৪ জুন ১৯৭১: ছাতনী গণহত্যা
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ৪ জুন ঘটনাবহুল ও গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। ৪ জুন পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের বিশেষ দূত ইসমত কিতানী। এসময় ইসমত কিতানী পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা সম্পর্কে প্রেসিডেন্টের কাছে জানতে চান।
ঢাকায় এদিন
৪ জুন ঢাকায় সামরিক প্রশাসন এক এক ঘোষণায় বলে, ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর ও পুলিশ থেকে যারা দলত্যাগ করেছেন তারা যদি আত্মসমর্পণ করে তবে তাদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করা হবে।
বিদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত ও বিবৃতি
৪ জুন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনের লক্ষ্যে ব্রিটেনে সফরকারী ভারতীয় সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণের সম্মানে এক চা পার্টির আয়োজন করে ব্রিটেনে গঠিত অ্যাকশন কমিটি। সেই কমিটির সভায় জয়প্রকাশ নারায়ণ বলেন, ‘বাংলাদেশের অবস্থা বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরা প্রয়োজন। বিশ্বের বহু দেশই জানে না বাংলাদেশে কি হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মহল এখনো আশ্চর্যভাবে নীরব। চা পার্টিতে অংশ নেয়া প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ দূত আবু সাঈদ চৌধুরী বলেন, ‘বিশ্বের সকল দেশের উচিত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে বাংলার নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানো। কারণ বাংলাদেশ এখন স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র।' চা পার্টিতে আর বক্তব্য রাখেন শেখ আবদুল মান্নান ও গাউস খান। এর আগে ভারতের সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ এর আগে ব্রিটেনের বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী ব্রিটিশ এমপি ও সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশের অবস্থা সম্পর্কে জানান।
৪ জুন ব্রিটেনে বসবাসকারী প্রবাসী বাঙালিদের সংগঠন "বাংলাদেশ মহিলা সমিতি" মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে মিছিল বের করে জেমস পার্ক থেকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ১০ ডাউনিং স্ট্রিটে গিয়ে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে দেখা করে তার কাছে একটি স্মারকলিপি দেয়। এই স্মারকলিপিতে বাংলাদেশকে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক স্বীকৃতি দান ও পাকিস্তানে সকল প্রকার সাহায্য বন্ধ করার আবেদন করা হয়।
৪ জুন প্রভাবশালী মার্কিন সিনেটর হিউবার্ট হামফ্রে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে এক বক্তব্যে বলেন, 'পূর্ব পাকিস্তানে আজ প্রায় তিন কোটি নিরীহ মানুষ অনাহারে দিনযাপন করছে। অথচ নিক্সন প্রশাসন এখনো আশ্চর্যজনকভাবে নীরব। এতো বৃহৎ এক মানবিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে, পাকিস্তানি প্রশাসন প্রতিনিয়ত গণহত্যা চলমান রেখেছে অথচ আমাদের রাষ্ট্র একটি বারের জন্য ও পাকিস্তানের উপর চাপ সৃষ্টি করেনি। সিনেটে বারবার আপত্তি সত্ত্বেও এখনো নিক্সন প্রশাসন পাকিস্তানকে সহায়তা দিয়েই যাচ্ছে।'
ভারতে এদিন
৪ জুন ভারত সরকার এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায় পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেয়া শরণার্থীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৯ লাখ ৮২ হাজার ৭৯২ জন।
নদীয়া জেলা প্রশাসন এদিন জানায় এ পর্যন্ত কলেরায় শরণার্থী শিবিরগুলোতে ২৫৫০ জন শরণার্থী মারা গেছেন।
সিকিম রাজ্য থেকে এদিন ৩ লাখ টাকা সহায়তা দান করা হয় পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের শরণার্থী সহায়তা ফান্ডে।
৪ জুন পশ্চিমবঙ্গের বেশ কয়েকটি শরণার্থী শিবির পরিদর্শন শেষে কলকাতায় ফিরে মার্কিন কংগ্রেসের এশিয়া ও প্যাসিফিক রাষ্ট্রগুলোকে নিয়ে গঠিত কমিটির চেয়ারম্যান কর্নেলিয়াস গ্যালাঘার কলকাতায় এক সম্মেলনে বলেন, ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনী যে আসলেই গণহত্যা ও পৈশাচিকতা চালাচ্ছে এবং এখনো চলমান রাখছে তা একবিন্দুও মিথ্যা নয়। আমি দেশে ফিরে পুরো বিষয়টি কংগ্রেসে তুলে ধরবো।’
দেশব্যাপী গণহত্যা, বিবৃতি ও প্রতিরোধ যুদ্ধ
ছাতনী গণহত্যা
৪ জুন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নাটোরের ছাতনী ইউনিয়নের ১০টি গ্রামে পৈশাচিক গণহত্যা চালায়। এই গণহত্যায় শহীদ হন প্রায় ৪০০ মানুষ।
ছাতনী নাটোর শহর থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার পশ্চিমে। তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা এমসিএ শংকর গোবিন্দ চৌধুরীর বাড়ি ছাতনী গ্রামে হওয়ায় এই ইউনিয়নের অধিকাংশ মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। এই অজুহাতে ৪ মে রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও নাটোরের কয়েকশো সশস্ত্র বিহারী ছাতনী ইউনিয়ন এবং আশেপাশের নাড়িবাড়ি, শিবপুর, পণ্ডিতগ্রাম, বারোঘড়িরা, ভাটপাড়া, আমহাটি, ভাবনি, হাড়িগাছা, রঘুনাথপুর ও বনবেলঘরিয়াসহ ১০টি গ্রামের ঘুমন্ত মানুষদের ঘুম থেকে তুলে চোখ মুখ বেঁধে ছাতনী স্লুইজ গেটে এনে জড়ো করে। হাফেজ আব্দুর রহমানের নেতৃত্বে প্রথমে তাদের গুলি করে ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে খুঁচিয়ে এবং জবাই করে হত্যা করে হানাদার বাহিনী। এরপরে তাদের মৃত্যু নিশ্চিত করতে এবং যাতে পরিচয় শনাক্ত করতে না পারে সেজন্যে এসিড দিয়ে ঝলসে দেয়া হয় প্রত্যেকের মুখ। মরদেহগুলিকে ছাতনী স্লুইজ গেটসহ আশেপাশের পুকুর ও ডোবায় কোনো রকমে মাটিচাপা দেয়া হয়।
৪ জুন চতুর্থ বেঙ্গলের ‘এ’ কোম্পানি দুই প্লাটুন যোদ্ধা শালদা নদীর দক্ষিণে বাগড়া বাজার এলাকায় হানাদার বাহিনীর অবস্থানের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এ হামলায় ১৭ জন হানাদার সেনা নিহত ও পাঁচ জন আহত হয়। এ আক্রমণের তিন ঘণ্টা পর মুক্তিযোদ্ধারা দ্বিতীয় দফা আক্রমণ চালায়। এতে পাঁচ হানাদার সেনা নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা অক্ষত অবস্থায় ঘাঁটিতে ফিরে আসে।
৪ জুন মুক্তিবাহিনী কুমিল্লার রাজপুরে হানাদার বাহিনীর অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণে হানাদার বাহিনীর ৬ জন সৈন্য নিহত ও ৩ জন আহত হয়।
৪ জুন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী স্থানীয় দালালদের সহায়তায় পিরোজপুর ছাত্রলীগের সভাপতি ওমর ফারুককে ধরে এনে পৈশাচিক নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করে।
৪ জুন ঝালকাঠিতে হানাদার বাহিনী ও রাজাকাররা ব্যাপক নিধনযজ্ঞ চালায়। পাঁজিপুথিপাড়ায় পাকিস্তানি হানাদারদের পৈশাচিক নির্যাতনে অসংখ্য মানুষ শহীদ হয়।
তথ্যসূত্র-
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র অষ্টম, নবম, দ্বাদশ, ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ খণ্ড।
দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা, ৫ জুন ১৯৭১
দৈনিক যুগান্তর, ৫ জুন ১৯৭১
দৈনিক পাকিস্তান, ৫ জুন ১৯৭১
Comments