বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে নজর এবার বিতরণে
বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে নজর সরিয়ে সুষ্ঠু প্রবাহ ও বিতরণ নিশ্চিতে মনোযোগ দিয়েছে সরকার। গ্রাহক চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ না পেলেও এই খাত ধারণক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত উৎপাদনের কারণে সৃষ্ট জটিলতায় ভুগছে।
ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের কারণে রাষ্ট্র এই অব্যবহৃত বিদ্যুতের খরচ বাবদ একটি মোটা অংকের ব্যয় বহন করছে।
এ সমস্যার কারণে সরকার আগামী অর্থবছরের বাজেটে বিদ্যুৎ প্রবাহ ও বিতরণের অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ করতে উদ্বুদ্ধ হয়েছে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ করা ২৭ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকার মধ্যে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা বিদ্যুৎ বিভাগ পেয়েছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের অধীনে থাকা সংস্থা পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসেন জানান, বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য নতুন কোনো প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ করা হয়নি। শুধুমাত্র চালু আছে এমন উৎপাদন কেন্দ্রগুলোই নতুন তহবিল পেয়েছে।
তিনি বলেন, ‘বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ এখন চাহিদার চেয়েও বেশি। তাই সরকার এবারের বাজেটে প্রবাহ ও বিতরণের দিকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে।’
আগে বরাদ্দকৃত অর্থের ৮০ শতাংশ ব্যয় করা হত বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রকল্পগুলোতে এবং বাকিটা ব্যয় হতো বিতরণের জন্য। কিন্তু আগামী অর্থ বছরে প্রায় ৬০ শতাংশ বরাদ্দ প্রবাহ ও বিতরণ প্রকল্পে ব্যয় করা হবে।
নতুন প্রবাহ ও বিতরণ প্রকল্পগুলোর আওতায় আসন্ন অর্থবছরে নতুন বিতরণ উপস্টেশন তৈরি করা হবে। পুরনো লাইনগুলোকে বদলে নতুন লাইন বসানো হবে, কাঠের তৈরি বোর্ডগুলোকে বদলানো হবে এবং ট্রান্সফর্মারগুলোর ধারণ ক্ষমতা বাড়ানো হবে।
বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (বিআরইবি) বিভিন্ন বিতরণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। যার মাধ্যমে পল্লী এলাকাগুলোতে বিদ্যুৎ বিভ্রাটের সংখ্যা কমে আসবে।
বিতরণের নেটওয়ার্কটি তৈরি করার জন্য বিআরইবির অধীনে চার হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়াও বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি), ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি), ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো), ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি এবং নর্দান ইলেক্ট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড তাদের বিতরণ ব্যবস্থাকে আধুনিকায়নের জন্য অর্থ বরাদ্দ পেয়েছে।
ডিপিডিসি বিদ্যুৎ সিস্টেম নেটওয়ার্ককে আরও বর্ধিত ও শক্তিশালী করার জন্য বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় তিন হাজার ৫১ কোটি টাকা পেয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় মাথার ওপরে থাকা বৈদ্যুতিক তারগুলোকে সরিয়ে মাটির নিচ দিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে।
সরকার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মাতারবাড়ী ও পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের প্রবাহ ব্যবস্থা নির্মাণ করার জন্য বরাদ্দ দিয়েছে।
তবে সরকারের রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলোর ওপর থেকে পর্যায়ক্রমে নির্ভরতা কমিয়ে ধারণক্ষমতার ঊর্ধ্বগামী খরচকে সংকোচনের পরিকল্পনার সঙ্গে ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটের মিল নেই।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রবাহ ও বিতরণ ব্যবস্থার জন্য বেশি পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দেওয়ার সিদ্ধান্তটিকে স্বাগত জানিয়েছেন।
‘তবে প্রবাহ ও বিতরণ ব্যবস্থা যতটুকু গুরুত্ব পাওয়ার কথা, তা পাচ্ছে না এবং ধারণক্ষমতাকে ছাড়িয়ে যাওয়া সত্ত্বেও বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য অর্থ ব্যয় করার প্রবণতা এখনও কমেনি। প্রবাহ ও বিতরণ ব্যবস্থায় প্রয়োজন অনুযায়ী বিনিয়োগের অভাবে গ্রাহকরা দেশজুড়ে বিদ্যুৎ বিভ্রাটের শিকার হচ্ছেন,’ বলেন তিনি।
৬০০ মেগাওয়াটের মাতারবাড়ী আল্ট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে এডিপির আওতায় ছয় হাজার ১৬২ কোটি টাকা এবং রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে ১৮ হাজার ৪২৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল।
যদিও রূপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বরাদ্দটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের আওতায় পড়েছে, তবুও এটি বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ব্যবহার হচ্ছে।
মোয়াজ্জেম আরও বলেন, ‘বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বরাদ্দ এখনও প্রবাহ ও বিতরণের জন্য বরাদ্দের চেয়ে বেশি, যা হতাশাজনক।’
সিপিডির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এডিপি’র বরাদ্দের ৬২ শতাংশই বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে গেছে।
বর্তমানে বিদ্যুৎ খাত ধারণক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত উৎপাদনের কারণে সমস্যায় ভুগছে। ২ জুন ৪৮ শতাংশেরও বেশি উৎপাদিত বিদ্যুৎ অব্যবহৃত থেকে গেছে। এর ফলশ্রুতিতে বিপিডিবিকে তাদের খরচ মেটানোর জন্য একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ ভর্তুকি হিসেবে দিতে হয়েছে।
আগামী অর্থবছরের জন্য জ্বালানী ও বিদ্যুৎ খাতের নয় হাজার কোটি টাকা ভর্তুকির পরিমাণে কোনো পরিবর্তন আসেনি।
এই ভর্তুকির অর্থ হচ্ছে, বিপিডিবিকে বিদ্যুতের মূল্য বাড়ানোর জন্য বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে না।
সিপিডি তাদের বাজেট বিশ্লেষণে অভিমত প্রকাশ করেছে যে এই সংকটের মুহূর্তে বিদ্যুৎ খরচ বাড়ানো ঠিক হবে না।
বিদ্যুৎ খাতের অদক্ষতা ও অতিরিক্ত উৎপাদনের জন্য সরকারকে ভর্তুকির মাধ্যমে এই বাড়তি খরচের বোঝা বহন করতে হচ্ছে।
মোয়াজ্জেম বলেন, ‘তারা যদি ভর্তুকি না পান, তাহলে গ্রাহকদের জন্য বিদ্যুতের মূল্য বাড়াতে হবে। কুইক রেন্টাল ও অদক্ষ বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলোকে পর্যায়ক্রমে সরিয়ে নিলে এই সমস্যার সমাধান হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে একটি সুনির্দিষ্ট ঘোষণা আশা করছি যেখানে কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলোকে সরিয়ে নেওয়া, পুরনো কেন্দ্রগুলোকে বন্ধ করে দেওয়া এবং কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের জন্য নতুন করে অর্থ বরাদ্দ বন্ধের বিষয়গুলোকে নিয়ে বিস্তারিত নির্দেশনা থাকবে।’
সরকার জীবাশ্মভিত্তিক জ্বালানী তেল দিয়ে চালানো বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলোকে বন্ধ করে দেওয়ার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং তারা ক্লিন এনার্জিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
‘তবে বাজেটে এ পরিকল্পনার কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি’, বলেন মোয়াজ্জেম।
এই খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, মাত্রাতিরিক্ত উৎপাদন ক্ষমতার কারণে বিদ্যুৎ খাতে সরকারের সাফল্য ম্লান হয়ে গেছে।
জুন ৩ পাওয়ার সেলের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সর্বোচ্চ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ২৫ হাজার ২২৭ মেগাওয়াট। তবে সেদিনের সর্বোচ্চ উৎপাদন ছিল ১৩ হাজার ১৪ মেগাওয়াট। বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ১৩ হাজার ৭৯২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছিল ২৭ এপ্রিল।
২০১৮, ২০১৯ ও ২০২০ অর্থবছরের জুন মাসে ধারণক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত উৎপাদনের হার ছিল যথাক্রমে ৫৯, ৪৬ ও ৪৯ দশমিক আট শতাংশ।
২০২০ সালের জানুয়ারি ও মার্চে ধারণক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত উৎপাদনের হার ছিল সর্বোচ্চ, যা যথাক্রমে ৬৩ দশমিক তিন শতাংশ ও ৬২ দশমিক পাঁচ শতাংশ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক ইন্সটিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিক্স অ্যান্ড ফাইনান্সিয়াল এনালাইসিস এর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বাড়তি উৎপাদন ক্ষমতার গড় হার শতকরা ১০ শতাংশ।
বিদ্যুৎ সুবিধাপ্রাপ্ত জনগোষ্ঠীর পরিমাণ ২০০৯ সালের ৪৭ শতাংশ থেকে বেড়ে এ বছর ৯৯ শতাংশে পৌঁছেছে। আর একই সময়ে মাথাপিছু বিদ্যুৎ ব্যবহারের পরিমাণ দ্বিগুণের চেয়ে বেশি বেড়েছে।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান।
Comments