করা উচিত নয়।'
ভারতে এদিন
৫ জুন ভারত সরকার জানায় 'পশ্চিমবঙ্গের মালদাহ, বশিরহাট ও বনগাঁর বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে মহামারি আকারে কলেরা দেখা দিয়েছে এবং বেশ কয়েকজন কলেরায় মারা গেছেন।'
৫ জুন সমাজতান্ত্রিক ওয়ার্কার্স পার্টির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি এক বিবৃতিতে বলে, 'পশ্চিম পাকিস্তানের বিপ্লবী নেতা তারিক আলী বাংলাদেশের বিপ্লবকে এগিয়ে নেওয়ার সম্ভাব্য দিক নিরূপণের জন্য কলকাতায় এসেছিলেন। কলকাতায় তিনি বাংলাদেশ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি এবং বিপ্লবী মার্ক্সবাদে বিশ্বাসী নেতা-কর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করেন। ইয়াহিয়া খানকে চীনের সমর্থনের বিষয়ে প্রকাশ্যে নিন্দাও করেন তিনি।'
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এদিন
৫ জুন প্রভাবশালী মার্কিন দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত সিডনি শনবার্গের এক প্রতিবেদনে বলা হয় ‘ভারত সরকারের সরকারি হিসেব অনুযায়ী এখন পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে কলেরায় মৃতের সংখ্যা ৩৬০০, কিন্তু বাস্তবে সংখ্যাটি অনেক বেশি, সম্ভবত তা ৫০০০ ছাড়িয়েছে। ভারতের আরো যে তিনটি রাজ্যে শরণার্থীরা আশ্রয় নিয়েছে সেখানে কলেরায় মৃত্যুর সংখ্যা হাজারের বেশি।'
৫ জুন প্রভাবশালী ব্রিটিশ দৈনিক দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকায় অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহানের একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। রেহমান সোবহান নিবন্ধে শেখ মুজিব ও ইয়াহিয়া খানের বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেন। একই সঙ্গে পাকিস্তানে সকল প্রকার সহায়তা বন্ধের অনুরোধ করেন রেহমান সোবহান। তিনি বলেন, 'বিভিন্ন দেশের সাহায্যের অর্থ দিয়ে ক্রয়কৃত অস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে বাংলাদেশের নিরীহ মানুষের উপর।'
বিশ্বজুড়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রতিবাদ বিবৃতি ও আন্তর্জাতিক জনমত গঠন
৫ জুন যুক্তরাজ্যের এজবাস্টনে ইংল্যান্ড পাকিস্তানের মধ্যে চলমান প্রথম টেস্টের তৃতীয় দিনে বিপুল সংখ্যক বাঙালি খেলা শুরুর আগে পূর্ব পাকিস্তানে চলমান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যার ও পৈশাচিকতার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেন। এসময় বিক্ষোভকারীরা আন্দোলনকারীরা কুশপত্তলিকা দাহ করেন।
৫ মে জাতিসংঘ মহাসচিবের এক প্রতিনিধি বলেন, 'পূর্ব পাকিস্তানে জাতিসংঘের ত্রাণদলের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান রাজি হয়েছেন।' এর আগের দিন জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত ও জাতিসংঘের সহকারি মহাসচিব ইসমত কিতানি পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বৈঠকের সময় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সম্মতি দিয়েছিলেন।
৫ জুন অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড নেদারল্যান্ডসসহ বেশ কয়েকটি দেশ পূর্ব পাকিস্তানে ওষুধ ও অর্থ সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দেয়।
দেশজুড়ে গণহত্যা, প্রতিরোধ যুদ্ধ ও বিবৃতি
৫ জুন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আকবর হোসেনের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আকবর বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা রাজবাড়ি মহকুমার বালিয়াকান্দির রামদিয়াতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অন্যতম সহযোগী চাঁদ খাঁর বাড়িতে অভিযান চালায়। এই অভিযানে বিহারী চাঁদ খাঁ ও তার সহযোগীরা নিহত হয়।
৫ জুন সুবেদার পাটোয়ারীর মুক্তিবাহিনীর একটি দল পাকিস্তানু হানাদার বাহিনীর লাকসাম-চাঁদপুর রেলপথে জমজমা রেলওয়ে সেতু ধ্বংস করে দিয়ে রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়।
৫ জুন মুক্তিযোদ্ধারা মহামায়া বাজারের কাছে আরেকটি সড়ক সেতু ধ্বংস করে হানাদার বাহিনী যেন প্রবেশ করতে না পারে এই জন্য সড়কপথে চাঁদপুর-কুমিল্লা যাতায়াত সম্পূর্ণ রূপে বিচ্ছিন্ন করে দেয়।
তথ্যসূত্র:
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র - অষ্টম, নবম, দ্বাদশ, ত্রয়োদশ, চতুর্দশ খণ্ড
দৈনিক পাকিস্তান, ৬ জুন ১৯৭১
দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা, ৬ জুন ১৯৭১
দৈনিক পাকিস্তান, ৬ জুন ১৯৭১
দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, ৬ জুন ১৯৭১
আহমাদ ইশতিয়াক ahmadistiak1952@gmail.com
Comments