নতুন দরিদ্রদের জন্য কোনো আশা নেই
টাকা সমস্যা নয় এবং খুব সাহায্য প্রয়োজন এমন দরিদ্রদের সহযোগিতা করতে সরকারেরও সদিচ্ছার অভাব নেই। তাহলে সমস্যা কোথায়? কাকে সাহায্য করতে হবে তা আসলে সরকার জানে না!
বিশেষজ্ঞদের হিসাবে, করোনাভাইরাস মহামারির ১৬ মাসে দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা একলাফে ৩৫ লাখ থেকে সাড়ে ছয় কোটির বেশিতে গিয়ে ঠেকেছে। মধ্যবিত্তরা নিম্ন মধ্যবিত্তে, নিম্ন মধ্যবিত্তরা দরিদ্রে এবং দরিদ্ররা অতি দরিদ্রে পরিণত হয়েছে। এভাবেই দেশের ১৬ দশমিক ৩ কোটি জনগোষ্ঠীর প্রায় অর্ধেকেরই আর্থিক অবস্থার নীরব ও পর্যায়ক্রমিক অবনতি ঘটেছে।
হাস্যকর হলো, নতুন এই দুর্বল জনগোষ্ঠীর বিষয়ে সরকারের কাছে এখনো তেমন কোনো তথ্য নেই এবং তাদের কাছে সহায়তা পৌঁছে দেওয়ারও কার্যকর প্রক্রিয়া নেই। সরকারের হাতে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর যে তথ্য আছে, তাও ২০১৩ সালের। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) যদি দারিদ্র্য নিবন্ধন এবং ন্যাশনাল হাউসহোল্ড ডেটাবেইজটি (এনএইচডি) সময়মতো ২০১৭ সালেই সরবরাহ করতে পারত, তাহলে এই সংকট মোকাবিলায় সরকার আরও অনেক ভালো অবস্থানে থাকতে পারত। দুঃখজনকভাবে, সেই ডেটাবেইজটি ২০১৩-১৭ সালের সমীক্ষার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে, সেকারণে ২০২১ সালে প্রকাশিত হলে তাতে হালনাগাদ তথ্য থাকবে না। দারিদ্র্যের চিত্রই সম্পূর্ণ পাল্টে দিয়েছে মহামারি।
গতকাল জাতীয় সংসদে বাজেট পেশ হয়েছে, এতে সামাজিক সুরক্ষা খাতে এক লাখ সাত হাজার ৬১৪ কোটি টাকা বরাদ্দের কথা বলা হলেও, সাহায্য চেয়ে অভ্যস্ত নয় এমন নতুন দরিদ্রদের জন্য আশার আলো নেই বললেই চলে।
গত ১৬ মাসে করোনা মহামারির আঘাতে অর্থনীতি ও স্বাস্থ্যসেবা খাত নতজানু হয়ে পড়েছে। এমন একটি দেশের জন্য পর পর দুই বছর বাজেট প্রণয়ন করা সহজ নয়। বিশ্বের সেরা অর্থনীতিবিদরাও এমন দায়িত্ব নিতে দুই বার চিন্তা করবেন, সে অর্থে আ হ ম মুস্তফা কামাল নিঃসন্দেহে একজন তেজস্বী অর্থমন্ত্রী, বিশেষ করে যখন প্রায় সবাই তার কাছে সাহায্যপ্রার্থী।
সামাজিক সুরক্ষা খাতের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ তহবিল আলাদা রেখে নিঃসন্দেহে সাধ্যের মধ্যে সেরা কাজটিই তিনি করেছেন। গতবারের মতো এবারও কাগজে-কলমে দেখানো হবে যে অর্থবছরের শেষে এসে এই খাতে বরাদ্দকৃত বাজেটের ৮০ শতাংশই সামাজিক সুরক্ষা দিতে খরচ করা হয়েছে। তবে, মুস্তফা কামাল খুব ভালো করেই জানেন এবং সরকারের বাস্তবতাও এটাই যে অর্থমন্ত্রী নতুন করে দরিদ্র হওয়া জনগোষ্ঠীর জন্য কোনো সুসংবাদ দিচ্ছেন না।
‘গরিব’ ও ‘নতুন গরিব’র বিষয়টিকে এক পাশে রেখে দিলেও বলা যায় সরকার সংকটে থাকা জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষিত ও অরক্ষিত, এই দুটি ভাগে ভাগ করেছে। সরকারি চাকরিজীবীরা সুরক্ষিত এবং বেসরকারি খাতের কর্মীরা অরক্ষিত।
আমরা যদি মহামারির সময়ে স্বাস্থ্য ও আর্থিক নিরাপত্তা খাতে এ পর্যন্ত সরকারের নেওয়া সব উদ্যোগকে বিশ্লেষণ করি, তাহলে এই বিভাজনরেখাটি আরও সুস্পষ্ট হয়। এক্ষেত্রে সরকার সবচেয়ে যত্নবান ছিল সরকারি কর্মচারীদের প্রতি আর অবহেলার শিকার হয়েছেন বেসরকারি খাতের কর্মীরা।
এখন পর্যন্ত সরকারি কর্মীদের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারার জন্য অর্থমন্ত্রী ভূয়সী প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। বর্তমান পরিস্থিতি ও স্বাস্থ্যসেবা খাতের নড়বড়ে অবস্থায় কেউ সঠিক চিকিৎসা সেবা পাওয়ার আশা না করলেও তিনি যেভাবেই হোক ১৪ লাখ সরকারি কর্মচারী (বেতন ও অন্যান্য সুবিধা বাবদ প্রতি মাসে পাঁচ হাজার ১২৫ কোটি টাকা) ও প্রায় সাড়ে ছয় লাখ অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের (পেনশন বাবদ মাসে এক হাজার ৯১৭ কোটি টাকা) আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন। এ ক্ষেত্রে কোনো কার্পণ্য দেখানো হয়নি। এমনকি তাদেরকে এমন একটি সময়ে বৈশাখী বোনাস (মূল বেতনের ২০ শতাংশ) দেওয়া হয়েছে, যখন করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে সংক্রমণের হার বেড়ে গিয়েছিল এবং পহেলা বৈশাখের বেচাকেনা ও সব ধরনের উদযাপন স্থগিত করা হয়েছিল।
তবে, বিভাজন রেখার অপর প্রান্তের বাসিন্দা, বেসরকারি খাতে কর্মরত ৭৫ লাখ মানুষের জন্যই যেন শুধু দুশ্চিন্তা ও অনিশ্চয়তা নিয়ে যুদ্ধ করতে হয়েছে। সরকারের, বিশেষ করে অর্থমন্ত্রীর জন্য ২২ লাখ করদাতা জনগোষ্ঠীর সুনির্দিষ্ট ও বিশেষ যত্ন নেওয়াটা একটি বড় ধরনের বাধ্যবাধকতা হওয়া উচিত ছিল। এই জনগোষ্ঠীর ৮৬ শতাংশই বেসরকারি খাতে কর্মরত।
বেসরকারি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও চাকরিজীবীরা মহামারির সময়েও কর ও ভ্যাটে কোনো রেয়াত পাননি। এমনটি কঠোর লকডাউন থাকা অবস্থায়ও তাদেরকে সময়মতো কর ও ভ্যাট রিটার্ন জমা দিতে হয়েছে।
সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে মাত্র তিন লাখ করদাতা আছেন, এমন পরিস্থিতিতে শুধুমাত্র সরকারি কর্মচারীদের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার এই বিষয়টি কি সরকারের অন্যায্য আচরণ নয়? কিন্তু যারা বেসরকারি খাতে চাকরি অথবা ব্যবসা করে কর দিচ্ছেন, তারা চোরাবালিতে আটকে থাকছেন। শুধুমাত্র তাদেরই চাকরি যাচ্ছে, শুধুমাত্র তাদের বেতন কাটা যাচ্ছে অথবা তারা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। যদি করদাতারা সংকটের সময় সুরক্ষা না পান, তাহলে তারা কেন কর দেবেন?
আমরা সবাই আইন ও সংবিধানের চোখে সমান। সার্বিক বিবেচনায় এমন একটি ভয়াবহ মহামারির সময়ে সব নাগরিকদের জন্য সমঅধিকার নিশ্চিত করাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
দুঃখজনকভাবে, সামাজিক সুরক্ষায় সমঅধিকার বিষয়টি অন্তত এই মুহূর্তে বাস্তব নয়। নতুন করে দরিদ্র হওয়া জনগোষ্ঠী এবং সরকারি চাকরির বাইরে থাকা মানুষদের নিজের চেষ্টায় বেঁচে থাকা অথবা ধ্বংস হয়ে যাওয়া ছাড়া বিকল্প নেই।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান
Comments