কলম যখন নিরাপত্তা হুমকি
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন তার সর্বশেষ শিকার খুঁজে পেয়েছে। গত শনিবার একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস দেওয়ার পর চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার ডিপ্লোমা প্রকৌশলী শাহনেওয়াজ চৌধুরীকে (৩৭) এই আইনের মামলায় গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এর আগে, এসএস পাওয়ার ১ প্ল্যান্টের প্রধান সমন্বয়কারী ‘বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ’ করার অভিযোগে শাহনেওয়াজের বিরুদ্ধে একটি এফআইআর করেন।
১৬ মে ফেসবুক পোস্টে প্রকৌশলী শাহনেওয়াজ ‘পরিবেশ বিধ্বংসী কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের’ আন্দোলনরত শ্রমিকদের মৃত্যুর ঘটনায় বিদ্রূপ করে লেখেন, ‘স্থানীয় জনগোষ্ঠী (উন্নয়নের জোয়ারে) ভেসে যাচ্ছেন’। তিনি বাঁশখালীর তরুণ সম্প্রদায়কে সাহসী লেখনীর মাধ্যমে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও নির্ভয়ে উন্নয়নের পক্ষে অগ্রণী ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান। শাহনেওয়াজের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে, তিনি এলাকাবাসীকে অপপ্রচার ও মিথ্যা তথ্য দেওয়ার মাধ্যমে প্ররোচিত করেছেন। যার ফলশ্রুতিতে বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য নিরাপত্তা হুমকির সৃষ্টি হয়েছে। গত ১৭ এপ্রিল পুলিশের গুলিতে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ছয় জন শ্রমিক নিহত ও প্রায় ৫০ জন আহত হন।
চমকপ্রদ বিষয় হচ্ছে, যখন বিদ্যুৎকেন্দ্রের শ্রমিক, বাঁশখালীর স্থানীয় জনগোষ্ঠী ও সারা দেশের উদ্বিগ্ন নাগরিকরা এই অযাচিত সহিংসতা ও মৃত্যুর শোক কাটিয়ে উঠছিলেন, ঠিক তখনই বিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষ তাদের অসীম প্রজ্ঞাকে কাজে লাগিয়ে পুলিশের তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নের বদলে আক্রমণাত্মক প্রক্রিয়ায় পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করার সিদ্ধান্ত নিলেন। বলাই বাহুল্য, এক্ষেত্রে শক্তিশালী কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানটির জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন খুবই কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে কাজে এসেছে।
বিদ্যুৎকেন্দ্রের শ্রমিকদের অসন্তোষের কারণে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার এটাই প্রথম ঘটনা নয়। এর আগেও, ২০১৬ ও ২০১৭ সালে বাঁশখালীতে বেতন ও অন্যান্য দাবি নিয়ে আন্দোলনের সময় শ্রমিক ও গ্রামবাসীদের রক্ত ঝরেছে। সেবারও, ঘটনাটির নিরপেক্ষ তদন্তের দাবিকে অগ্রাহ্য করা হয়েছে। দায়ীদের কোনো ধরণের শাস্তি হয়নি এবং শ্রমিকদের যৌক্তিক দাবিগুলোও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পূরণ হয়নি। বিনা উস্কানিতে শ্রমিকদের ওপর গুলি চালানো ও তাদের হত্যা করা পুলিশ সদস্যদেরকে এখনও গ্রেপ্তার করা হয়নি। আন্দোলন ও মিছিলের ক্ষেত্রে আইনের নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে মোটা দাগে লঙ্ঘন করা হয়েছে। শ্রমিক ও বিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষের মধ্যে আলোচনার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বলাই বাহুল্য, অন্য যেকোনো মতানৈক্যের মতো শিল্প কারখানার ক্ষেত্রেও এ সমস্যাগুলো এমনিতেই দূর হয়ে যায় না। যদি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ বাস্তবতাকে অস্বীকার করে, সেক্ষেত্রে মতানৈক্য আরও বাড়তে থাকে এবং বাঁশখালীতে ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাগুলোর মতো একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটতে থাকে।
চলতি বছরের এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে ঘটনাটি ঘটার পর ক্ষুব্ধ শ্রমিক ও তাদের সমর্থকদের (মূলত পরিবারের সদস্য ও তাদের বন্ধুবান্ধব) শান্ত করার কোনো চেষ্টা না করে কর্তৃপক্ষ সুনির্দিষ্টভাবে ২২ জন শ্রমিক এবং আরও অজ্ঞাতনামা ১ হাজার ৪০ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। সাম্প্রতিক যেকোনো ফৌজদারি মামলা যেভাবে পরিচালিত হয়, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে স্থানীয় পুলিশ আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে আড়াই হাজারেরও বেশি অজ্ঞাতনামা আসামি করে। বলাই বাহুল্য, এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গণ্ডামারা ইউনিয়নে এই মুহূর্তে একটি ভীতিকর পরিবেশ বিরাজ করছে।
