শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক দুর্দশা বাংলাদেশের জন্য সতর্ক বার্তা
১৯৯৭ সালে বিশ্ব ব্যাংকের মানদণ্ডে মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় উন্নীত হওয়া ঋণগ্রস্ত শ্রীলঙ্কাকে উদ্ধারে ৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ সহায়তা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকা। বাংলাদেশের জন্য এটি নিঃসন্দেহে গর্বের ব্যাপার।
একইসঙ্গে, ওই দেশটির বিপদ থেকে বাংলাদেশের শিক্ষা নেওয়ার মতো অনেক কিছু রয়েছে। এসব বিষয়ে সরকার যদি এখনই সতর্ক না হয়, তবে কয়েক বছর পর বাংলাদেশের অবস্থা শ্রীলঙ্কার মতো হওয়ার আশঙ্কা আছে।
কারণ, দুই দেশের অর্থনীতির দুর্বল দিক একই- স্বল্প কর, রপ্তানির ক্ষেত্রে একটি পণ্যের ওপর নির্ভরশীলতা এবং স্বল্প পরিমাণে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ। তবে, বাংলাদেশের হাতে এখনো শ্রীলংকার মত বিপর্যয়ে না পড়ার মতো যথেষ্ট সময় আছে।
বাংলাদেশ এখনো স্বল্পোন্নত দেশ। ফলে বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এবং জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার মতো বহুপাক্ষিক ও দ্বিপক্ষীয় ঋণদাতাদের কাছ থেকে বিশেষ সুবিধায় ঋণ নেওয়ার সুযোগ আছে দেশটির।
২৫ থেকে ৪০ বছরের দীর্ঘ মেয়াদের এসব ঋণ পরিশোধের জন্য অতিরিক্ত আরও সময় পাওয়া যায়। পাশাপাশি, এসব ঋণের সুদের হার দুই শতাংশেরও কম।
দীর্ঘমেয়াদি গৃহযুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে থাকা শ্রীলঙ্কা অবকাঠামো নির্মাণের জন্য বিদেশি ঋণের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল। এমন একটি পরিস্থিতিতে, ১৯৯৭ সালে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার পর সহজ শর্তে ঋণ পাওয়ার সুযোগ কমে যায় দেশটির। ফলে অর্থের জন্য অন্য উৎসের খোঁজ করতে হয় তাদের।
২০০৭ সালে, শ্রীলঙ্কা প্রথমবারের মতো ইন্টারন্যাশনাল সভরেন বন্ড (আইএসবি) ছাড়ে, যার মূল্য ছিল ৫০০ মিলিয়ন ডলার। ধীরে ধীরে দেশটি বাণিজ্যিক ঋণ গ্রহণের এই চ্যানেলটির ওপর নির্ভরশীলতা বাড়াতে শুরু করে।
আইএসবিগুলোর ঋণ পরিশোধের মেয়াদ পাঁচ থেকে ১০ বছর। ঋণ পরিশোধের জন্য অতিরিক্ত কোনো গ্রেস পিরিয়ড পাওয়া যায়না এবং সুদের হার ছয় শতাংশের বেশি।
এ ছাড়া, এখানে ঋণের আসল পরিশোধের বিষয় রয়েছে। কোনো আইএসবির মোট ধার করা পরিমাণ, বন্ডের মেয়াদপূর্তির সময়ে একবারে নিষ্পত্তি করতে হয়। সহজ শর্তের ঋণের মতো বছরের পর বছর ধরে পরিশোধের সময় থাকে না। তাই, যখন কোনো আইএসবির মেয়াদ পূর্ণ হয়, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে বড় ধরনের ধাক্কা লাগে।
শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, ২০২০ সালের শেষের দিকে, সভরেন বন্ডের মাধ্যমে নেওয়া ঋণ শ্রীলঙ্কার মোট বকেয়া বৈদেশিক ঋণের ৫০ শতাংশে গিয়ে দাঁড়ায়। বাণিজ্যিক ঋণের দিকে ঝুঁকে পড়া দেশটির সরকার যদি কাঠামোগত দুর্বলতাগুলোর সমাধান করতে পারতো, তাহলে পরিস্থিতি এমন হতো না।
২০১৯ সালে শ্রীলঙ্কার কর-জিডিপির অনুপাত ছিল ১২ দশমিক দুই শতাংশ। বাংলাদেশের কর-জিডিপির অনুপাতও প্রায় ১০শতাংশ, শ্রীলঙ্কার ওই অনুপাতের সঙ্গে যার খুব বেশি পার্থক্য নেই।
শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের পরিমাণ কয়েক মিলিয়নের মধ্যে আটকে আছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশে তা বিলিয়ন ছাড়িয়েছে।
শ্রীলঙ্কার ৮৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অর্থনীতি পর্যটন ও পোশাক রপ্তানির ওপর অতি মাত্রায় নির্ভরশীল, যা এটিকে বিদেশ নির্ভরশীল করে তুলেছে। অন্যদিকে, গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানি ও অদক্ষ প্রবাসী কর্মীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের কারণে বাংলাদেশের শক্ত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গড়ে উঠেছে।
তবে, রপ্তানির ক্ষেত্রে একটি বা দুটি উৎসের উপর নির্ভরতা আর অদক্ষ শ্রমিকের মাধ্যমে অর্জিত প্রবাসী আয়ে, আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে কোনো সংকট দেখা দিলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও ঝুঁকির মধ্যে পড়বে; যেটা বৈশ্বিক কোভিড পরিস্থিতিতে শ্রীলংকার ক্ষেত্রে ঘটেছে।
চলতি বছরের মধ্যে শ্রীলঙ্কার ৩ দশমিক ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিদেশি ঋণ পরিশোধের মেয়াদ শেষ হবে। এপ্রিলে দেশটির প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল। ফলে মরিয়া হয়ে অর্থের খোঁজ করছে তারা।
গ্লোবাল ক্রেডিট রেটিং এজেন্সিগুলো একতরফাভাবে শ্রীলঙ্কার সভরেন রেটিং কমিয়ে দেওয়ায় দেশটিকে আরও কঠিন পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে। তাই এ বছর আরও আইএসবি ছাড়ার কথা আর ভাবা সম্ভব নয় দেশটির পক্ষে।
ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি ফিচ গত বছর শ্রীলঙ্কার সভরেন রেটিং কমিয়ে ‘সি সি সি’ করে দেয়। একইভাবে, তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী এজেন্সি মুডিও দেশটির সভরেন রেটিং কমিয়ে দেয়।
বেসরকারি থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান বর্তমানে যে সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হচ্ছে, সেগুলো রাতারাতি তৈরি হয়নি। তাই, দুই দেশে কীভাবে সংকট তৈরি হয়েছে, বাংলাদেশের তা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে সেগুলো থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত।’
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরের ১৩ দশমিক ২ শতাংশ থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ-জিডিপির অনুপাত ১৪ দশমিক ৭ শতাংশে দাঁড়ায়, যা আন্তর্জাতিক মানদন্ড ৪০ শতাংশের অনেক নিচে। তবে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ বাড়ছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সাবেক অর্থনীতিবিদ মনসুর বলেন, ‘একটি গাড়ি যখন উঁচু থেকে নামার সময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে, তখন যত নিচে নামতে থাকে পতনের গতি তীব্র হতে থাকে এবং এ বিষয়ে আর কিছুই করার থাকে না। তবে, আমরা এখনো সেই পর্যায়ে যাইনি।’
তিনি বলেন, ২০২৪ সালের মধ্যে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হতে চলেছে। তাই, ২০২৭ সালের মধ্যেই দেশটির বিশেষ সুবিধার ঋণ পাওয়ার সুযোগ বন্ধ হয়ে যাবে। সরকারকে এ বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে।
বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের ৮৪ শতাংশই পশ্চিমা উন্নত দেশগুলোতে রপ্তানি করা গার্মেন্টস শিল্পের মাধ্যমে আসে।
মনসুর বলেন, ‘আমরা যদি দ্রুত আমাদের রপ্তানিতে বৈচিত্র্য না আনতে পারি, তবে সমস্যায় পড়ব। কেবল রেমিট্যান্সের কারণে আমাদের রিজার্ভ বেশি। কিন্তু, রেমিট্যান্সের বর্তমান অবস্থা সবসময় থাকবে না। লোকজন আবার আগের মতো অবাধ যাতায়াত শুরু করে দিলে এটি কমে যেতে পারে। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তখন কমে যাবে।’
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অবস্থা অস্বস্তিকর উল্লেখ করে ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান মনসুর বলেন, ‘বেসরকারি খাতের যে অবস্থা, তাতে আমাদের ঋণ পরিশোধ সক্ষমতা জিডিপির মাধ্যমে মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। রাজস্ব দিয়ে ঋণ পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু, আমাদের রাজস্বের ভিত্তি দুর্বল। জিডিপি অনুপাতে আমাদের রাজস্ব আয় বিশ্বের সবচেয়ে শোচনীয় ব্যবস্থাগুলোর একটি।’
সব ধরনের প্রকল্পের জন্য ঋণ না নিতে সরকারকে পরামর্শ দেন মনসুর।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রকে এমন একটি প্রকল্পের উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘অতি উৎপাদনশীল প্রকল্পের জন্য ঋণ নেওয়ার সিদ্ধান্ত কড়াকড়িভাবে বিবেচনা করা উচিত। প্রতিটা প্রকল্পের জন্য ঋণ নেওয়ার কোনো অর্থ হয় না।’
‘তবে পদ্মা সেতু এবং কর্ণফুলী টানেলের মতো প্রকল্প নেওয়া ঠিক আছে। কারণ, এগুলোর ইকোনোমিক রিটার্ন অনেক বেশি’, মত দেন তিনি।
প্রতিবেদনটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন জারীন তাসনিম
Comments