শ্রমিকদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে তাদেরকে হত্যা ও আহত করার জন্য দায়ীদেরকে পুলিশ চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। এই অমার্জনীয় সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও সেই প্রতিবেদনে স্বীকার করা হয়েছে যে শ্রমিকদের দীর্ঘ দিনের অসন্তোষ মেটানোর ক্ষেত্রে নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানটি সুস্পষ্টভাবে ব্যর্থ হয়েছে।
সহিংসতার পেছনের কারণ হিসেবে, শ্রমিকদের বেতন ও সুযোগ সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রিতা, অস্বাস্থ্যকর থাকার জায়গা, শৌচাগার ও অন্যান্য সুবিধার দুর্বল ব্যবস্থা, বিদেশি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে স্থানীয় শ্রমিকদের ভাষাগত ব্যবধান এবং তাদের অসন্তোষ মেটানোর জন্য উপযুক্ত উদ্যোগের অভাবকে চিহ্নিত করা হয়।
প্রতিবেদনে পুলিশের পক্ষে যুক্তি দিয়ে দাবি করা হয়েছে যে জনতাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য রবার বুলেট ব্যবহার করে ব্যর্থ হওয়ার পর তারা বিদেশি শ্রমিক ও কারখানার সম্পদ রক্ষার স্বার্থে গুলি ব্যবহার করতে বাধ্য হন। কারখানার শ্রমিক, প্রত্যক্ষদর্শী ও মানবাধিকার কর্মীরা তাদের এই দাবিকে নাকচ করে দিয়েছেন।
এসব তথ্য এটাই প্রমাণ করে যে, কারখানা কর্তৃপক্ষ বকেয়া বেতন ও আবাসনের অব্যস্থাপনাসহ শ্রমিকদের বিভিন্ন যৌক্তিক ও দীর্ঘ দিনের দাবিকে আমলে নিতে ব্যর্থ হয়েছে। এছাড়াও শ্রমিকদের প্রতি অত্যাচার ও দুর্ব্যবহার এবং কারখানার পরিচালনা কার্যক্রমে তাদের অংশগ্রহণের অভাবকেও সহিংসতার পেছনের গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়।
এটা খুবই বিস্ময়কর যে শ্রমিকদের যৌক্তিক দাবির প্রতি নজর দিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রে একটি কাজবান্ধব পরিবেশ তৈরি করার পরিবর্তে বড় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানটি একটি সহিংসতার পথে এগিয়েছে। এক্ষেত্রে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের দ্বারস্থ হওয়াকে কোনোভাবেই যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। বরং শায়েস্তা করার হাতিয়ার হিসেবে আইনকে ব্যবহার করার এটি একটি উদাহরণ হিসেবে বিবেচনা করা যায়। সুস্থ অবস্থায় একজন মানুষ কীভাবে ‘অবিচারের বিরুদ্ধে কলম ধরা’ কিংবা ‘উন্নয়নের জোয়ার’ এর মতো বক্তব্যকে ‘মিথ্যে ও অপপ্রচার ছড়ানোর মাধ্যমে বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা হুমকি তৈরি করা’ ও ‘ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ’ করার মতো গুরুতর অভিযোগের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলতে পারেন?
ক্ষতিগ্রস্তদের প্রত্যেককে পাঁচ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিতে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ ৪ মে কর্তৃপক্ষকে আদেশ দেন। শ্রমিক, তাদের পরিবার ও বাঁশখালীর স্থানীয় জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং তাদেরকে কোনোভাবে হয়রানি না করারও আদেশ দেওয়া হয়।
সহিংসতার ঘটনায় শ্রমিকদের হয়রানির হাত থেকে বাঁচানোর জন্য উপযুক্ত এবং দ্রুত উদ্যোগ নেওয়া এখন সরকারের নৈতিক দায়িত্ব।
শাহনেওয়াজ চৌধুরীর গ্রেপ্তারের ঘটনাটি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুর্নীতি ও অনিয়ম নিয়ে যারা কথা বলেন তাদের ওপর একটি খারাপ বার্তা দেবে। শাহনেওয়াজ তার সাংবিধানিক অধিকার অনুযায়ী নিজের মত প্রকাশ করেছিলেন এবং তরুণ সমাজকে অবৈধ কর্মকাণ্ড ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে লিখতে উদ্বুদ্ধ করার নাগরিক দায়িত্ব পালন করেছেন। সুস্থ মানসিকতার কেউ এ ধরনের আহ্বানকে অবৈধ বলবেন না এবং এটিকে অরাজকতা বা অস্থিরতা তৈরির প্রচেষ্টা হিসেবে বিবেচনা করবেন না।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান
সি আর আবরার পেশায় একজন শিক্ষক। মানবাধিকার এবং অভিবাসন বিষয়ে তার আগ্রহ রয়েছে।
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments